আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আতংকজনক অভিজ্ঞতা

জনারণ্যে নির্জনতায় আক্রান্ত। নির্জনতাই বেশী পছন্দ, নিজের ভেতরে ডুবে থাকতেই ভাল লাগে। কিছুটা নার্সিসিস্টও।

বাবার চাকুরিজনিত কারনে আমরা তখন নোয়াখালী জেলাশহর মাইজদীতে থাকি। তখন মাইজদী খুবই ছিমছাম ও নিরিবিলি শহর ছিল।

আমরা তিন বন্ধু আমি, রিপন, আবদুল্লাহ্ । আজ আবদুল্লাহ্ ইংল্যান্ডে, রিপন চট্টগ্রামে, আমি ঢাকায়। একদিন অলস দুপুরে ঘুরতে ঘুরতে তিনজন শহরের পাশ দিয়ে যে সরু নদী কুলকুল করে বয়ে চলছে, তার পার দিয়ে হাঁটছিলাম। তখন ছিল বর্ষাকাল। নদীর কুলে একটি ছোট নৌকা পেয়ে তিনজনই তাতে চেপে বসলাম।

নৌকার মালিক আমাদের পূর্বপরিচিত থাকায় তার কাছ থেকে নৌকা নিতে কোন সমস্যাই হল না। আমরা যেহেতু নৌকা চালাতে পারি না তাই সে আমাদের সাথেই আসতে চাচ্ছিল । আমরাই এডভেঞ্চারের আশায় তাকে সাথে নিলাম না। রিপন হাতে বৈঠা তুলে নিল। অনভিজ্ঞতার কারনে কিছুক্ষন নৌকা ঘুরপাক খেয়ে চলা শুরু করল।

কোথায় যাওয়া যায় ? মিলিতভাবে ঠিক করলাম কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে নয়। শহর ছেড়ে গ্রামের দিকেই যাওয়া যাক। যতটুকু পারি যাব। নৌকা চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে গেলে ফিরে আসব। অনভিজ্ঞ হাতে চালনার কারনে নৌকা খুবই ধীর গতিতে চলছিল।

হাসি-ঠাট্টা, গল্পের মাঝে খুবই ভাল লাগছিল, যদিও আকাশে প্রচন্ড রোদ থাকার কারনে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছিল। নদীর দু-তীরের অনাবিল দৃশ্য মন-প্রান দুইই ভাল করার জন্য ছিল যথেষ্ট। এভাবে প্রায় দুঘন্টা হবে পালাক্রমে নৌকা চালিয়েছি। শহর ছাড়িয়ে অনেক দুর চলেও এসেছি। নদীর দুদিকে শুধু ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত।

এবার ফেরা দরকার। তবে তার আগে রোদ এবং নৌচালনায় ক্লান্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম কোথাও নৌকা থামিয়ে যাকিছু হোক পেটে দেয়া দরকার। কিছুদুর এগিয়ে নদীর তীরে ছোট একটি ঘাট পাওয়া গেল। ঘাটে নৌকা ভিড়ালাম। ভাগ্যক্রমে সেখানেই টঙঘরের মত একটি দোকানও পাওয়া গেল।

যাক বাবা, এখানে ক্ষনিক জিরিয়েও নেয়া যাবে, আবার পেটেও কিছু দেয়া যাবে ! এখানেতো আর ভাত পাওয়া যাবে না, তাই দোকান থেকে মুড়ি, কলা, বিস্কুট নিলাম। তিনজনই খাওয়া শুরু করলাম। এখানে বলে নিই, আমাদের ডিঙ্গি নৌকা ঘাটে ভিড়ার পর থেকেই ৫-৭টি শিশু-কিশোর আমাদের পিছু ছাড়ছিল না। খাওয়ার সময় তাদেরকেও আমন্ত্রন জানালাম। তারা সানন্দে আমন্ত্রন গ্রহন করল।

টুকটাক তাদের সাথে কথা বলছিলাম। ওরাও খুব মজা পাচ্ছিল। আমাদের বাসা ছিল নোয়াখালী সরকারী মহিলা কলেজ রোড। কথায় কথায় তাদেরকে জানালাম আমাদের বাসা কোথায়। তাদের মাঝে ৮-৯ বছরের ইসমাইল বলল তার খালার বাসাও মহিলা কলেজ রোড।

সে নিজেই আমাদেরকে প্রস্তাব দিয়ে বসল, আমি আপনাদের সাথে নৌকায় করে যাব। অনেকদিন খালার বাসায় যাই না। আমরা তার খালার নাম জিজ্ঞেস করলাম। সে নাম বলতে পারল না। তবে বাসা চিনে একথা জানাল।

আমরা জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যে আমাদের সাথে যাবে, তোমার বাড়ীতে তোমার মাকে কে জানাবে। সে তার সাথের আর একটি পিচ্চিকে বলে দিল সে যেন তার বাড়ীতে তার মাকে জানিয়ে দেয় সে যে আমাদের সাথে যাচ্ছে। আমরা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নৌকায় এসে উঠলাম। সাথে ইসমাইল। সে তার বন্ধুকে আবারও বলে দিল তার বাড়ীতে যেন সে জানিয়ে দেয়।

খুব কম দামে পাওয়ায় আমরা এক কাঁদি পাকা কলাও কিনে নিলাম। যাবার সময় নৌকা চালিয়ে অভ্যস্থ হয়ে উঠায় ফিরতি পথে আমাদের নৌকার গতি ভালই ছিল। আমরা নৌকা চালাচ্ছিলাম কিছুটা নদীর তীর ঘেঁষে। অজশ্র শাপলার ফুল ফুটে আছে নদীর কুল ঘেঁষে। আমরাও হাতের নাগালের শাপলা তুলে নিচ্ছিলাম।

আমাদের নতুন সহযাত্রী ইসমাইল খুব উৎসাহ সহকারে আমাদেরকে শাপলা তুলতে সাহায্য করছিল। বেশীদুর আসিনি। হঠাৎ আমাদের ফেলে আসা পথের পিছনে প্রচন্ড শোরগোল শোনা গেল। আমরা ফিরে তাকিয়ে দেখি নদীর পার দিয়ে প্রায় ৫০-৬০ জন নারী পুরুষ হাতে লাঠিসোটা, কাঁচি-বটি নিয়ে আমাদের দিকে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে। তাদের মাঝে নারীর সংখ্যাই বেশী।

কয়েক সেকেন্ড লাগলো ব্যাপারটি বুঝতে। মুহুর্তে বুঝে গেলাম কি ঝামেলায় আমরা পড়তে যাচ্ছি। বন্ধুদেরকে বললাম কি ঘটতে যাচ্ছে। ওরা আমাদেরকে ছেলেধরা ভেবেছে। উত্তেজিত জনতা প্রায় আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে।

তাদের কথা এখন পরিষ্কারভাবে কানে আসছে। লোকজন উত্তেজিতভাবে চিৎকার করে আমাদেরকে নৌকা তীরে ভিড়াতে নির্দেশ দিচ্ছে। তারা আমাদেরকে ছেলেধরা বলে গালিও দিচ্ছিল। তাৎক্ষনিকভাবে ৩ বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলামনা উত্তেজিত জনতাকে বুঝানোর জন্য নৌকা তীরে ভিড়াবো কি ভিড়াবো না। নাকি নৌকা আরও মাঝ নদীতে নিয়ে যাব।

আমাদের আলোচনা থেকে ইসমাইল মুহুর্তেই বুঝে গেল সে নিজেই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। এতক্ষন যে উৎসাহভরে আমাদের সাথে শাপলা তুলছিল, সে ও আমাদেরকে সত্যি-সত্যি ছেলেধরা মনে করে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। এবার আমরা সত্যি সত্যি বিপদে পড়লাম। যে আমাদেরকে এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারত সে দলবদল করায় আমরা সত্যিই হালছেড়ে দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম নৌকা তীরেই ভিড়াবো।

তারপর যা থাকে কপালে। নৌকা তীরে ভিড়তে না ভিড়তেই কয়েকজন লাফিয়ে আমাদের নৌকায় উঠে আসল। একজন ইসমাইলকে তার মায়ের কোলে তুলে দিল। মায়ের কোলে গিয়ে ইসমাইলের কান্নার আওয়াজ দ্বিগুন হয়ে উঠল। কয়েকজন আমাদের কলার কাঁদিটি লুট করল।

লোকজন সমানে আমাদেরকে গালাগালি করে যাচ্ছিল। আমাদের কোন কথাই তারা শুনছিল না। যত বলি আমরা ছেলেধরা নই, তারা ততই ক্ষেপে যাচ্ছিল। ভাগ্যভাল তারা হাতের লঠিসোঠা দিয়ে আমাদেরকে আক্রমন করছিল না। সম্ভবতঃ আমাদের চেহারা দেখে তাদের সংশয় হচ্ছিল।

হয়ত আমাদের চেহারা ছেলেধরাদের মত ছিলনা। তাই পিঠে লাঠির আঘাত পড়ছিল না। উত্তেজিত জনতা কতটা ভয়ংকর হতে পারে তার কয়েকটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার ছিল। তারা আমাদেরকে বিচারের জন্য তাদের সাথে চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে যেতে চায়। লোক সমাগম বাড়ছিল।

প্রমাদ গুনলাম। এখন এখান থেকে আবার পিছনে ফিরে যেতে হবে। একটা কেলেংকারীতো হল। এবার গ্রামে ফিরে চেয়ারম্যানের কাছে উপস্থিত হয়ে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হবে। আমরা যেতে রাজি হচ্ছিলাম না।

তারা আমাদেরকে নিয়ে যাবেই। না গেলে যদি এবার লাঠিসোটার সদ্যবহার করা শুরু করে ? পরিস্থিতি বিবেচনা করে চেয়ারম্যানের কাছে যাওয়াকেই উত্তম মনে হল। চেয়ারম্যান নিশ্চই এদের মত অবুঝ হবেন না ! উদ্ধার করল বুড়ো কোঁচামারা এক জন। হঠাৎ ভিড়ের মাঝখান থেকে তিনি বলে উঠলেন, আরে সাব আমনে ? (আরে, সাহেব আপনি ?) ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম। আমাদের বাসায় মাছ দিয়ে যায় যে বুড়ো মানুষটি, সেই তিনি।

তাঁকে পুরো ব্যাপারটি সংক্ষেপে খুলে বললাম। তিনি উত্তেজিত জনতাকে বুঝাতে লেগে গেলেন। আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদেরকে তিনি যে চেনেন তা জনতাকে বুঝাতে লাগলেন। মনে হয় কিছুটা কাজ হল।

জনতার মারমুখি ভঙ্গী কিছুটা স্তিমিত হল। তবে তাদের পুর্ববতী দাবী তারা এখনও জানাতে লাগল, তবে কিছুটা ক্ষীনকন্ঠে। বুড়ো মানুষটি অনেক কষ্টে তাদেরকে নিবৃত্ত করাল। তিনি আমাদেরকে বললেন নৌকায় উঠে যেতে। যারা এতক্ষন ডিঙ্গিনৌকাটি দখল করে ছিল তাদেরকে নামিয়ে আমাদেরকে নৌকায় তুলে দিলেন।

আমরা তাঁকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিয়ে নৌকায় উঠে এলাম। এবং নৌকা ছেড়ে দিলাম। ভাগ্যক্রমে সে বুড়ো মানুষটি যদি সেখানে সঠিক সময়ে উপস্থিত না হতেন তাহলে পানি আর কতদুর গড়াত তা ই ছিল ফিরতি পথে এবং পরবর্তী কয়েকদিন আমাদের আলোচনার একমাত্র বিষয়। ঘটনাটি এরচাইতেও অনেক বেশী খারাপ হওয়াটা অসম্ভব ছিলো না। আজ এত বছর পরও সেই ঘটনার স্মৃতি একটুও ভুলিনি।

...................................................................................................... বি:দ্র: পূর্বে এ লেখাটি আমার অন্য নিকে প্রকাশ করা হয়েছিল। অনিবার্যকারনে আমি সেই নিকটি এখন আর ব্যাবহার করছি না। তখন বড় বিলাই , শূণ্য উপত্যকা, রুদ্রপ্রতাপ, জাওয়াদ হাসান, প্রধান ফটোগ্রাফার ,প্রিন্স অফ পারসিয়া এবং নীল ভোমরা কমেন্ট করেছিলেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।