আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্ষয়ে যাওয়া নক্ষত্রের কাছে নক্ষত্রবিথীকার একটি চিঠি


ক্ষয়ে যাওয়া নক্ষত্র, ডাক্তারখানা থেকে বের হয়ে তোমার পাংশু মুখখানা আমি আজও ভুলতে পারছি না মা!যেনো অসুখ আমার করে নি করেছে তোমাকে। ডাক্তার যে এই কথাই বলবে আমি জানতাম, তাই তো প্রস্তুত ছিলাম। তুমিও তো জানতে মা!জানতে না?অ্যাপেন্ডিসাইটসের সামান্য ছোট অপারেশনই তো!এতো সাধারণ একটা অসুখ হাজারো মানুষের হয়!মা, তুমি এতো ছেলেমানুষি কর। রাতের বেলা জায়নামাজে বসে কাঁদো। সেদিন মাজারে গিয়ে নিজের জমানো টাকা সব ঢেলে দিয়ে মানত করলে!মাসখানেক আগে তোমারও তো হল একই অপারেশন।

কই কেউ তো যায়নি মানত করতে। কেউ তো রাতের পর রাত নফল নামায পরে নি। বাবার টাকা ঢালতে হত ঢেলেছে। আমদের ভাই বোনদের পালা করে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে থেকেছি। কই মা তোমার জন্য তো কেউ চোখের জল ফেলল না! বাবা চাইত আমি ডাক্তার হব.আর আমার প্রথম প্রেম ছিল গণিত।

এই নিয়ে বাবার সাথে আমার কত ঝগড়া!আমরা দুজনেই জেদি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নই!মাঝখানে আমার বোকা-সোকা মাটি গেলো ফেঁসে!কখনও আমাকে বুঝাতো বাবার পক্ষ হয়ে। কখনও বাবাকে চিনিয়ে দিতো আমার স্বপ্নের রেখাগুলোকে। কিন্তু তুমি তো কখনও বলনি মা তোমার স্বপ্ন কি ছিল!তুমি বলতে আমার স্বপ্নই নাকি তোমার। কেনো তোমার কি আলাদা করে কিছু থাকতে নেই! জন্ম থেকে আমি তোমাকে দেখেছি ক্ষয়ে যাওয়া নক্ষত্র হতে।

সকালে সবার আগে ঘুম থেকে উঠা,খাবার তৈরি করা,ঘর জামাকাপড় বাসনকোসনের সাথেই আমি তোমাকে দেখেছি সবসময়। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা এ তোমার পক্ষে অসম্ভব!প্রথম জীবনের দেখা স্বপ্নগুলো ব্যর্থ হওয়ার পর আজ যখন স্বপ্ন দেখলেই তাও অন্যকে নিয়ে! মনে আছে মা, তুমি যখন চাকরি করতে। একদিন আসতে তোমার দেরী হয় গেলো!বাসার সবাই রাতের খাবারের জন্য তোমার অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে গেল। তোমার শাশুড়ি তোমায় সেদিন কি বকাই না দিয়েছিল!শাসিয়েছিল চাকরি ছেড়ে দিতে!এরপরে আমার আরো দুটি বোনের জন্মের পর তুমি ছেড়ে দিলে চাকরি তাও আমাদের জন্য!অথচ মনে আছে ছোট বোনটির জন্মদিনের দিন আমরা সবাই বাবার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম গভীর রাত পর্যন্ত!বাবা এলো, ঘুম থেকে সবাই উঠলাম,কেক খেলাম। কারো কপালে বিরক্তির ভাঁজ পর্যন্ত ছিল না।

বাসায় বাবার আমাদের সবার বন্ধু আসে বেড়াতে। তুমি সবাইকে আপ্যায়ন কর। কিন্তু আজ অবধি আমি তোমার কোনো বন্ধু দেখিনি। তুমি তোমার বোনের বাসায় যাবে নোয়াখালীতে, সংসার কে দেখবে এই অজুহাতে রয়ে গেলে। আমি তো দিব্যি মাসে মাসে ঘুরতে বের হই।

ওইতো সেদিন সিলেট ঘুরে এলাম। বাবা তার ব্যবসার কাজে প্রতি সপ্তাহেই একবার যায় হয় চট্টগ্রাম নয় রাজশাহী। শুধু পরে থাকো শূন্য তুমি শূন্য তোমার সংসার নিয়ে। আমাদের সবার ক্যারিয়ার আছে,বন্ধু আছে,নিজস্ব একটা জগৎ আছে। শুধু তোমারই নেই!আর আমরা ধরেই নিয়েছি এই তো স্বাভাবিক! পড়ালেখা কেমন চলছে, রাস্তায় কোথাও সমস্যা হয়েছে কিনা প্রতিদিন তোমার এই প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি বিরক্ত!তাই প্রায়ই হয়ত বকা খাও আমার কাছে!ছুটির দিনে কাজ করতে মন চায় না।

যদি কাজ করতে বকা দাও অমনি মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। একটি দিন ছুটি পেয়েছি তাও...আমাদের সবার ছুটি থাকতে হয় মা, কিন্তু তোমার নয়!বছরের ৩৬৫টি দিনই তোমার কাজের দিন!এমনকি উৎসবের দিনেও দেখি তোমায় অতিথিদের জন্য খাবার তৈরি করা,ঘর পরিষ্কার করা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। উৎসবের আনন্দ তোমায় কখনও ছুঁতে পারেনি! আমরা কত স্বার্থপর তাই না মা!শুধু পাওয়ার কথাই ভাবি!অথচ তোমাকে দিয়েছি কতটুকু!ন’মাসের বোঝা কাঁধে নিয়ে প্রসবের তীব্র কষ্ট তুমি জেনেছো। ছোটকালে আমার হাগু-মুতু থেকে শুরু করে আজ অবধি সকালের নাস্তাটুকু পর্যন্ত তোমায় করে দিতে হয়!প্রসব বেদনায় তুমি যখন ছটফট করছিল বাবা কি সাথে ছিল তোমার!হাতে হাত রেখে কি তোমার কষ্টগুলো শেয়ার করেছিল!ছোটবেলায় গভীর রাতে যখন আমি কেঁদে তোমায় ঘুম থেকে তুলে দিতাম, মাঝে মাঝে কি বাবা কানের কাছে চুপটি করে বলেছিল ‘তুমি ঘুমোও, আমি যাই’। বলেছিল কি মা! মিডটার্ম পরীক্ষায় আমি খারাপ করেছি বলে তোমার সে কি টেনশন!আমার এতো হাসি পেয়েছিল তোমার ছেলেমানুষি দেখে!অথচ দেখো ডিগ্রির সার্টিফিকেটে কিন্তু আমার নামের পিছনে বাবার নাম থাকবে।

আমি যদি কখনও পাখি হয়ে উড়াল মারি ভিনদেশে, তবে বাবাই হবে আমার সঙ্গী। আমি ভালো হলে বাবার বংশের নাম হবে!তুমি কোথাও নেই মা!কোথাও নেই! কিন্তু এই যে আমার অস্তিত্বের সাথে তুমি সেটে আছ জড়িয়ে আছো পাতার মতো তাকে অস্বীকার করি কিভাবে!এ তো নাড়ীর টান! তোমাকে কাব্য করে, গল্পে এঁকে অনেকেই বিখ্যাত হয়েছে। কিন্তু সম্মানটুকু দেয়নি আজ পর্যন্ত কেউ। তোমাকে ব্যবহার করতে আমরা কখনই কৃপণতা করিনি। কিন্তু দেয়ার বেলা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি।

তুমি তবুও শুধু দিয়েই গেলে। যেনো আমরা ধরেই নিয়েছি-মা নামের নক্ষত্র এসেছেই তো ক্ষয়ে যেতে,নিজেকে বিলিয়ে দিতে। তাই তোমাকে একটি নক্ষত্রবীথি দেয়ার কথা কেউ কখনও বলেনি। না চাইতেই যা পাওয়া যায় তার কোনো মূল্য নেই মানুষের কাছে! কিন্তু জীবন বড় নিষ্ঠুর মা। আমরা ভুলে যাই জীবন যতটুকু দেয় কড়ায়-গণ্ডায় তা শোধও করে নেয়।

রবির একটা কথা মনে পরে গেল-না চাহিলে যারে পাওয়া যায়/ত্যায়াগিলে আসে হাতে/দিবসে এসে ধন হারায়েছি/আমি পেয়েছি আধারও রাতে। তবে কি আমাদেরও মূল্য দিতে হবে,রাতের আধার পোহাতে হবে!তোমাকে অপমান করার, তোমাকে না দেয়ার! আজ তোমার উদ্দেশ্যে কোনো পদ্যের সান্ত্বনা নয় প্রশংসার কোনো বানীও নয় নিতান্তই সহজ সরল স্বীকারোক্তি-মা, আমরা তোমার অধম সন্তান। আমাদের মূল্য চুকাতে দাও। আমাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও। তবুও তুমি হারিয়ে যেওনা।

বেঁচে থেকো এভাবেই নক্ষত্র হয়ে!রাতের বেলা একা হেটে চলার পথে যখনই তাকাই তখনই যেনো দেখতে পাই তোমায়। আমার আকাশের সবচেয়ে প্রিয় তারাটি হয়ে। আমার প্রাণ তিষ্য তুমি ভালো থেকো! ইতি, তোমার নক্ষত্রবিথীকা।
 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.