আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রানাডা ট্রাজেডী : এক আত্ম বিস্মৃত জাতির করুণ ইতিহাস

good

দুনিযা়য় অনেক জাতির উত্থান পতন কাহিনী লুকিযে় আছে ইতিহাসের পাতায় কিন্তু স্পেনকে যারা জয় করেছিল তাদের পতনের কাহিনীর চাইতে করুণ কাহিনী আজো রচিত হয়নি। অষ্টম শতকের শেষ দিকে ভূমধ্যসাগর পাডি় দিযে় স্পেনের মাটিতে পা রাখেন উমাইযা় সালতানাতের বীর সেনাপতি তারিক বিন জিযা়দ। সাগর তীরে পা রেখেই জ্বালিযে় দেন ফিরে যাওযা়র একমাত্র অবলম্বন জাহাজগুলো, সৈন্যদেরকে বলেছিলেন, ‘বন্ধুগণ, পিছনের দিকে ফিরে যাওযা়র কথা ভুলে যাও, হয় স্পেনের আকাশে ইসলামের পতাকা দুলবে না হয় এ মাটিতে হবে তোমাদের সমিলল সমাধি। ’ বিজযে়র সূচনা তখন থেকেই, খ্রীষ্টান রাজা রডারিকের সেনাপতি থিওডেমিরকে পরাজিত করে তারিক বাহিনী এগিযে় যায় সম্মুখের দিকে। প্রায় আটশত বছরের মুসলমানরা স্পেনের মাটিতে ইসলামের বিজয় নিশান উডি়যে়ছে অসংখ্য ঘটনায় পরিপূর্ণ এই ইতিহাস।

উমাইযা়দের পরাক্রমশালী শাসকবর্গ ঘামঝরা শ্রম আর রক্তভেজা পরিশ্রম দিযে় রঙের পরশ বুলিযে়ছে সে ইতিহাসে। রোম উপসাগরের উন্মুক্ত তরঙ্গমালার গতি স্তব্ধ করে দিযে়ছিল এ জাতির ঐতিহ্য। মুসলমানদের সুদৃঢ় ইচ্ছার সামনে পিরনিজের সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ অবণত হযে়ছিল দীর্ঘ একটি সময়। কিন্তু কালের আবর্তে তারাই আবার বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীডি়ত মানবতার অশ্রু দিযে় লিখেছে ইতিহাসের উল্টো পিঠ। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যাতা, সংস্কৃতির যেই ছোট চারাগাছটি তারিক, মুসা আর আব্দুর রহমানের পরশে পরিণত হযে়ছিল বিশাল বটবৃক্ষে মৌসুমী হাওযা়র দাপটে উপডে় পড়ল সেই গাছটি।

সভ্যতার সেই গাছটি আজ ধ্বংসপ্রায়। ঝডে়র বেগে মুসলমানরা প্রবেশ করেছিল স্পেনে, মুক্তির অপার আনন্দে স্পেনের অধিবাসীরা আরবের সেনাপতিদের হাতে তুলে দিযে়ছিল নিজেদের অস্ত্র। বখতিযা়রের আগমনে ভারতবাসীরা যেভাবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল ঠিক তেমনিভাবে স্পেনের অধিবাসীরাও খ্রীষ্টান রাজাদের অত্যাচার, নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য আরবের গ্রহণ করেছিল মুক্তির দূত হিসেবে। যার অধিবাসীরা ছিল মূর্খতার বেডা়জালে বন্দী, ওষ্ঠাগত ছিল যাদের প্রাণ তারাই এগিযে় এলো আলোর মশাল হাতে। স্পেনের প্রতিটি ঘরে ঘরে যখন জ্বলছিল জ্ঞানের অনির্বাণ দ্বীপশিখা ইউরোপ তখন পশুত্ব আর বর্বরতার আঁধারে নিমজ্জিত।

ইউরোপের অধিকাংশ মানুষ যখন পশুর চামডা়য় লজ্জা নিবারণ করত। রাত্রিযাপন করত গর্তে আর জঙ্গলে, স্পেন তখন বিজ্ঞান আর শিল্পকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছে দিচ্ছিল। ইউরোপে যখন অক্ষরজ্ঞান সম্পন্নদের হাতে গোনা যেত, স্পেন তখন এমন মানুষ খুঁজে পাওযা় যেত না যার ঘরে গ্রন্থাগার নেই। এ হচ্ছে সেই স্পেন যা ছিল আরবদের আন্দালুস। যার শান শওকত আজো কিংবদন্তী হযে় আছে।

এই সেই জাবাল উত তারেক যেখানে নোঙর করা ছিল তারিক বিন জিযা়দের জাহাজ। এই তো কর্ডোভা তৃতীয় আব্দুর রহমানের দরবার এখানে এসে থমকে যেত দুনিযা়র বড় বড় রাজদূত। যে মহান জাতি ঘাম ঝডা় শ্রম দিযে় এর মাটিতে এনেছে জীবন, খুনের ফোযা়রায় একে করেছিল সৌন্দর্যমন্ডিত। যাদের কারণে স্পেন হযে়ছিল আলোকবর্তিকা, আজ তারা নেই এ বিরাণভূমির নিচে তাদের মরণদেহ শুযে় আছে নিশ্চুপ। হিজরী পঞ্চম শতকে উমাইযা়দের পতন যুগ।

প্রায় বিশটি ছোট ছোট অংশে বিভক্ত হযে়ছিল স্পেন। আর এই বিভক্তিকে কাজে লাগিযে় পঞ্চম ফার্ডিনান্ড স্পেনের উত্তর সীমান্তে ছোট ছোট খ্রীষ্টান রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে উসরিযা়, লিসবন এবং কার্ডিজ নিযে় গঠন করে একক রাষ্ট্র। আস্তে আস্তে শক্তি সঞ্চয় করে তারা। আক্রমণ করে দখল করে নেয় কর্ডোভা, সেভিল ব্যালেনসিযা়। পরাজিত হয় মুসলিম শক্তি।

মুসলমান শাসকদের ভোগবিলাস, ভাতৃঘাতী যুদ্ধ, আত্মকলহ, আরবীয়, স্পেন এবং আরবীয়দের আঞ্চলিক কলহ মুসলমানদের ঐক্যের বন্ধনকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করেছিল। আর এই অনৈক্য ও বিভেদের দযা়লকে কাজে লাগালো খ্রীষ্টান শক্তি। পরাজিত এলাকাগুলোতে শুরু হয় তাদের নির্যাতনের স্টিমরোলার। পার্শ্ববর্তী প্রাচ্য রাজ্যের রানী ইসাবেলাকে বিযে় করে শক্তি বৃদ্ধি করে কার্ডিনাল। চলে মুসলমানদের উপর নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন।

একেক করে অন্য সকল রাজ্যে বন্ধ করে দেযা় হয় আযান। মসজিদ ভেঙ্গে তৈরি করা হয় গির্জা। মুসলমানদের জোর করে খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে। মুসলমানদের সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেযা় হয়। মুসলমানদের সন্তানদের খ্রিষ্টান স্কুলে ভর্তি করতে বাধ্য করা হয়।

উপায় না দেখে পরাজিত এলাকা থেকে মরক্কো এবং আরজেরিযা়তে চলে যায় অনেক মুসলমান। এইসব কিছুর মধ্যে টিম টিম করে ইসলামের প্রদীপ জ্বলতে থাকে গ্রানাডায় সব শেষ সুলতান আবুল হাসানের নেতৃত্বে। শেষ ভরসাস্থল হিসেবে আশায় বুক বাধে নিপীডি়ত মুসলিম জাতি। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি সাধে আবু দাউদ নামক কিছু গাদ্দার। আবুল হাসান প্রকাশ্যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও ঘাপটি মেরে থাকা এসব মুনাফিকদের চিহ্নিত করতে পারেনি।

যারা ইজ্জতের মৃত্যুর চাইতে জিল্লতির জীবন বরণ করে নিযে়ছে। গ্রানাডা থেকে বের হযে় সুলতান আবুল হাসান যখন লোশাসেভিল এবং কর্ডোভাকে মুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মুসলমানরা যখন আবার নতুন করে সেইসব রাজ্যে ইসলামের পতাকা উড্ডয়নের স্বপ্ন দেখছে। ঠিক তখন বদনসিব মিল্লাতের কুলাঙ্গার আবুল হাসানের সন্তান গাদ্দারদের কুমন্ত্রণায় প্ররোচিত হযে় পিতার অবর্তমানে নিজকে সুলতান ঘোষণা করেন। পুনরায় আবার শুরু হয় আরব, বারবারি স্পেনীয়দের অন্তকলহ।

মুসলমানদের যে শক্তিটুকু ব্যবহার হচ্ছিল খ্রীষ্টানদের নির্যাতনের হাতকে মিল্লাত মুক্ত করার কাজে তা তখন ক্ষমতালোভী আবু আব্দুল্লাহ এবং জাতির বেঈমান আবু দাঊদের কারণে এক পর্যাযে় লিপ্ত হয় পিতা পুত্রের, ভাতৃঘাতি যুদ্ধের। আর এই সুযোগটি কাজে লাগায় খ্রীষ্টান রাজা ফার্ডিনান্ড। কর্ডোভা থেকে অসংখ্য ফৌজ নিযে় মুসলমানদের সর্বশেষ প্রতিরক্ষা দুর্গে চূডা়ন্ত আঘাত হানার প্রস্তুতি নেয়। গ্রানাডা অবরোধ করে সম্মুখে হামলা করে। ততক্ষণে আবু আব্দুল্লাহ বুঝতে পারে খ্রীষ্টান এবং গাদ্দারদের ষড়যন্ত্র।

কিন্তু সময় অনেক পেরিযে় গেছে। ভেঙ্গে গেছে প্রতিরোধের শক্তি। পরাজয় এবং লাঞ্চনার জীবন ছাডা় আর কিছুই তার সামনে নেই অল্প কিছু জোযা়ন তখনও গ্রানাডার ভিতর থেকে জিন্দেগীর আজাদী এবং ইজ্জত রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, দীর্ঘ সময় অবরোধের এবং সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে যখন গ্রানাডার সর্বশেষ শক্তিটুকুও কোনভাবে পরাজিত করতে পারছে না তখন ফার্ডিনান্ড আশ্রয় নেয় কূট কৌশলের, আহ্বান করে সন্ধি-চুক্তির। মুসলমানদের মধ্যে এমন কিছু ঈমাম তারা তৈরি করে যারা ওই ফতোযা় দেন যে খ্রীষ্টানদের সাথে এই যুদ্ধ আত্মহত্যার সামিল। সুতরাং সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে অনুকম্পা নিযে় বেঁচে থাকই উত্তম।

অবশেষে কালের আবর্তে উপনীত হল সেই ক্ষণ যার ইতিহাস মুসলমানদের রক্তে লেখা হযে়ছিল ১৪৯২ সালের ১লা এপ্রিল খুলে দেযা় হল গ্রানাডার ফটক যেই চুক্তিকে গ্রানাডাবাসী মনে করেছিল সম্মান এবং নিরাপত্তার জামিন। সেটি হল স্পেনে মুসলমান সভ্যতার কফিনের শেষ পেরেক। খ্রীষ্টান রাজা গ্রানাডা প্রবেশ করে ঘোষণা দিল অস্ত্র ছেডে় দিযে় যারা মসজিদ এবং গির্জায় আশ্রয় নেবে তাদেরকে ক্ষমা করে দেযা় হবে। অসহায় মুসলমানরা তার কথাকে মেনে নিযে় যখন আশ্রয় নিল মসজিদে ইতিহাসের নির্মম অধ্যায় রচনা করল খ্রীষ্টানরা। মসজিদের বাইরে তালা লাগিযে় হাজার হাজার মুসলমান পুরুষ, নারী, শিশু-বৃদ্ধকে বাইরে থেকে আগুন লাগিযে় শেষ করে দিল।

মুসলমানদের আত্মচিৎকারে যখন গ্রানাডার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করেছিল ঠিক তখন রাজা ফার্ডিনান্ড এবং তার রাণী ইসলাবেলা ক্রুর হাসি আর উল্লাস করেছিল মুসলমানদের লাশের উপর দাঁডি়যে়। তারা উদযাপন করেছিল এপ্রিল ফুল। এভাবে সমাপ্ত হল স্পেন সহ সমগ্র ইউরোপ এবং আফ্রিকায় মুসলমানদের জ্ঞান, বিজ্ঞান, সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, চিকিৎসার গৌরবজ্জল আটশত বছরের সোনালী যুগ। রচিত হল আত্ম বিস্মৃত জাতির পরাজযে়র করুণ ইতিহাস। Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।