আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক পৃষ্ঠার গল্প: রাঙ্গা মিয়া

শুদ্ধতার আগুনে যেন সতত পুড়ি বাকেরের পাতানো বোন নুরির কোঠায় কিছুদিন ধরেই যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে রাঙ্গা মিয়া। এ নিয়ে কিছুটা রাগারাগিও হয়ে গেছে তার সঙ্গে। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে নুরি একবার ঘুরে যাওয়ার সময় বাকেরকে বলেছিল, তুই চিল্লাইস না আজাইরা। তারপর সে, রাঙ্গার দিকে ফিরে বলেছিল, আমি কি ট্যাকার লাইগ্যা তরে বাইন্ধা রাখছিলাম কোনোদিন? বলতে বলতে চলে গেলেও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এসেছিল সে, দুটো মাঝারি আকারের প্লাস্টিকের বোতল হাতে। কিছুটা দূর থেকে তাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিল, নে, বিনা পয়সায় দিলাম।

তারপরই দুজন প্রায় হামলে পড়েছিল যার যার বোতলের দিকে। বোতলটা মুখের ওপর উপুড় করে ধরে রাঙ্গা মিয়া খানিকটা রাগত চোখে তাকায় পাশে ঝিমুতে থাকা বাকেরের দিকে। তারপর যেন দুনিয়া ভেঙে ফেলবে এমন ভঙ্গিতে বলে, কিরে হালার পো হালা, আমার বতলের মাল চুরি করছস নাকি? এত তরাতরি শেষ হইল কেমতে? বাকের নিজের খালি করে একটা হেচকি তুলে বলল, আরে তার ছিঁড়া আমার ভইনেরে ছাড়নের পরে দেখি তর তার-তুরও সব হারাইয়াই গেছে লাগে! রাঙ্গা মিয়া হাসে। এবার বোতলটাকেই ঊপুড় করে ধরে মুখের ওপর। এক দু ফোঁটা তরল জিভে পড়ে কি পড়ে না।

সে ঠোঁট চাটে বার কয়েক। কী মনে করে খড়ের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বলে আবার, কিছু হইলেই তর ভইনের বিষয় টাইন্যা আনস, পাইছস কি? তর ভইনের মার্কেট কি এমনে বাড়াইতে পারবি? আমি আর যাই না দেইখ্যা কি আর কাস্টমার নাই এই গলির ভিত্রে? বাকের কিছুক্ষণ ভাবে মনে হয়। একবার শুয়ে পড়ে ফের উঠে পড়ে। হোন রে হমুন্দি, আর কেউ যদি না জিগায় ভইনেরে আমরা কয়জন জিগামুই। মনে করিস না ভইনের কেউ নাই।

-হ হইছে। ভইনও পাতাবি আবার দালালিও করবি। নটিগো দালালরে কি কয় জানস, কয় ভেড়ুয়া। ভেড়ুয়ারা কারো বাপ-ভাই হয় না। তারা ভেড়ুয়া থাইক্যাই মরে।

তোরা কয়জনও এমনেই থাকবি দুনিয়ায়। -বুঝছি। এত ক্যার ক্যার করিস না। বিয়া তো কপালে জুটে নাই এর লাইগ্যাই। ট্রাক থামাইয়া পইড়া থাকস এহানেই।

-কী করমু ক? তুই কইয়া দে! -ভইনেরে বিয়া কইরা বাইত্যে নিয়া যা। -তাইলে তুই বাইত্যে গিয়া থাকতে পারবি, নাকি? -তুই কি আমারে চোট্টা-বদমাইশ মনে করস? আরে দৌলদিয়া ঘাট যদি না থাকতো তাইলে কি আমি এই জাগা চিনতাম? আর বাপের ট্রাকে হেল্পারি করতে করতেই না এই পথে আইয়া পড়ছি। আমি ভালা বংশের পোলা মনে রাখিস। -দেখি তো তগ বংশের নমুনা। -এই বংশ তুইল্যা কথা কইবি না রাঙ্গা।

বাপের নাম-ধাম না থাকতে পারে, আমি অখন তিনটা গাড়ির মালিক। সুযুগ পাইলে কইলাম রাস্তায় ডলা দিয়া দিমু! বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় বাকের। কিন্তু দু পায়ে দেহের ভারসাম্য রাখতে না পেরে ফের বসে পড়ে বলে, আমারে চ্যাতাবি না কইয়া দিতাছি। রাঙ্গা বাকেরের আস্ফালন দেখে হাসে। হাসতে হাসতে বলে, রাস্তা তো তর নাম-ধাম ছাড়া বাপের না, যেখানে আমারে ডাইক্যা নিয়া ট্রাক দিয়া ডলা দিবি।

-ডাইক্যা না নিলে তরে কি পাওয়া যায়? -হ, এইডাই কথা। আগের বার যেদিন আমি তর ভনের ঘরে যামু না ঠিক করছিলাম, তুই তো ডাইক্যা নিছিলি, হেই ফাঁকে তর ভইন আইয়া খোমাটা দেখাইয়া গেল। -আমার ভইনেরে অপমান করতাছস নাকি? -চুপ কর ভেড়ুয়া। ক্রিমির বীজের মতন দেখি তরে চিরতা খাইয়া থামানি যায় না! ঠিক তখনই একটু হালকা ছোটাছুটির শব্দ এলেও তারা দুজন কোনো গা করে না। রাঙ্গা চিত হয়ে শুয়ে পেটের ওপর দু হাতে তবলার মত আঙুল নাচাতে নাচাতে গান গায়।

বাকের হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা এগিয়ে এসে রাঙ্গাকে বলে, কান্দিস না তুই, ভইনের কোঠা খালি আছে কিনা দেইখ্যা আইতাছি। কিন্তু উঠতে গিয়েও বাকের টাল খেয়ে পড়ে যায় খড়ের ওপর। অন্ধকারে কিছু খুঁজবার ভঙ্গিতে হাতড়ায় আর বিড়বিড় করে কিছু বলতে থাকে। অন্যদিকে রাঙ্গা গান থামিয়ে উঠে বসে মাথা ঝাঁকায় বার কয়েক। আর তখনই তার মনে হয় পুরো দেহে যেন নোংরা কিছু লেগে আছে।

বিকৃত মুখে সে হালকা পদক্ষেপে বেরিয়ে আসে দৌলদিয়া ফেরিঘাটের দিকে যাওয়ার প্রশস্ত রাস্তাটির ওপর। আশপাশে অসংখ্য ট্রাক থেমে আছে। কোনোটা খালি আবার কোনোটা বা মাল বোঝাই। চোখ কচলে রাঙ্গা একবার তাকায় থেমে থাকা ট্রাকগুলোর দিকে। চিনতে চেষ্টা করে নিজের ট্রাকটি।

তখনই দূর থেকে তার হেল্পার বাচ্চু তাকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসে, ওস্তাদ, আপনে এত দেরি করলেন ক্যান, আপনের সিরিয়াল পার হইয়া গেছে অনেক আগেই। -সিরিয়াল গেলে যাউক। আবার আইবো। কাইলকা, পরশু, তার বাদে, আইতেই থাকবো। কোনো একটা ধরলেই হইলো।

আমার গাড়ি তো খাইল্যা। -না ওস্তাদ। তরমুজের চালান। এখনও সময় আছে, সিরিয়াল ধরতে পারবেন। ফেরিতে আমি উঠামু গাড়ি।

-যা, উঠাইয়া দে। আমি আইতাছি। বলতে বলতেই পথের ওপর হড়হড় করে বমি করে রাঙ্গা মিয়া। আর সঙ্গে সঙ্গেই যেন তার তন্দ্রা ছুটে যায়। সে তাকিয়ে থাকে অগনিত ট্রাকের দিকে।

কিন্তু তবু যেন একবার মনে হলো, বাকেরের ভইন নুরির গোলাপী আঁচলটা হাওয়ায় দুলে উঠল অকস্মাৎ। --------------------- ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।