আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আন্দ্রেই তারকোভস্কি: কাব্যিক অর্ন্তদৃষ্টির অধিকারী এক ফিল্মমেকার

বুকের ভেতর বহু দূরের পথ...
“দ্বিতীয় কোন তীর সংগ্রহে রাখতে নেই। দ্বিতীয় তীর হাতে রাখলে প্রথমটির ব্যাপারে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। সবসময় মনে রাখতে হবে হাতে সুযোগ কেবল একটা। ব্যস ঐ একটা তীর দিয়েই লক্ষ্যভেদ করতে হবে। ” জীবনটাকে এভাবেই দেখতেন তিনি।

আর জীবনের খুঁটিনাঁটি বিশ্লেষণের জন্য ক্যামেরাকে তুলে নিয়েছিলেন হাতিয়ার হিসেবে । চলচ্চিত্র যার কাছে রুটিরুজির কর্মের চেয়ে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে অনেক বেশি মূল্যায়িত। তিনি রুশ চলচ্চিত্র তথা সমগ্র বিশ্ব চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী - আন্দ্রেই তারকোভস্কি। বিশ্ব চলচ্চিত্রের আরেক দিকপাল ইঙ্গমার বার্গম্যানের কাছে তারকোভস্কি ফেলেনি, বুনুয়েল ও কুরুসুয়ার মতই বিরল স্বপ্নদ্রষ্টা ও কাব্যিক অর্ন্তদৃষ্টির অধিকারী ফিল্মমেকার। ‘‘চলচ্চিত্রের ভাষা পাল্টে দেয়া সবচেয়ে সফল নির্মাতার নাম আন্দ্রেই তারকোভস্কি।

তিনি এমন একজন ফিল্মমেকার যিনি জীবনকে স্বপ্নের মত কল্পনাসমৃদ্ধ কাব্যিক রূপ দিয়ে ক্যামেরা বন্দী করেছেন। আমার কাছে তাই তারকোভস্কির স্থান সবার উপরে। ” বার্গম্যানের স্বীকারোক্তি। তারকোভস্কির মতে সিনেমার গূঢ় বৈশিষ্ট্য নিহিত কালচেতনায়। তাই সংকট, সমস্যা ও বিরোধের যুগে তিনি হেঁটেছেন সাম্যের পথে, বিপ্লবী চেতনায় আর জীবনবোধের উন্মেষণে।

শিল্পের উৎকর্ষের ব্যাপারে আপোষহীন তারকোভস্কির নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা মাত্র সাতটি। সেগুলো হলো- ইভান’স চাইল্ডহুড (১৯৬২), আন্দ্রেই রুবলেভ (১৯৬৬), সোলারিস (১৯৭২), দি মিরর (১৯৭৫), স্টকার (১৯৭৯), নস্টাজিয়া (১৯৮৩) ও দি সেক্রিফাইস (১৯৮৬)। তারকোভস্কি নির্মিত একমাত্র প্রামাণ্যচিত্র ভয়েজ ইন টাইম (১৯৮২) ইতালি থেকে প্রযোজনা করা হয়। এছাড়া ফিল্ম স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি দি কিলার (১৯৫৬), দেয়ার উইল বি নো লিভ টুডে (১৯৫৯) ও দি স্টিমরোলার এন্ড ভায়োলিন (১৯৬১) নামে তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মান করেন। এত অল্পসংখ্যক চলচ্চিত্র তৈরি করলেও তার প্রত্যেকটি সৃষ্টি সত্য ও সুন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে এক একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।

তাঁর প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র ইভান’স চাইল্ডহুডে দশ বছর বয়সী এক বালকের চোখ দিয়ে আমরা দেখতে পাই যুদ্ধের উন্মত্ততা ও মনুষ্যত্ব ধ্বংসের উল্লাস। আর তাঁর দি মিরর চলচ্চিত্রে কালচেতনার চেয়ে বেশি গভীর ইতিহাসচেতনা চোখে পড়ে । অপরদিকে আন্দ্রেই রুবলেভ একাধারে যেমন কাহিনীচিত্র তেমনি ঐতিহাসিকচিত্র। গভীর জীবনবোধের প্রকাশ যেখানে একইসঙ্গে আধ্যাত্মিক ও তাত্ত্বিক। তারকোভস্কি সোলারিস ও স্টকার এর মত কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন যার সময়কাল কাল্পনিক কোন ভবিষ্যতে হলেও সমকালীন নৈতিক সমস্যা ও প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলেছে।

তার অন্যান্য চলচ্চিত্রের মতই এ দুটি ছবিতেও রূপকার্থে উঠে এসেছে মাবজীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্যে নিয়ে চিরন্তন দার্শনিক জিজ্ঞাসা। তাঁর শেষ দু’টি চলচ্চিত্র নস্টালজিয়া ও দি সেক্রিফাইস বিদেশের মাটিতে নির্মিত। একটি ইতালিতে অপরটি সুইডেনে। আর এ দুটি চলচ্চিত্রে তিনি ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। মৃত্যু এ চলচ্চিত্রগুলোতে উঠে এসেছিলো বারবার।

চলচ্চিত্রে প্রথাবিরোধী মনোভাব তারকোভস্কিকে বারবার ঠেলে দিয়োছিলো বিপদের মুখে। বাস্তব ও বাস্তবাতীত, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা, বিশ্বজগৎ ও মনোজগত এসব কিছুর সমন্বয়ে তারকোভস্কি এমন এক প্রতিভার নাম যার সৃষ্টির মমার্থ ও তাৎপর্য তৎকালীন সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। তাঁর বহু ছবির প্রস্তাব কর্তৃপক্ষ বাতিল করে দেয়। দস্তয়ভস্কির দি ইডিয়ট যার মধ্যে অন্যতম। তাই শেষ দিকে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ভিনদেশে।

কিন্তুচিন্তা-চেতনা, মেধা-মননে পাশ্চাত্যের সঙ্গে তারকোভস্কির ছিলো বিস্তর ফারাক। কোন মাপকাঠি দিয়েই এ কিংবদন্তী সুলভ প্রতিভাকে বিচার করা সম্ভব ছিলোনা। সৃষ্টিময় এ জীবনে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব, কান চলচ্চিত্র উৎসব প্রভৃতি বিভিন্ন সম্মানজনক আসরে তিনি পুরস্কার লাভ করেন । ১৯৮৬ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ফুসফুসের ক্যান্সার জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন অসম্ভব মেধাবী এ চলচ্চিত্রকার । মৃত্যু তাঁর সময়কে থামিয়ে দিলেও কালসচেতন তারকোভস্কি কালকে অতিক্রম করেছিলেন তাঁর অসাধারন সব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।

তিনি বিশ্বাস করতেন, “শিল্প সৃষ্টির মানেই তো মৃত্যুকে অস্বীকার করা। অতএব শিল্পী আশাবাদী, যদিও চূড়ান্ত অর্থে শিল্প মাত্রই ট্র্যাজিক। ” তারকোভস্কি ১৯৩২ সালে রাশিয়ার জাবরাঝি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আজ ৪ এপ্রিল বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই ঋত্বিকের ৭৯তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর প্রতি রইলো শ্রদ্ধাঞ্জলী।

# (তথ্যসূত্র: আইএমডিবি, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট এবং দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা) *** আমার মুভিবিষয়ক যত পোস্ট ***
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।