আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাসা লোমা- পাহাড়ের দু্র্গ

প্রবাসী

কাসা লোমা কানাডার টোরোন্টো শহরে বেড়াতে এলে সি এন( কানাডা ন্যাশনাল) টাওয়ার দেখবেনই কিন্তু কাসা লোমা না দেখে ফিরে গেলে আপনার বেড়ানো অসম্পুর্ন থেকে যাবে। স্প্যানিস ভাষার কাসা লোমার বাংলা মানে “ পাহাড়ের উপরের দুর্গ” বানিয়েছিলেন এই শহরের একজন ধনাঢ্য ব্যাক্তি স্যার হেনরি মিল পেলাট( Major General Sir Henry Miller Pellat) । স্যার হেনরি ছিলেন একাধারে শিল্পপতি, সামরিক কর্মকর্তা এবং সমাজ সেবক। ১৮৫৯ সালে জন্ম নেন হেনরী। বাবার ব্যবসায়ে রাত দিন খেটে প্রচুর অর্থ সম্পত্তির মালিক হন।

টোরন্টোর বিদ্যুৎ ব্যাবস্থা, খনি এবং অনান্য মিলিয়ে এক সময় ২১ টা শিল্প প্রতিষ্টানের কর্নধার ছিলেন হেনরী। কুইন’স ওন রাইফেল ব্যাটালিয়নে সামরিক বাহিনীতে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন এবং মেজর জেনারেল পদ মর্য্যাদা পর্যন্ত উন্নীত হন। টোরন্টো ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজ, গ্রেস হাসপাতাল,সেণ্ট জন এম্বুলেন্স ব্রিগেড তার সমাজ সেবার সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে আজ ও। হেনরী ১৯০৩ সালে টোরোন্টো শহরের প্রান কেন্দ্রে ২৫ একর জমি কেনেন যার উপর গড়ে তোলেন তার আজীবনের স্বপ্ন মধ্যযুগীয় দুর্গের অনুকরনে তৈরী বাড়ী । বাড়ীর আগের মালিক নাম দিয়েছিলেন “কাসা লোমা”, স্প্যানিশ শব্দ কাসা লোমার অর্থ হল "পাহাডের দূর্গ।

১৯০৫ সালে নাইট উপাধিতে ভুষিত হন হেনরী। ১৯১১ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে ৩০০ লোক কাজ করে বানিয়েছিলেন এই বাড়ী। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে থেমে যায় কাসা লোমার নির্মান কাজ। গথিক স্থাপত্যে নির্মিত এই বাড়ীর নক্সা করেন বন্ধু আর্কিটেক্ট ই জ়ে লেনক্স । তখনকার দিনে এই বাড়ী বানাতে খরচ পড়ে ৩৫ লক্ষ ডলার।

১০ বছরের ও কম সময় এখানে বাস করেছিলেন হেনরী। বিশ্বযুদ্ধ শেষের অর্থনৈতিক মন্দা,উদার হাতেখরচের কারনে ক্রমশঃ দেনার দায়ে জড়িয়ে পড়েন হেনরী। সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করেও সেই দেনা শোধ করতে পারেন নি হেনরী, ১৯২৪ সালে তার প্রিয় বাড়ী কাসা লোমে ছেড়ে চলে যেতে হয় তাকে। তারপর অনেক দিন খালি পড়ে থাকে কাসা লোমা। টোরোন্টো সিটি করপরেশান ট্যাক্সের দায়ে অধিগ্রহন করেন ১৯৩৩ সালে।

স্যার হেনরীর সেই বাড়ী এখন যাদুঘর। সমস্ত বড় শহরের মত টোরন্টোতেও যাদুঘর রয়েছে অনেক গুলো তারই একটা হল কাসা লোমা। স্যার হেনরী চেয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর কাসা লোমা কে সামরিক যাদুঘর এ পরিনত করতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুয়াদ্ধ কালীন সময়ে তার এই বাড়ী ব্যবহৃত হয় মিত্রবাহিনীর দফতর হিসেবে যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালীন সময়ে অনেক সামরিক পরিকল্পনা করা হয়। কাসা লোমার অবস্থান ডাউনটাউনে বা শহরের কেন্দ্রে।

শনি এবং রবিবার এ দেশে ছুটি। টোরোণ্টো পাবলিক লাইব্রেরী তে শনিবার সকালে লাইনে দাড়ালাম টিকেটের জন্য। শনিবার সকালে “আগে আসিলে আগে পাইবেন” ভিত্তিতে বিনা মুল্যে মেম্বাররা টিকেট পান। কাসা লোমা খোলা থাকে সব দিন, সারা বছর,শুধুমাত্র ২৫শে ডিসেম্বর ছাড়া। অতপরঃ রবিবার সকালে কাসা লোমা অভিযান।

পাতাল রেল স্টেশান এর নাম ডুপন্ট। স্টেশান থেকে ৪/৫শ’ গজ হেটে পৌছলাম কাসা লোমা তে। অনেকটা উচুতেই উঠতে হল। বাসে গেলে কাসা লোমার পাশেই যাওয়া যেত। ঐ শীতের রবিবারে ও সারা টোরোন্টো বরফে ঢাকা।

শুধু মাত্র রাস্তা গুলো বরফমুক্ত যানবাহন চলাচলের জন্য। সকাল ১০টার দিকে পৌছে কিছুটা দমে গেলাম। ঢোকার গেটেই একটা কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হল লেখা “ চলচ্চিত্র নির্মানের কারনে কোন কোন যায়গা দর্শনার্থিদের জন্য বন্ধ”। ২০০টার ও বেশী নামি দামী সিনেমা চিত্রায়িত হয়েছে এখানে। যাই হোক রিসিপসান কাউনটারে মিলল টেপ রেকর্ডার অনেকটা মোবাইল ফোন আকারের ।

অধিকাংশ দর্শনার্থীর কানে এ গুলো দেখে গোড়াতে কিছুটা খটকা লেগেছিলো যাদুঘরের ভিতরে সবাই এত টেলিফোন করছে কেন? ইজরাইলে তৈরী যন্ত্রগুলো আমার দেখা প্রথম কোন ইসরাইলে তৈরি জিনিস। যাদুঘরের সমস্ত জিনিসে রয়েছে নাম্বার অঙ্কিত, যন্ত্রে ঐ নাম্বার টাইপ করে অন বাটন টিপলেই আদ্যোপান্ত ইতিহাস শোনা যায়। ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদে বেড়াতে গিয়ে চোখে পড়েছিলো এই ব্যাবস্থা আজ থেকে ১০/১২ বছর আগে। চারতলার এই বাড়ীতে রয়েছে ৯৮ টা কক্ষ, প্রায় ১লক্ষ ৭০ হাজার বর্গফুট বা প্রায় ১৭ হাজার বর্গ মিটার ফ্লোর স্পেস । গেট দিয়ে ঢুকলেই প্রথমে গ্রান্ড হল।

৬০ ফুট উচু গ্রান্ডহল, বিলিয়ার্ড রুম, শোবার ঘর,স্মোক রুম, লাইব্রেরী, ডাইনিং রুম, ইত্যাদি রয়েছে প্রথম তলায়। পাশের সিনেমা হলের সমান রুমে চলছে কাসা লোমার উপর নির্মিত সিনেমা। বেসমেন্টে রয়েছে রেস্তোরা, গিফট শপ, মদঘর বা “ওয়াইন সেলার” ইত্যাদি। এই ওয়াইন সেলারে রয়েছে ১৮০০ বোতল মদ রাখার ব্যাবস্থা। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে “স্টাডি রুম” গেস্ট রুম, লেডী পেলাট এবং গার্ল গাইডের যাদুঘর ইত্যাদি।

তৃতীয় তলায় রয়েছে পেলাট যে সামরিক বাহিনীতে কাজ করতেন সেই “কুইন’স ওন রাইফেল (Queens own Rifle) ব্যাটালিয়ন” এর সামরিক যাদুঘর। এই যাদুঘরেই চোখে পড়লো এনফিল্ড রাইফেল, লুইস মেসিন গান এবং ব্রেন গান। এই সেই এনফিল্ড রাইফেল যার কার্তুজে শুওরের এবং গরুর চর্বি থাকার গুজব থেকে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুত্রপাত। কবি নজরুলের লেখা ‘ব্যাথার দান” বইয়ের প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের অংশ বিশেষে পড়েছিলাম্ লুইস মেসিন গান, ব্রেন গান এর কথা। বাড়ীর দু দিকে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার।

সিড়ীর পর সিড়ী পেরিয়ে ১৫ তলা সমান উচু টাওয়ারে উঠতে হাপিয়ে গেলাম কিছুটা। টাওয়ারের চারপাশের জানালায় চোখ রাখলে চারদিকের টোরন্টো শহর খুব ভালভাবে দেখা যায়। এরপর গেলাম প্রায় ৮০০ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে স্যার হেনরীর আস্তাবল, শিকার ঘর এবং গ্যারাজ ঘর। সময় কত দ্রুত যে কেটে গেল বুঝতে পারি নি। ঘড়িতে ততক্ষনে বারোটার বেশী।

এত বড়, শান শওকতের মধ্যযুগীয় দুর্গের অনুকরনে তৈরী ব্যাক্তিগত বাড়ী খুব কম ই চোখে পড়ে। বেরিয়ে এলাম কাসা লোমা থেকে। কাসা লোমার বিশাল বাগান দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি। কারন শীতের দিনে বরফে ঢাকা, পাতা ছাড়া গাছের বাগান দেখার মত কিছু নয়। বাড়ীর স্থাপত্য, সুড়ঙ্গ, গুপ্তঘর আসবাবপত্র দেখতে দেখতে হাঁরিয়ে গিয়েছিলাম মধ্যযুগের নাইটদের দিনে।

এক দিনের চমৎকার অভিজ্ঞতা সুখস্মৃতি হয়ে থাকবে আজীবন সবার কাছেই যারা কাসা লোমাতে বেড়িয়ে যাবেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।