আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মার্কিনি জীবনের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ



মার্কিনি জীবনের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ ফকির ইলিয়াস ====================================== একজন মার্কিন নাগরিক হিসেবে মাঝে মাঝে গর্ববোধ যে করি না, তা নয়। হ্যাঁ, গর্বিত মনে হয় নিজেকে যখন দেখি মার্কিন প্রশাসন কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। কিংবা কোন জঘন্য অপরাধীকে বাইরে থেকে ধরে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। তবে একজন মার্কিনি হিসেবে দুঃখবোধ যে নেই, তাও কিন্তু নয়। নিজেকে খুবই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হয় যখন দেখি রক্তাক্ত মানুষের দেহের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে মার্কিনি যুদ্ধবিমানবহর।

সম্প্রতি, একটি ঘটনা আমাকে বেশ স্বস্তি দিয়েছে। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে ফেডারেল কোর্টে একজন দুর্ধর্ষ সোমালিয়ান জলদস্যুর চাঞ্চল্যকর বিচার করেছেন মাননীয় বিচারক। রায়ে ওই জলদস্যুকে ৩৩ বছর ৯ মাস কারাদ- দেয়া হয়েছে। সোমালিয়ান 'পাইরেট' আবদুওয়ালি আবু কাদির মুসাকে সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে পাকড়াও করতে সক্ষম হয়েছিল মার্কিন নৌবাহিনীর কমান্ডোরা। বহুল আলোচিত এ রায়টি শোনার জন্য শতাধিক সাংবাদিক, জুরি বোর্ড এবং আক্রান্তদের আত্মীয়স্বজন ছিলেন উদগ্রীব।

অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সেখানে উপস্থিত থাকার সার্বিক ব্যবস্থা পূর্ব থেকেই করে রেখেছিলাম। ইউএস ডিস্ট্রিক্ট জজ মিস লরেটা প্রেসকা যখন রায় পড়তে শুরু করবেন তখন ভবনে ছিল পিনপতন নীরবতা। মাননীয় বিচারক কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন বারবার। চোখের পুরু লেন্সের চশমাটি মুছতে মুছতে তিনি আক্রান্তদের বর্ণনা বাণী পড়ে শোনাচ্ছিলেন। মাননীয় বিচারকের রায় ঘোষণার আগেই পুরো আদালত প্রাঙ্গণে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল।

২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের যে জাহাজটি জলদস্যুদের দ্বারা ভারত মহাসাগরে ছিনতাই হয়েছিল তার নাবিকদের কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন সেখানে। কড়া নিরাপত্তা প্রহরায় জলদস্যু মুসা ছিল নির্বিকার। ইংরেজি না জানা এ জলদস্যুর কাছে দাঁড়িয়ে একজন দোভাষী তাকে রায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। জলদস্যুরা কিভাবে জিম্মি নাবিকদের হত্যার ভয় দেখিয়েছিল কিংবা কীভাবে তাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুলে নিয়ে বিক্রি করার হুমকি দিয়েছিল, সে বর্ণনা ছিল রীতিমতো লোমহর্ষক। বিচারক তার মন্তব্য সমাপনীতে বলেন, বর্তমান সভ্য বিশ্বে এমন হুমকি, ভয়ভীতি কেউ দেখাতে পারে তা বিশ্বাস করা কঠিন কাজ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ এর তীব্র নিন্দা করছে এবং নিশ্চিত করতে চায়- বিশ্বের যে কোন প্রান্তে এমন কোন কর্মকান্ডে লিপ্ত ব্যক্তি, গ্রুপ কিংবা সংঘবদ্ধ চক্রকে ধরে এনে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে এদের বিচার ও শাস্তি প্রদানে যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধপরিকর। উপস্থিত সাংবাদিক, সদস্যরা সবাই দাঁড়িয়ে এই বাণীর প্রতি সম্মান ও সংহতি প্রদর্শন করলেন। শ্রদ্ধায় আমারও মাথা নুয়ে এলো। মানবতার পক্ষে এ ধ্বনি, আমার বুকের ছাতি দ্বিগুণ করে তোলে, তা আমি ভালো করেই জানি। মাননীয় বিচারক আরও জানালেন, ২০০৯ সালে ছিনতাইকৃত সেই জাহাজটি উদ্ধারে মার্কিনি নৌ-কমান্ডোরা তাৎক্ষণিক সব ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।

এজন্য নৌবাহিনীর ঝটিকা টিম ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। জলদস্যুরা জাহাজের ক্যাপ্টেন রিচার্ড ফিলিসকে জিম্মি করে তার ক্রুসহ। চারদিন পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। সেই সংঘর্ষে তিনজন দুর্ধর্ষ জলদস্যু নিহত হয় এবং দলনেতা মুসা কমান্ডোদের হাতে ধরা পড়ে। দুই. যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সময়ে গোটা বিশ্বে একমাত্র পরাশক্তি।

মহাপরাক্রমশালী এই শক্তি এখন ব্যস্ত রয়েছে বিশ্বের গণতন্ত্রের নতুন সংস্করণের কাজে। তিউনিশিয়ায় নীরব গণবিপ্লবের পর মিসরের মানুষ রুখে ওঠে। মিসরের গণমানুষের পক্ষ অবলম্বন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, হোসনি মোবারককে সরে যেতে হবে। আঠারো দিনের মাথায় বিদায় নিতে বাধ্য হন মোবারক।

গেল কিছুদিন আগে স্টেটস অব ইউনিয়নে বারাক ওবামার ভাষণ শুনছিলাম। ওবামা তার ভাষণে বলেছিলেন, আমাদের কূটনৈতিকভাবে এ বিশ্বকে শাসন করতে হবে। কারণ অস্ত্র দিয়ে রক্তাক্ত শাসনের দিন আর নেই। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিভিন্ন ইস্যুতে ওয়াশিংটনের মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন মুখপাত্রের সঙ্গে আমার কথা হয়। তাদের একটি কথা বলতে শুনেছি, 'দেশটি যাদের সেই দেশের জনগণকেই তাদের সমস্যা সমাধানে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

' কথাগুলো খুবই প্রয়োজনীয়। দেশ যাদের, তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। এ লেখাটি যখন লিখছি, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রের পাতায় বড় বড় লিড নিউজ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গণবিক্ষোভের। বাহরাইনের মতো দেশেও গণতন্ত্রের দাবিতে মিছিল, সমাবেশ শুরু হয়েছে। ইয়ামেন, লিবিয়া, আলজিরিয়া প্রভৃতি দেশের মানুষ ক্রমশ ফুঁসে উঠছে।

সৌদি আরবের মতো কট্টর রাজপ্রথার দেশে রাজনৈতিক দলের উন্মেষ ঘটেছে বলে খবর বেরিয়েছে। বিশ্বে তবে কি রাজতন্ত্রের দিন শেষ হতে চললো? এমন একটি প্রশ্ন আসছে খুব সঙ্গত কারণে। যে যুক্তরাষ্ট্র এতদিন মধ্যপ্রাচ্যের রাজা, বাদশাহ, খলিফা, সুলতানদের অন্যতম রক্ষক ছিল, সেই যুক্তরাষ্ট্র কি তবে ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? নাকি স্বার্থের কোন অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন তৈরি করছে এই রাজবিমুখতা? এসব কথাবার্তাও আসছে নানা প্রাজ্ঞজনের আলোচনার টেবিলে। একটি বিষয় লক্ষণীয় মিসরে যখন গণমানুষেরা রাজপথ দখল করে রাস্তায় দিনরাত যাপন করছিল তখন মার্কিনি যুদ্ধ জাহাজ অবস্থান নিয়েছিল কায়রোর কাছাকাছি। এখন যখন বাহরাইনে গণতন্ত্রের দাবিতে মানুষ বিক্ষোভ শুরু করেছে, তখন ইউএস নেভির পঞ্চম বহরটি অবস্থান করছে মানামা সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি।

মুখে যত কথাই বলা হোক না কেন, যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে যে রক্তাক্ত যুদ্ধ করেছে তা বিশ্ব ইতিহাসে একটি দুঃখজনক নজির। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তার সদ্য লেখা গ্রন্থ 'ডিসিশন পয়েন্ট' এ সেটা স্বীকারও করে নিয়েছেন। সেই সময়ের মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড বলেছেন, যুদ্ধের সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বেনিয়াগোষ্ঠী যখন কোন অহেতুক যুদ্ধের প্ররোচনা করে তখন এর পেছনে মতলবি কারণ নিহিত থাকে। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় সে দেশের নিরীহ জনগণের হাতে অটোমেটিক মেশিনগান তুলে দিয়ে মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা উল্লাসের হাসি হেসেছিলেন।

সেই কট্টর বাদী আফগানরাই এখন 'তালেবান' নাম ধারণ করে মৌলবাদী জঙ্গিতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এর সঙ্গে মার্কিনি এজেন্ট বলে কথিত ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদা গ্রুপ এখন মার্কিনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে যত্রতত্র। শুরুতেই বলেছি, যে কোন মহৎ কাজের সমর্থন দিয়ে একজন মার্কিনি হিসেবে গর্ববোধ আমিও করি। কিন্তু যখন রক্তপাতের নগ্ন উল্লাসে যুক্তরাষ্ট্র উন্মত্ত হয়ে ওঠে? না, তখন যুক্তরাষ্ট্রের হাজারও কবির পঙক্তিমালার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বাংলা ভাষায়, নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে আমিও উচ্চারণ করি আমার কবিতা,- 'আরও কিছু শকুন উড়ে যাক অন্য কোন গ্রহে আমার হাত ধরা দু'বছরের শিশু সাহসে দাঁড়াক এই ভূমিকুঞ্জে, হে মাটি দাও প্রিয় উর্বরতা ...। ' নিউইয়র্ক, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১ ----------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ / ঢাকা/ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি - মার্সিলো


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।