আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইন্ডিয়া ব্যাচ ট্যুর!! প্রথম পর্ব (আমার দুর্ভাগ্য ও অবশেষে একাকী ইন্ডিয়া যাত্রা)

নিজেকে আজ চিনতে বড় কষ্ট হয় বেড়াতে আমাদের খুবি ভালো লাগে, আর তা যদি হয় বন্ধু দের নিয়ে কোন ট্যুর, তবে আর আমাকে পায় কে?? সেই ২০০৮ সালের নভেম্বরে বন্ধুদের সাথে ইন্ডিয়া আর নেপাল ঘুরতে গিয়েছিলাম। এর পর কতগুলো দিন পার হয়ে গেল, ফাইনাল প্রফ দিলাম, বিয়ে নামক জীবনের নতুন ইনিংস শুরু করলাম, ইন্টার্নশীপের গলদঘর্মীয় এক বছর প্রায় শেষ করে ফেললাম। আর একটা মাস বাকি। এর পরেই সবাই যার যার মত আলাদা হয়ে যাবে। একটা ব্যাচ ট্যুর যেন ফরজ হয়ে পরল আমাদের জন্য।

এম্নিতেই ব্যাচ হিসেবে কে-৬১ কে বলা হয় লাফাঙ্গা ব্যাচ। দেশের ভেতর অনেক ট্যুর করেছি আমরা। অন্য যেকোনো ব্যাচ থেকে অনেক বেশী। তবে এই ২ বছর নানা সমস্যার কারনে ব্যাটে বলে ঠিক যেন মিলছে না। গত বছর আমার অন্যান্য বন্ধুরা মিলে কক্স বাজারে ছোট ট্যুর দিয়ে এসেছে, বিয়ে সংক্রান্ত জটিলতায় আমি সেই ট্যুরে যেতে পারিনি।

তাই কষ্টটা আমার যেন একটু বেশী । ২০১০ এর নভেম্বর মাস, আমাদের ইন্ডিয়া নেপাল ট্যুরের ২ বছর পূর্ন হল, ঠিক তখনি বন্ধু বাঁধন আর দীপন ঘোষনা দিলো, শীঘ্রই একটা ট্যুর হতে যাচ্ছে । যেমন বলা তেমন কাজ, ট্যুর প্লান রেডি। সবাই টাকা এডভান্স করলাম, ভিসার জন্য দারালাম ডিসেম্বর এর ১ তারিখ, ২ দিন পর ভিসা পাবার কথা। ভিসা কালেক্ট করতে গেল আমাদের আরেক বন্ধু।

কারন এম্বেসি ওর বাসার কাছে। খবর পেলাম, ওই দিন যারা ভিসায় দারিয়েছিলাম, সবার ভিসা হয়ে গেছে। ঝামেলা ছাড়া সব কাজ শেষ হয়েছে বলে আমরাও রিলাক্সড ছিলাম। এদিকে আমার পাসপোর্ট টি বন্ধু বাধনের কাছেই থেকে গেল। যেহেতু ২/৩ বন্ধু আমাকে কনফার্ম করেছে যে আমার ভিসা হয়ে গেছে, তাই আমিও আর টেনশন নেই নি।

আরো ১২/১৩ দিন পর বাধন আমাকে পাসপোর্ট দিতে আমার ওয়ার্ড এ আসলো। ওইদিন এডমিশন ছিলো,কাজে ব্যাস্ত ছিলাম, না কি কারন ঠিক মনে নেই, পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে সাথে সাথে ব্যাগ এ ভরে ফেললাম, খুলেও দেখলাম না, ভিসা সংক্রান্ত জটিলটা হতে পারে এ যেন সপ্নেও ভাবিনি । ২০ তারিখ আমরা ইন্ডিয়া রওনা দিব, সেই হিসেবে ১৬ তারিখ আমি আমার বান্ধবি কে নিয়ে শপিং এ বার হয়েছি। সিমলা মানালি যাব, শীতের পোশাক কিনব, কিছুই পছন্দ হয় না, ২জনে ঘুরছি, জ্যামে আটকে আছি, এমন সময় আমার জামাই এর কল আসলো। (ও আমার পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছিল ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড এনডরস করতে)।

ব্যংক এ যেয়ে ও পাসপোর্ট এর পাতা উলটায়ে দেখতে পায়, নতুন ভিসা নেই। সবাই যে ভিসা দেখে আমাকে কনফার্ম করেছে, সেটা আসলে দের মাস আগের ইন্ডিয়ার ইউসড ভিসা। ও ফোনে আমাকে এটাই জানালো, হাতে আছে আর মাত্র ২টা ওয়ার্কিং ডে, তার মানে আমার যাওয়া হচ্ছে না । কল টা পাওয়ার পর থেকে শোকে পাথর হয়ে গেলাম, একটা ব্যাচ ট্যুর মিস হওয়া মানে আমার কাছে জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার মত। তাও এটা আমাদের ব্যাচের শেষ ট্যুর।

সোজা বাসায় চলে এলাম। এত মন খারাপ লাগছিল যে বোঝানোর মত না। সবাই আমাকে বোঝাতে লাগলো, ৩ মাস আগে আমি আমার শশুর শাশুড়ির সাথে ইন্ডিয়া ঘুরে এসেছি, দের মাস আগে শিলং চেরাপুঞ্জি গিয়েছি, একি জায়গায় আর কত যাব, জামাই কে নিয়ে পরে যাওয়া যাবে, এইসব। যে যাই বলুক, বন্ধু দের সাথে শেষ ট্যুরে যেতে পারছিনা, দুঃখ টাই অন্য রকম। এর সাথে যোগ হল বকাবকি ও হাসাহাসি।

জামাই আমাকে ‘অথর্ব’ বলল। যথার্থই বলেছে, ভিসা হওয়ার এতদিন পরে কেন পাসপোর্ট নিলাম না, অন্য বন্ধুরা যতই বলুক তারা ৩ জনেই চেক করেছে, তার পরও কেন নিজে আনতে গেলাম না। আমার মত গাধা দুনিয়ায় দ্বিতীয় টা নেই। বন্ধু দের উপর রাগ করারও কোন সুজোগ নেই। ওরা আসলে পাতা উল্টায় ভিসা দেখেছে, কিন্ত ডেট চেক করেনি, এটা যে আগের ইউসড ভিসা, সেটা ওদের বোঝার কথা না।

নিজের বোকামি তে নিজের উপরি রাগ করে বসে থাকলাম । ২০ তারিখ সবাই রওনা দিবে,হাতে আছে ২টা কর্ম দিবস, রবি ও সোম্বারের দিন দুটা। আমার জামাই হঠাত আশা দিলো, ইন্ডিয়ান এম্বাসি তে একটা আপ্লিক্যাশন করে দেখা যেতে পারে, রবিবার সকালে ও আবার আম্বেসি তে গেল, ওরা বলে দিলো, ঠিক দের মাস আগে একবার ইন্ডিয়া গিয়েছি বলে এবারের ভিসা রিজেক্টেড। একবার ইন্ডিয়ান ভিসা দিলে ৩ মাসের মাঝে আবার ভিসা দেয়া যায় না (যদিও সেপ্টেম্বরে একবার ইন্ডিয়া যাবার পরও অক্টবরে আমাকে ভিসা দিয়েছিল শিলং যাবার সময়। তখন নিয়ম মানে নি কেন? পু্রোই নিজেদের মরজি মত চলে ওরা)।

বাধন আমাদের ট্যুর অপারেটরের সাথে কথা বলে জানালো, এখন কিছুই করার নাই। কোন আশা নেই, কোনভাবেই ২দিনে ভিসা পাওয়া সম্ভব না। এর পর আমার জামাই মশাই বিশাল একটা আপ্লিকেশন লিখল, অনেক টাচি কথা বার্তা, যেমন আমি ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার ঔতিহাসিক স্থাপনা দেখে নিজেকে ধন্য করতে চাই, ব্লা ব্লা। এরপর ওর এক বসের বন্ধু যে অ্যাম্বাসি তে কাজ করে, তার মাধ্যমে আমার অ্যাপ্লিকেশন রিভিউর জন্য পাঠাল। বেচারা অফিস বাদ দিয়ে সারাদিন অ্যাম্বেসির সামনে দাড়িয়ে, এদিকে আমিতো মনের দুঃখে ওয়ার্ড করি আর বন্ধু দের ইন্ডিয়া যাওয়া রিলেটেড ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে আরো দুঃখ পাই।

২০ তারিখ রাতে সবাই বাই রোড ইন্ডিয়া চলে গেল, তখন পর্যন্ত আমার কোন ব্যবস্থা হল না। যাওয়ার আগে বন্ধু তিন্নি বলে গেল, “এখনো আশা করছি, তুই দুদিন পর ফ্লাই করে ঠিকি আমাদের ধরে ফেলবি। দেখিস ভাইয়া ঠিকি তোর ভিসা বার করে ফেলবে। “ সান্তনার জন্য বলা, না সত্যি এটা ভেবেছিল জানিনা। ২১ তারিখ দুপুর, অফিস ফেলে আমর হাজব্যান্ড আজো এমব্যাসি তে পরে আছে।

কারন আজ জানা যাবে আমার ভিসা পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু। বিকালে আমাকে ফোন করে জানালো, আগামি কাল ভিসা পেয়ে যাতে পারি। নাও পেতে পারি। আমি বিশ্বাস করিনি। এইবার নিজের চোখে চেক করে দেখে তবেই না বিশ্বাস করব।

এখনো ও ভিসা অফিসের সামনে দাড়িয়ে, শুনেই খারাপ লাগলো। বেচারা আর কত কষ্ট করবে? আমি গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। যাওয়ার পর সন্ধায় জানাল, ভিসা কনফার্ম, পরদিন হাতে পাব। তবে রাত ১০ টার দিকে পেয়ে যাওয়ার একটা চান্স আছে। সুতরাং আরো অপেক্ষা।

২জনে ভিসা অফিসের সামনে দাড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি। আর গার্ড দের তাড়া খাচ্ছি। আমার জামাই একবার করে ভিসা অফিসে ডুকছে, আবার বেরুচ্ছে, আবার ডুকছে, আর আমি দাত দিয়ে নখ কাটছি। ঠিক রাত ৯টায় ও পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বার হল। ওর মুখে বীরের হাসি, আর শরীরের অবস্থা কাহিল।

আমি হাতে নিয়েই ভিসার ডেট চেক করলাম। যাক! এইবার ঠিক আছে। একদম নিউ ভিসা! আমার খুশিতে নাচার কথা। কিন্তু অদ্ভত একটা ব্যাপার হল। একটা মিশ্র অনুভুতি হতে লাগল।

১৫ দিনের জন্য জামাই কে রেখে ট্যুরে যাব, এই কাজ টা আমার হাজব্যান্ড করলে আমিতো মনে মনে দুনিয়া উলটায় দিতাম। আর ও আমার জন্য এত কষ্ট করে অসাধ্য সাধন করল। সবাই যেখানে বলে দিয়েছিল, একবার ভিসা রিজেক্টেড হলে ২ দিনের মাঝে ভিসা পাওয়া অসম্ভব। কত না ঝামেলা করে ওকে কাজটা করতে হল। এর পরের স্টেপ হল অনলাইনে ইন্ডিয়ার টিকেট কাটা।

রাত ১২টার দিকে এয়ার ইন্ডিয়ার একটা ফ্লাইট থাকে। ওইটা ধরতে পারলে আমার বন্ধুদের সাথে সরাসরি কলকাতায় মিলতে পারব। একদিন দেরি হলেই আর পাবো না। কারন পরদিন সন্ধ্যায় ওরা কলকা মেইলে সিমলা রওনা দিবে। কিন্ত দুখের বিষয়, রাতের ফ্লাইটে টিকেট না পেয়ে পরদিন দুপুরের ফ্লাইটের টিকেট কাটি।

ভিসা না হওয়ার দুঃখে শীতের জুতা মুজা ওভারকোট কিছুই কেনা হয়নি। রাত ৯টার পর তো দোকানো খোলা থাকবে না। তবে ভাগ্য ভাল বা খারাপ যাই বলি, ভিসা অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে এক্সটাসি খোলা দেখি, গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে ২মিনিটে একটা ওভারকোট কিনে ফেলি, যা পরবর্তীতে আমার জন্য যথেস্ট ভোগান্তি বয়ে আনে (দেশে ফিরে একবার ধানমণ্ডি হকারসে যেয়ে দেখি একই জিনিস কয়েকটা দোকানে ঝুলছে । আর পরে ওই ওভারকোট পরা ছবি গুলো এসেছে সব ভটকু ভটকু। তিন্নির মতে আমাকে নাকি US পুলিশের মত দেখাইছে )।

বাসায় শ্বশুর আব্বা ও শাশুড়ি মা দের জানিয়েছি, আমরা কজন বন্ধু দেরিতে ভিসা পেয়েছি বলে ২দিন পর এয়ারে যাচ্ছি। তারা যদি জানতে পারে আমি একা একা যাচ্ছি, বিকেলে পৌছে একাই ক্যাব নিয়ে হাওড়া স্টেশন যেতে হবে কলকা মেইল ধরতে, তবে তারা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারতেন । জনগণের স্বার্থেই রিলেটিভস দের জানানো হল না। পরদিন সকালে জরুরি জিনিস পাতি কিনে জামাই সহ এয়ারপোর্টর দিকে যাত্রা শুরু করলাম। এয়ারপোর্টে পৌছে জামাই কে বিদায় দিয়ে এই প্রথম একা একা ইমিগ্রেশন পার হলাম, জানিয়ে দেয়া হল, ফ্লাইট ডিলে ডিউ টু ব্যাড ওয়েদার।

আমি লবিতে বসে মোবাইল টিপি আর অপেক্ষা করি, কখন গেট ওপেন হবে। হাতে একটা গল্পের বই ছিল, তবে ইত্তেজনায় টার এক লাইন ও পড়তে পারিনি। কখন কলকাতা পৌছাব, টাইম মত হাওড়া যেতে পারব কিনা, ট্রেনে আমর সিট রেখেছে কিনা, কার সাথে সিট পাবো। এসব নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভাবছিলাম, ইন্ডিয়া পৌছে আমর জন্য আরো না জানি কি দুর্ভগ বা এডভেঞ্চার আর নতুন অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে . . . . . . . . . . . ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.