আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চন্দনের দ্বীপে (হংকং)



আঁধার থাকতেই প্লেন নামল ল্যান্টাও দ্বীপে। আমরা যাব আরো পুবে। মোবাইল কম্যুনিকেশন মেলার কর্তারা আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে। ইচ্ছে আছে ইচ্ছেমতো ঘুরব। হোটেলে যেতে যেতে ভোর হয়ে এল।

লাল আলোয় হংকং আর ওপারের কাউলুন দেখলাম। হোটেলটি দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর, পুরো শহরটাই তাই। ছোট-বড় জাহাজ আর ফেরির ছুটে চলা দেখতে ভালোই লাগছে। কনভেনশন সেন্টারে মেলার আনুষ্ঠানিকতা সেরে দুপুর নাগাদ হোটেলে ফিরে এলাম। সাগর পাড়ের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার আয়োজন হয়েছে_চিংড়ি আর হাঁস।

চীনা কায়দায় রান্না আধাসেদ্ধ। ওয়েটারকে পুরো সেদ্ধ করে আনতে বললে সানন্দে রাজি হলো। ভরপেট খেয়ে শহর দেখতে বেরোলাম। হাঁটার আলাদা রাস্তা আছে শহরে_গাড়ি নিচে, মানুষ উপরে। বড় বড় দালানগুলো এই পায়ে চলা পথের সঙ্গেই।

হংকংয়ে চলে বাস, ট্রেন, মেট্রো, ট্রাম আর ট্যাঙ্। ি লাল, নীল ও সবুজ রঙের ট্যাঙ্ িআছে। লাল ট্যাঙ্ িসবখানে যেতে পারে, নীল ট্যাঙ্ িচলে গ্রামের পথে আর সবুজ শুধু ল্যান্টাও দ্বীপে। ওপরের শহরটা একটু পুরনো। বাড়িগুলো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে।

রাস্তাগুলো সরু, চলাচল একদিকে। মূল ভূখণ্ড কাউলুনের পুব দিকের পাহাড়ের পাদদেশে ১৮৪০ সালে এই বসতি গড়ে উঠেছিল। বসতি বেশি ঘন হয়ে যাওয়ায় সরকার লোকজন সরিয়ে বেশ কিছু জায়গা খালি করে ফেলে, গড়ে তোলে পার্ক_যার নাম ওয়ালড সিটি বা দেয়ালের শহর। রাতের খাবার হবে এলাহি। ব্যবস্থা করেছে সিমেন্স কম্পানি।

ঘুরেফিরে রেস্টুরেন্টে যেতে একটু দেরিই হয়ে গেল। দেখি এক কোণে বসে আছেন ভবিষ্যৎ বক্তা বা ফরচুন টেলার। সামনে গিয়ে হাত মেলে ধরলাম। রংবেরংয়ের সব ছবি সামনে ধরলেন। একটা তুললাম।

তিনি বললেন, অসুবিধা নেই, চলেফিরে খেতে পারব। আরেক কোণে আছেন ছায়াশিল্পী। কাগজ কেটে অবিকল মুখাবয়ব তৈরি করে দেন। কিছুক্ষণ পরে শুরু হলো চীনের ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য_যা ক্যান্টনিজ নৃত্য নামে খ্যাত। শিল্পীদের পোশাক রংচঙে, মুখে মুখোশ_ড্রাগন বা সিংহের।

সকাল ৮টায় ট্যুরিস্ট গাইড এল। কোস্টারে উঠিয়ে নিয়ে বলতে থাকল, হংকংয়ে দ্বীপ আছে ১০০টির বেশি। বড় দুটি ল্যান্টাও আর হংকং। ১৮৪২ সালে ব্রিটিশ সামরিক শাসনের অধীনে চলে যায়, আগে ছিল চীনের অংশ। ১৯৯৭ সালে আবার চীনের কাছে যায়।

হংকংয়ে ক্যান্টনিজ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিরও চল আছে। কোস্টার এসে থামল হলিউড রোডের পাশে একটা মন্দিরের সামনে, নাম মান মো টেম্পল। ১৮০০ সালে বিদ্যা আর যুদ্ধ দেবতাকে উদ্দেশ করে এই মন্দির তৈরি হয়েছে। বৌদ্ধ আর তার অনুসারীদের মিলনস্থল এই মন্দির। দরজার নকশা দেখার মতো।

ভেতরে ঢুকতেই স্নিগ্ধ সুবাসিত বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে গেল। সামনে তুলি হাতে বিদ্যার দেবতা 'মান চেওং' আর তরবারি হাতে 'মো' মানে যুদ্ধের দেবতা দাঁড়িয়ে আছেন। গাইড বলল, তাঁর অনুসারীরা শাকাহারি হয়, অনেকে বিয়ে করতে ভয় পায়। মন্দির থেকে ভিক্টোরিয়া পিকের রেলস্টেশনে গেলাম। ইলেকট্রিক ট্রেনে চড়ে ৫৫৪ মিটার উঁচু পাহাড়ের উপরে উঠে এলাম।

ভিক্টোরিয়া বন্দর আর কাউলুন প্যানারোমা দেখা যায় এখান থেকে। এখানে দুপুরের খাবার খেয়ে এবেরডিন ভিলেজ গেলাম। পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলেছি_ডানে চীন সাগর আর বামে বন। এই বনেই একসময় প্রচুর চন্দনগাছ জন্মাতো, যে কারণে লোকজন হংকংকে বলে চন্দনের দ্বীপ। এবেরডিনই হংকংয়ের অর্থনীতির প্রাণভোমরা।

চন্দন ছাড়া মাছও মিলত ঢের। দূরের দেশ থেকে বণিকরা আসত। বিনিময়ে দিয়ে যেত চিনামাটি আর নানান প্রযুক্তি। গড়ে উঠেছিল বিরাট জেলেপল্লী। এখন অবশ্য সব অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং।

মাছ ধরার জন্য এখন আছে বড় বড় জাহাজ। জলে আরো আছে বিশালকায় রংদার ভাসমান রেস্টুরেন্ট। সবচেয়ে বড়টির নাম জাম্বো। ঘাটে নেমে একটা জেলে নৌকায় চড়লাম যাকে বলে সাম্পান। ক্যান্টনিজ ভাষায় সাম্পান মানে নৌকা।

চট্টগ্রামের সাম্পানের নাম এ থেকেই হয়েছে। নৌ ভ্রমণ সেরে গেলাম 'ত্সে সুই লুয়েন' গহনার কারখানায়। নামিদামি সব ব্র্যান্ডের গহনা তৈরি হচ্ছে এখানে_সোনা, রুপা, হীরা আর মূল্যবান সব পাথরের। পরদিন দুপুর পর্যন্ত ছিল কনফারেন্স। তারপর আবার পথে নেমেছিলাম।

ট্রামে চড়েছিলাম। দুই হংকং ডলারে যাওয়া যায় অনেক দূর। টাইম স্কয়ারে নেমে কিছু কেনাকাটা করলাম। এখানে সব রকমের উন্নতমানের পণ্য মেলে। ক্যামেরার ব্যাটারি ও একটি এমপি থ্রি প্লেয়ার কিনতে গিয়ে দামাদামি করতে লাগলাম।

দোকানি বলে, নগদ কিনলে ৫ থেকে ১০ শতাংশ মূল্যছাড়, আর ক্রেডিট কার্ডে কিনলে যা লেখা আছে তা-ই। পরদিন সকালে গিয়েছিলাম কাউলুন। স্টার ফেরিতে সাগর পাড়ি দিয়েছিলাম। ১৮৮৮ সালে সবুজ রঙা এই ফেরি চালু হয়েছিল। এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপ বা দ্বীপের এপার-ওপার করতে এসব ফেরি চলে।

জনপ্রতি ভাড়া নিল তিন হংকং ডলার। ত্সিম সা ত্্সুই ঘাটে নেমে ১০ মিনিট হেঁটে শহরের ভেতরে গেলাম। এখানে প্রচুর ভারতীয়, পাকিস্তানি, শ্রীলঙ্কান, নেপালি থাকে। চুংকিং ম্যানসনে এসে জানলাম ভারতীয় হোটেলে ভাড়া জনপ্রতি ৮০ হংকং ডলার। আরেকটু সস্তা খুঁজতে গিয়ে পেলাম একটি নেপালি হোটেল, ভাড়া ২০ হংকং ডলার।

মহাখুশি হয়ে উঠে গেলাম ১৩ তলার সেই হোটেলে। ব্যাগ রেখে সাগর পাড়ের স্টার্স এভিনিউতে এসে এবার হংকং দেখলাম। সুন্দর লাগল। সারা দিন বাজার এলাকা ঘুরে এটা-সেটা খেয়ে পরদিন চীনের পথ ধরেছিলাম। হোটেলের পেছনেই রেলস্টেশন, সেখান থেকে চায়নার গোয়াংডং প্রদেশের লৌহুতে যাওয়া যায়।

কিভাবে যাবেন হংকং যেতে ড্রাগন এয়ারের রিটার্ন টিকিট ২৫ হাজার টাকা। প্লেন ছাড়ে ঢাকা থেকে রাত ১২টায়। পেঁৗছায় ভোর ৪টায়। বিমানবন্দর থেকে বাস বা ট্রেনে করে যাওয়া যায় যেকোনো জায়গায়। কাউলুনে বাস থেকে নেমেই হোটেল।

কক্ষপ্রতি ভাড়া ২০ থেকে ৪০ হংকং ডলার (১ হংকং ডলারে বাংলাদেশি ১০ টাকা)। মাঝারি খরচে থাকা-খাওয়া বাবদ দিনে এক হাজার টাকা হলেই ভালোভাবে ঘুরে দেখা যায় হংকং। চীন যেতে চাইলে হংকংয়ের ডাবল এন্ট্রি ভিসা লাগে। -এহসান উর রহমান (কালের কণ্ঠের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী থেকে অন্য কোনোখানেতে বিদেশ ভ্রমণ কাহিনী ছাপা হচ্ছে মাসে একটা করে। কাছের দেশগুলোই আসছে এই পর্যায়ে।

এবার থাকছে হংকং। )

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।