আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকা আমারে যা দিল আর যা কেড়ে নিল--পর্ব---১



গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছি তাও প্রায় এক যুগ। ঢাকার বুকে পা দেয়ার পরই মনে হলো...এ শহর আমার নয়। আমি যেমনটি চেয়েছি কিংবা যেমনটি চাইব বলে ভাবতাম, বাসস্টান্ডে নামার পরই মনে হলো এখানে তা নেই। বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। যেহেতু এটাও জানতাম যে, আমাকে এই ইট পাথরের শহরে থাকতে হবে, উচ্চ শিক্ষা বা ভবিষ্যতে জীবন জীবিকার জন্য লড়াই করতে হবে তাও এই শহরে থেকে, কিংবা এই শহরের মত প্রাণহীন যুদ্ধংদেহি কোন শহরে, সেহেতু বুকে পাথর চাপা দিলাম।

থেকে গেলাম আর টিকে থাকতে প্রাণ লড়াই শুরু করে দিলাম। যাত্রাবাড়ি থেকে লোকাল বাসে উঠার জন্য সেই যে ফাইট শুরু হলো আজো তা চলছে........কত রঙ্গে কত ঢঙ্গে........। কি হারালাম? আমার প্রিয় সবুজ....দিগন্ত প্রসারি ক্ষেত, ফসলের জমি, সবুজ পাতার গাছের সারি। মাসে মাসে রং পাল্টানো ধানের ক্ষেত, সর্ষে ক্ষেতসহ কত রকমের শষ্য ভরা জমিন। ধুলা উড়িয়ে যাওয়া রাস্তা, জমিনের আইল, পুকুর আর পুকুরের ঘাট, বাড়ির সামনে উঠান, পেছনে ডাঙ্গা, আর খেলার জন্য অবারিত মাঠের পর মাঠ।

আমাদের চোখ কোথাও আটকাতো না, আমাদের পা কোথাও থেমে যেতো না। দৌড়াতে দৌড়াতে হয়রান হয়ে যেতাম কিন্তু আমাদের দৌড় থামতো না। দম বন্ধ হতো না। পুকুরে নদীতে সাতার কাটতাম...কিন্তু কুল পেতাম না। গ্রাম জুড়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হেটে বেড়ানো. আহা! কোথায় সে সব এই ঢাকায়।

এখানে চোখ আটকে যায়, দম বন্ধ হয়ে যায়, পা থেমে যায়, বুকে পাথর চেপে আছে দৌড়াতে পারিনা। ঘুম ভাংলেই শুনতাম পাখির ডাক, মোরগের ডাক। সারাদিন বড় জোরে এক দুইটা মোটর গাড়ির শব্দ শুনলেই ধন্য হতো টাইপের জীবন। যদি গ্রামের রাস্তায় কোন মোটর গাড়ির শব্দ শুনতাম দিতাম দৌড়। ইট বা মাটি টানা সেই ট্রলির পিছু পিছু কতদূর চলে যেতাম! কোনভাবে যদি ট্রলিতে উঠতে পারতাম সেটা হতো সেদিনের সেরা গল্প।

প্রায়শ ট্রলির হেলপার একটা লম্বা বেত নিয়ে পিছনে বসে থাকতো ফলে ট্রলিতে উঠা হতোনা। অথচ ঢাকায় এসে দেখি কতনা গাড়ি! শব্দে কান ফেটে যায়। উঠান নেই, বাগান নেই, মাঠ নেই, ক্ষেত নেই, পুকুর নেই, পাখি নেই, সবুজ নেই, কত মানুষ অথচ সেই মানুষের আবার তীব্র অভাব। আমি কি নিজেও মানুষ আছি? জানিনা। এক যুগ পরেও বাড়ি যেতে পারলে শিশুর মত নেচে উঠে আমার মন।

আহা! আবার দেখতে পাব আমার ভাঙ্গা টিনের ঘর, মাটির উঠান, কাঁচা রাস্তা, পানিতে টইটুম্বুর পুকুর, মাঠের পর মাঠ, সবুজ, পাখির ডাক......কত কি!! চার ঘন্টার বাস ভ্রমন শেষে যখনই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রিক্সায় চাপি তখনই এক ধরনের ঘোরে আটকে যাই আমি। ঢাকার শব্দগুলোতে অভ্যস্ত কান হঠাৎ করে গ্রামীণ নির্জনতা যেন নিতে পারেনা। বাতাসের শব্দ, পাখির শব্দ, গাছের পাতার শব্দ সব কিছু মনে হয় অন্য গ্রহের। আমি বিহবল হয়ে পড়ি। রিক্সাওয়ালার (প্রায় সবাই পরিচিত, গ্রামীণ সম্পর্কে ভাই বা চাচা) নানা প্রশ্নে যখন সম্বিত ফিরে আসে তখন বুঝতে পারি আমি আমার আপনালয়ে এসেছি।

অথচ কি শহর কি নির্মম! আমাকে দুইদিন পরেই আবার টেনে নেবে। তার টান আমি উপেক্ষা করার ক্ষমতা রাখিনা। এই শহরই আমাকে জীবন ধারণের জীবিকা দেয়। এবং এমনই সে জীবিকা আমাকে এই শহরেই আমৃত্যু থাকতে হবে। কেননা আমি জীবিকা নির্বাহে এমন কর্মে জড়িত যা আমার গ্রাম দিতে পারেনা।

শহরের সে অনুগ্রহে আমাকে ফিরে আসতে হয়। পুনশ্চঃ শহর আমাকে মৃত্যুর পর আর আশ্রয় দিতে পারবেনা। মৃত্যুর পরে চির জীবনের জন্য ফিরে যাব আমার গ্রামে। তার পর মসজিদের পাশে নির্জন যে কবরস্থান, যেখানে আমার বাবা, দাদা-দাদিসহ অনেক আত্মীয় স্বজন শুয়ে আছে, আমার দিন আসার আগে-পরে আমার মা, ভাই-বোন-বন্ধু-বান্ধব-পাড়া প্রতিবেশিদের অনেকেই হয়ত চির শায়িত হবে, সেখানে আমিও আশ্রয় নেব।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.