আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বপ্নদ্রষ্টা হুগো চাভেজ

সৃষ্টি‌শীল ভেনেজুয়েলার (সদ্য প্রয়াত) প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ সম্পর্কে গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা যা শুনি বা পড়ি, এর অধিকাংশ প্রায় সব সময়ই নেতিবাচক। এসব খবরে তাঁর ভুল-ত্রুটি অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। সচরাচর তাঁর বক্তব্যের বিকৃত উপস্থাপন আর অর্জনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। অথচ বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। হুগো চাভেজ ছিলেন সারা বিশ্বের কোটি মানুষের প্রিয় নেতা।

লাতিন আমেরিকার গতিপথ বদলে দিয়ে গেছেন তিনি। এক সময়ের নীরব, শোষিত, বঞ্চিত, প্রতারিত ও অববেহলার শিকার একদল মানুষকে জেগে ওঠার মন্ত্র শুনিয়ে গেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন। চাভেজ ছিলেন মহান এক স্বপ্নচারী ও স্বপ্নের স্রষ্টা। সৎ ও বিনয়ী চাভেজের শৈশবের দিনগুলো কেটেছে একটি মাটির কুটিরে।

রুটি রোজগারের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করতেন ক্যানডি। আর স্বপ্ন দেখতেন শক্তিশালী, সার্বভৌম ও বিদেশি প্রভাবমুক্ত একটি রাষ্ট্র গড়ার এবং সেই রাষ্ট্রকে বিশ্বের দরবারে মহীয়ান করে তুলে ধরার। নিজের জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন করে তাঁদের জীবন-মান উন্নত করার এবং তিনি যেমনটি বলতেন, সবার জন্য একটি ‘উত্তম জীবন’ যাপনের সুযোগ করে দেওয়ার স্বপ্ন তাঁর ছিল। প্রেসিডেন্ট চাভেজ এসব স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে গেছেন। ছয় বছর মেয়াদে তিন দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু মৃত্যু এসে নিয়ে গেছে। তাই শেষ মেয়াদ পূরণের সুযোগ পাননি। তাঁর প্রায় ১৪ বছরের শাসনামলে, চাভেজের নীতির কারণে মাত্র এক দশকে ভেনেজুয়েলার চরম দারিদ্র্য ৭৫ শতাংশ কমে আসে। ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দেশটির গড় দারিদ্র্য ৬০ শতাংশ থেকে নেমে আসে ৫০ শতাংশে। ২০০৮ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ২৭ শতাংশে।

আর তা কেবল সংখ্যার মামলা নয়। সত্যি আমূল বদলে যায় ভেনেজুয়েলা। দেশটির লাখো মানুষ আজ তিন বেলা খাবার খেতে পারে। তাঁদের বাসস্থান আছে। তারা চলে এসেছে চাকরি কিংবা আর্থিক সহায়তা পাওয়ার আওতায়।

কিন্তু স্বপ্ন তাঁর এখানেই থেমে থাকেনি। চাভেজ স্বপ্ন দেখেন এমন একটি রাষ্ট্রের যেটি কানায় কানায় ভরে উঠছে শিক্ষিত মানুষে। এর জনগণ হবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এ লক্ষ্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে ব্যাপক পরিকল্পনা করেন তিনি। হাতে নেন প্রিস্কুল থেকে ডক্টরাল পর্যন্ত বিনাপয়সায় ও মানসম্পন্ন গণশিক্ষা কার্যক্রম।

সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের জন্য, যারা ছিল শিক্ষার আলো বঞ্চিত, নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও চলে ভ্রাম্যমাণ শিক্ষা কার্যক্রম। কিউবার সহায়তায় ভেনেজুয়েলার প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে জাতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন চাভেজ। কিউবার হাজার হাজার চিকিৎসক ভেনেজুয়েলাবাসীকে চিকিৎসা সেবা দেয়, যাদের অনেকে জীবনে প্রথমবারের মতো এই সেবা পায়।

কমিউনিটিগুলোকে শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করে তুলতে চাভেজ অংশগ্রহণমূলক শাসন ব্যবস্থা চালু করেন, এর মধ্য দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে যারা কখনো রাজনীতি করেননি, তাঁদের যুক্ত করেন। তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়। নতুন নতুন রেলপথ নির্মাণ করেন, কলকারখানা স্থাপন করেন। মেট্রোক্যাবল কারের মতো অভিনব যানবাহন চলে। শহর-বন্দরের সঙ্গে দেশটির পাহাড়ের পাদদেশের বাসিন্দাদের যোগাযোগ সুগম হয়।

স্বাধীনতার বীর সিমোন বলিভারের স্বপ্ন ছিল লাতিন আমেরিকার জন্য একটি গ্র্যান্ড হোমল্যান্ড গড়ার। তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে লড়েছেন চাভেজ। লাতিন আমেরিকার একত্রীকরণে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ইউনিয়ন অব সাউথ আমেরিকান ন্যাশন (ইউএনএএসইউআর), কমিউনিটি অব ল্যাটিন আমেরিকান, বলিভারিয়ান অ্যালায়েন্স ফর দ্য পিপলস অব আউয়ার আমেরিকার ও ক্যারাবিয়ান স্টেইটস (সিইএলএসি)-এর মতো নতুন নতুন আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এসব সংগঠনের মূল দীক্ষা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।

শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের পররাষ্ট্র নীতির মতো প্রতিযোগিতা, প্রতারণা ও আগ্রাসী নীতি তারা পরিহার করেন। একাদশ শতাব্দীর বিশ্বকে ন্যায়ের জন্য লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলে গেছেন চাভেজ। যেসব সাম্রাজ্যবাদী দেশ অন্য দেশের আগ্রাসী হয়ে ওঠে, শোষণ-নীপিড়ন চালায়, এদের বিরুদ্ধে চাভেজ বজ্রকণ্ঠে রুখে দাঁড়ান। অন্যকেও সাম্রাজ্যবাদ মোকাবিলার শক্তি জুগিয়ে গেছেন।

যখন অন্যরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চুপ মেরে থেকেছেন, তখনই শোনা গেছে চাভেজের বজ্রকণ্ঠ। তিনি জানতেন, কেউ থাক বা না থাক সত্য তাঁর পাশে আছে, সব সময়। স্বপ্নস্রষ্টা চাভেজ তাঁর দেশের প্রতিবন্ধী, আদিবাসীসহ সব লিঙ্গের মানুষের যার যার অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বর্ণবৈষম্য ও শ্রেণীবাদ গুড়িয়ে দিয়ে নিজেকে একজন সমাতান্ত্রিক নারীবাদী বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। কেবল নিজের স্বপ্নের বাস্তবায়ন নয়, বরং আমাদের সবার সুপ্ত শক্তি বিকাশের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছেন।

আমাকে ভুল বুঝবেন না, ভেনেজুয়েলার সবকিছু ঠিক তা বলছি না, কিন্তু চাভেজ প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগের সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে পরিষ্কার হয়ে ওঠে, দেশবাসীর অনেক উন্নতি হয়েছে। চাভেজ ছিলেন তাঁর জীবনের চেয়েও অধিক কিছু, এসব সত্য আজ আর কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। আমি প্রথমবার যখন চাভেজের বিমানে চড়ি, তিনি অামাকে নাস্তা করার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত কামরায় আমন্ত্রণ জানান। ওই কক্ষে তখন আর কেউ ছিল না। আমি নার্ভাস বোধ করি।

২০০২ সালে তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ব্যর্থ অভ্যুত্থান-সংক্রান্ত আমার তদন্তের বিষয়ে গড়গড় করে তাঁকে বলতে থাকি। ওই জন্যই তো আমি ওই বিমানের প্রথম সারিতে ছিলাম সেদিন। এরপর আমাকে তাঁর হ্যালো মি. প্রেসিডেন্ট নামের নিয়মিত রোববারের টেলিভিশন শোতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তথ্য অধিকার আইনের (এফওআইএ) যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে আমি যেসব গোপন নথি সংগ্রহ করেছিলাম, সেগুলো ওই শোতে উপস্থান করতে বলা হয়েছিল। ওই নথি ঘেঁটে দেখা যায়, অভ্যুত্থানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিপুল তহবিল সরবরাহ করে।

এটা ছিল, ২০০৪ সালের ১১ এপ্রিলের ঘটনা। এর ঠিক দুই বছর আগেও চাভেজকে হত্যার মাধ্যমে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির এমনই ষড়যন্ত্র করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আমি টেবিলের ওপর নথিপথ রাখছি, সেগুলো মেলে ধরছি। ‘এসব থাক, তুমি কি নাস্তা করেছে?’ জিজ্ঞেস করেন চাভেজ। জবাবে আমি বলি, না।

আমি আবারও নথিপত্রের দিকে মনযোগ দিই। ‘আমরা পরেও এসব নিয়ে আলোচনা করতে পারব’, বলেন চাভেজ। এবার আমাকে তোমার নিজের কথা আমাকে শোনাও। তোমার মা কেমন আছেন? এমন ভাবে জিজ্ঞেস করেন চাভেজ, যেন আমরা কতদিনের পুরোনো বন্ধু। একজন বিমানবালা এলেন।

হাতে দুটি ট্রে। আমাদের টেবিলের সামনে রাখলেন। আমি দ্রুত নথিপত্র গোছাই। ‘চল খাই’ বলেন চাভেজ। আমি মৃদু আপত্তি জানাই, তাঁকে বলতে থাকি, তাঁর সময় কত কম।

আর এই সময়ের প্রতিটি মিনিট কাজে লাগাতে চাই আমি। ‘এটি কারাকাসের নাস্তা, যা আমার খুবই পছন্দ,’ বলেন চাভেজ। এবার আমি ট্রের দিকে নজর দিই। ছোট্ট একটা থালায় ভেনেজুয়েলার কিছু আরেপা, মাখন, দুই টুকরো কানটেলোপ ও কিছু অ্যানকোভিস। এছাড়া দুই মগ ব্ল্যাক কফি।

কোনো প্রেসিডেন্টের বিমানে যেমন জাঁকজমক থাকার কথা, এর কিছুই নেই। ‘আমি স্রেফ একজন সৈন্য’, যোগ করেন চাভেজ। হ্যাঁ, চাভেজ, আপনি একজন লড়াকু সেনাই বটে, মর্যাদাবান, গর্বিত ও মমতাময় কোটি মানুষের গর্বিত বীর। সারা বিশ্বে কোটি মানুষের স্বপ্নস্রষ্টা। (মূল : Eva Golinger, Eva Golinger is a Venezuelan-American[1] attorney and editor of the Correo del Orinoco International, a web- and print-based newspaper which is financed by theVenezuelan government) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.