আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেহেরযান বিতর্ক : যুদ্ধ ও ভালবাসার ছবি নাকি শুধুই একটি জনযুদ্ধকে (Civil War) অপমান করার ছবি?

এক অসাম্প্রদায়িক উজ্জল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি

Click This Link মেহেরজান নিয়ে অনেকদিন ধরেই বিতর্ক হচ্ছে। তাই আর যোগ না দিয়ে পারলাম না। আমি এ প্রজন্মেরই একজন। ছবিটি দেখে কারো লেখা বা কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই…যেটা আমার মনে হয়েছে: ১। ছবিটা নির্মাণের দিক থেকে শিল্পবোদ্ধাদের চোখে হয়তো খুব উন্নত মানের হয়নি।

কিন্তু সাধারণ জনগণ যারা শাকিব খানের বাংলা সিনেমা দেখে বা মধ্যবিত্ত দর্শক যারা হিন্দি ও ইংরেজী সিনেমা দেখে চোখ পাকিয়েছে এবং তার সাথে প্রতিনিয়ত বাংলা সিনেমাগুলির মেকিং তুলনা করতে থাকে, তাদের কাছে এই ৬ কোটি টাকা দামের ছবির মেকিং মোটামুটি সন্তোষজনক। তারপর আমাদের বাঙ্গালিদের মাঝে ব্যয় নিয়ে একটা বিশেষ বদগুণ আছে। এটাই সম্ভবত বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বাজেটের ছবি। এ তথ্য জানার পর ছবি ভাল হোক, খারাপ হোক একটু নাক উঁচু ভাব নিয়ে সবাই দেখে নেবেই। ঐ যে ছেঁড়া জিন্সগুলোর মত।

যতই ছেড়া হোক, দাম বেশি আর ব্রান্ডের হলে তো কোন কথাই নেই,ফ্যাশনের দোহাই দিয়ে কিনে নেই আমরা। ২। যাহোক, তবুও ভুল কিছুটা চোখে পড়ার মতই–যারা মোটামুটি সিরিয়াসলি সিনেমা দেখে, ভাবে তাদের কাছে। পোশাক নির্বাচন ঠিক হয়নি। এখানে স্পষ্ট–পরিচালক রুবাইয়াত শাকিব খানের ছবির পরিচালকের মতই দর্শক টানতে চেয়েছেন।

পার্থক্য একটাই। শাকিব খানের পরিচালক আজেবাজে পোশাক পরান আর রুবাইয়াত মোটামুটি চলতি পোশাকেই নায়ক এবং নায়িকাকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। কারণ ৭১ এর একটা গ্রাম্য বা যতই শহুরে মেয়ে হোক না কেন তার পোশাকের সাথে আজকালকার মেয়েদের পোশাকে একমাত্র শাড়ী ছাড়া আর কোথাও মিল নেই। তাই আনস্মার্ট লাগাটাই স্বাভাবিক ছিল। তবে সেটা দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার দ্বায়িত্ব অভিনেতাদের ও পরিচালকের।

তারা তাদের ব্যক্তিগত শৈল্পিক দক্ষতা দিয়ে সহজেই সেটা ঢাকতে পারতেন। আমার মনে হ্য় রুবাইয়াত, যিনি চলচ্চিত্রে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন, তার জন্য এই ভুল বড় ধরণের ব্যর্থতা। কারণ এ পর্যন্ত যত চলচ্চিত্র আমরা দেখেছি যার কাহিনীতে ইতিহাসের এক বিন্দু ছোঁয়াও আছে, সেখানেই সব পরিচালককে বাধ্য হয়ে পোশাকের ব্যাপারে মনোযোগী হতে হয়েছে। হোক সেটা হলিউড কিংবা বলিউড। তাহলে ঢালিউড কেন নয়? আর যেখানে আন্তর্জাতিক উচ্চতায় নিয়ে যাবার প্রয়াস থাকছে-ই প্রযোজক ও পরিচালকের! ৩।

বুঝলাম কাহিনীতে প্রেমকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু গুরুত্ব দেয়া আর কোনো কিছুকে ছোট করে অন্য কিছু বড় করা ঠিক নয়। কোন কিছুকে বড় করে দেখানোর জন্য অন্য কোন অনুভূতিতে আঘাত দেয়া কী ঠিক? পরিচালক প্রেমকে বড় করে দেখাতে গিয়ে যে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখিয়েছেন এবং তাদের মুখে যে কথা তুলে দিয়েছেন তা সত্যি-ই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের জন্য অপমানদায়ক। এখানে একটি চলচ্চিত্রের কথা তুলে না ধরলেই নয়। ড:জিভাগো।

সেখানেও একজন ব্যক্তির প্রেমিক ও কবি সত্তাকে রাশিয়ার বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে মুখ্য করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কী নায়কের মুখে সেধরণের কোন ডায়ালগ দেয়া হয়েছে যা বিপ্লবের বিপক্ষে যায় বা তাকে বিন্দুমাত্র ছোট করে? সত্যিই এটা ‘মেহেরজান’ এর পরিচালক ও কাহিনীকারের মানসিক বা দক্ষতাগত দারিদ্র্য ছাড়া আর কী বলব! ৪। এ ছবিতে নীলা নামের বীরাঙ্গণা চরিত্রটিকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা আমাদের হৃদয় ও মস্তিষ্ক কোনোটিই টানে না। অথচ, এদের মর্যাদা রক্ষায় আজও আমরা লড়ে যাচ্ছি। শুধু নীলাকে নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ে শিশু থেকে পূর্নাঙ্গ নারীকে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানীর সম্মুখীন হতে হয়।

সেটা ৭১ এর আগে যেমন ছিল এখনও আছে। কিন্ত ৭১ এ যেটা হয়েছে সেটার সাথে স্বাভাবিক সময়ের তুলনা করে অন্যায় করেছেন পরিচালক নীলার মুখে এই ডায়ালগ তুলে দিয়ে, “এটাই আমার প্রথম নয়। ” তার মানে সে যখন ছাত্র ইউনিয়ন করত তখন ও তাকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। কিন্ত একটি দেশে যখন সিভিল ওয়ার চলে তখন সে দেশের একজন নারীর বিদেশী সৈন্যের হাতে ধর্ষিত হওয়া আর স্বাভাবিক সময়ে এই বর্বরোচিত অপরাধের শিকার হওয়া একই মানদন্ডে বিচার হতে পারে না। সেই সেন্সটুকু পরিচালকের থাকা উচিত ছিল।

৪। আরেকটা বিরাট ভুল আছে যেটা বিজ্ঞান বা মানুষের মনস্তত্ত্বের সাথে যায় না ঠিক। ধরলাম, মেহেরযানের জায়গায় আমি। আমার ভাই যুদ্ধে গেছে। প্রতিদিনই শুনছি ও দেখছি যুদ্ধে পাকি সৈন্যের বর্বরতা, ভয়াবহতা।

সবচেয়ে বড় বিভীষীকা দেখছি যখন আমার বোন, যাকে দেখি আমার সবচেয়ে কাছ থেকে এবং ভালবাসি নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি, তাকে পাকিরা তুলে নিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে নোংরা কাজটি করেছে। তখন আমি কী স্বাভাবিক থাকবো? আমার মনোজগতে কী একটু ঘৃণার ঝড়ও উঠবে না পাকিদের বিরুদ্ধে? উঠবে নিশ্চিতভাবেই, এটাই মানুষের মনস্তত্ত্ব। পাকি সৈন্যের প্রতি প্রেম যতই আসুক, এই মনস্তত্ত্বকে ডিঙিয়ে আসতে পারে না। ৫। একটা ভুল আমার কাছে মনে হয়েছে তথ্যগত।

আমরা জানি, পাকি সৈন্য তৎকালীন (১৯৭১) সময়ে বিশ্বকাঁপানো নিষ্ঠুর সেনাবাহিনী হিসেবে কুখ্যাতি কুড়িয়েছিল। তার মাঝে আবার বেলুচ সৈন্যদের বিশেষ কুখ্যাতি ছিল অশিক্ষা ও বর্বরতায়। সে বিচারে এই নায়ককে বেলুচ, শিক্ষিত ও মানবিক বোধসম্পন্ন সৈন্য হিসেবে দেখানো কী আরেকটা অদক্ষতা হল না? আর শত্রুপক্ষের এত অমানবিকতার মাঝে এক বিন্দু মানবিকতা চোখে মুহূর্তের শান্তি আনলেও ধাঁধা লাগাতে পারে কী? প্রশ্ন রইল কাহিনীকারের কাছে? অবশ্য ‘প্রেম মানে না বাধা’, কিন্তু চারদিকের বিভীষিকায় তা অস্বাভাবিক ও স্বার্থপর প্রেমে পরিণত হতে বাধ্য, তার মাঝে পবিত্রতা বা মঙ্গলের ছায়া থাকে না। ৫। তবুও ব্যতিক্রমের খাতিরে আমরা না হয় ডায়ালগ, মেকিং বাদ দিয়ে শধু মূল কাহিনীকে নিয়েই ভাবলাম, শিল্পের জন্য।

সেখানেও কী শুধু বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু পাই? আসি শেষ কথায়, প্রথম আলোয় পরিচালকের লেখা পড়ে মনে হল তিনি একটি ড:জিভাগো ই বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তবে একটি কথা এই বা অন্য সব পরিচালকের মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশের ৭১ এর যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল, এবং সত্যিকার অর্থে স্পর্শকাতর। তাই এ ইতিহাস নিয়ে বা এর ছোঁয়া নিয়ে কোন শিল্প তৈরি করার আগে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এবং অবশ্যই ইতিহাসকে গভীরভাবে জেনে নিতে হবে।

ব্যতিক্রম কে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ও শৈল্পিক দক্ষতার প্রয়োজন। সেই পর্যায়ে নিজকে নিয়ে গিয়ে তারপর এধরণের নিরীক্ষা করলে ভাল হয়। সবচেয়ে টার্নিং পয়েন্ট হল, যে সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে সেই সময়ে এই ছবি মুক্তি দেয়া কতখানি দেশপ্রেমিকের পরিচয় হল? নাকি যখন এ বিচার চলছে তখন এ বিতর্ক সৃস্টি করে মার্কেট তৈরি করাই লক্ষ্য ছিল পরিচালকের? এসব পয়েন্ট বাদ দেয়া যায় না, আরো বড় একটি সন্দেহও বাদ দেয়া যাচ্ছে না, সেটা হল, এই ছবি যুদ্ধাপরাধীদের স্বপক্ষে প্রপাগান্ডার ফলাফল কিনা। এটা হতেই পারে যে, বিদেশে নিয়োজিত যুদ্ধাপরাধীদের স্বপক্ষ শক্তি এই গল্পকে আধুনিক চলচ্চিত্রে রূপ দিতে অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তরুণ প্রজন্মের মাঝে এই চলচ্চিত্র শুধুমাত্র বিভ্রান্তিই সৃষ্টি করেছে ৭১ নিয়ে।

যেখানে আজো ৭১ কে নিয়ে আমাদেরকে লড়তে হচ্ছে,রাজপথে আন্দোলনে নামতে হচ্ছে শহীদদের আদর্শ রক্ষায়,সেখানে কোন রুবাইয়াতের মুক্তিযুদ্ধের কোন নেতিবাচক দিককে চলচিত্রের অংশ করার অধিকার নেই। ভালবাসার জন্য অন্য প্লট বেছে নিলেও হত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।