আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মনেরই আকাশে ভাসে তারা মিটিমিটি



অক্টোবর শীত আসি আসি করছে। হঠাৎ হঠাৎ হাওয়া দিয়ে যায়। নয়জনের দলটা আজকে একসাথে হবার উদ্দেশ্য মোটামুটি একটা পুনঃ মিলন আবার একই সাথে বিদায়ী সংবর্ধনা। অয়নের পোস্টিং নড়াইলে, রিংকি জামাই সহ সিলেটে স্থায়ী হচ্ছে, আর তানিম সিঙ্গাপুর যাচ্ছে এই মাসের শেষের দিকে। হেমাকে সরাসরি এখনও বলা হয়নি স্কলারশিপের ব্যাপারটা যদিও সবাই জানে; হেমাও জানে।

তবুও ওকে আলাদা ভাবে বলাটা যে উচিত বুঝেও বলতে পারছে না। এখনও ভিড় কম এদিকটায়, বিকেলের পর মানুষের জন্য হাটাই যায় না। পানি এখন অনেক কম, বড় বড় পাথরগুলো ছড়িয়ে আছে পুরা পতেঙ্গা বীচ জুড়ে। তনিমা কি নিয়ে খুব হাসাহাসি করছে জানি, সাথে হেমাও; মাঝেমাঝে হাওয়ায় দুলছে ওর চুল আর দুলছে তানিমের হৃদয়। অনেক সাধনার পর এই স্কলারশিপ, যেতে তো ওকে হবেই।

রিংকির জামাই পারভেজ ভাই এখানে সবচেয়ে সিনিয়ার, একটু বেশিই সিনিয়ার। উনি আর্মি অফিসার হবার সুবাদে নেভাল একাডেমি এরিয়াতে ঢুকার ব্যবস্থা হল, তবে অল্প কিছুক্ষনের জন্য। ওদিক থেকে ফেরার সময় হঠাত হেমা দাঁড়িয়ে ফুল দেখতে লাগলো, তানিম ঠিক পাশেই তখন। লাল গোলাপগুলা কি সুন্দর, তাই না? বলে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকালো তানিমের দিকে। এখানে ফুল ছেঁড়া কঠিন ভাবে নিষেধ, তবে তানিম অপেক্ষা করছিল পারভেজ ভাই রিংকি সহ আরেকটু এগিয়ে যাবার জন্য।

ঠিক সময়টা যখনই আসলো, পিছন থেকে ইভান এসে তিনটা ফুল ছিঁড়ে প্রীতিকে বেশ নাটক করে একটা দিল, আর বাকি দুটো তনিমা ও হেমার। এই ছ্যাবলামি স্বভাবটা তানিমের নাই বলেই মাঝেমাঝে দুঃখ হয় নিজের জন্য! সন্ধ্যা পার হয়ে গেল, ফেরার পথে সবাই। আলো আঁধার এর পথে চুপচাপ এগুচ্ছে দলটা। সিগেরেট খাবি? অয়ন প্যাকেটটা এগিয়ে দেয় তানিম এর দিকে। একটু পিছিয়ে ওরা দুজন এগুতে থাকে বাকিদের সাথে।

অনেকটা ডায়ামন্ড ফরমেশনে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা, নাইন লীফ ক্লভার। সেনাপতি অ্যালেকজান্ডার দ্য গ্রেট সবার সামনে রিংকির হাত ধরে, আর ব্যাসানিও কানে ফুল গোঁজা পরসিয়া, নেরিসা আর জেসিকাকে নিয়ে এগুচ্ছেন। শাকিল গাধাটা তনিমার পাশে এখন লরেনজো। পুরা আকাশটা লাল হয়ে গেল হঠাৎ; এখানে প্রায়ই এ দৃশ্য দেখা যায়। নেভির লোকজন আকাশে লাল ফানুশ ছুঁড়ে মহড়া দেয় না কি যেন।

হেমার হালকা লাল রঙ করা চুলে সে আলো এসে পড়ে আরও রক্তিম দেখায়। হাওয়ায় ওড়া চুল আগুনের হলকার মত এঁকে বেঁকে একটু আধটু ছুঁয়ে যাচ্ছে পাশে ইভানের শার্ট, আর এন্টনিওর হৃদয় শায়লকের ছোঁড়ায় ক্ষরিত, পাথরে আছড়ে পড়া সাগরের তীব্র ঢেউ এর মত। বেশ ভরা চাঁদ আজকে আকাশে, গাড়ির জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ছে হেমার মুখে। পেছনের সিটে বসে দেখছে তানিম। ইঞ্জিনের আওয়াজ ছাপিয়েও মাঝেমধ্যে ঝিঁঝিঁর ডাক পাওয়া যায়।

কতশত শব্দের কারিগরি চলছে প্রকৃতিতে, অথচ খুব জরুরী কিছু শব্দ অনুচ্চারিত থেকে গেল। হেমাকে বলা হয়নি এ মাসের শেষেই যে ও যাচ্ছে, সামনা সামনি কেন যে বলতে পারলো না! আকাশে চাঁদনী আসে আলোতে ভুবন ভাসে দিকে দিকে সে আলো ছড়ায়- মনেতে চাঁদনী এলে মন আলো পায় দেখানোর নেই যে উপায় ... সময় চলে যায় তার নিজের নিয়মে, রেখে যায় স্মৃতির করিডোর। পিছনে ফিরে তাকালে শেষ প্রান্তটা সরু, আবছা দেখায়। কিন্তু এখানে সামনের প্রান্তও পিছনের মতই আবছা মনে হয় তানিমের। ডানে মোড় নিয়ে কিছুটা হেটে ল্যাবের প্রবেশ মুখ ফেলে লাইব্রেরির দিকে এগোও সে।

শুধু কিছু ফটোকপি ছাড়া আজকে আর কিছু করার নেই। কেন জানি এখানে বাসায় ফেরার সেই তাড়াটা অনুভব করে না, দেশের মত। এপার্টমেন্টের করিডোর গুলোও সামনে পিছনে কানাগলির মতই আবছা। ল্যাপটপের ভাজটা বন্ধ করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় তানিম। অজস্র আলোর শহর, আর নিযুত তারার আকাশ।

হেমার সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। মেসেঞ্জারে বা কখনও ফোনে। কেন জানি কথার শুরু আর শেষগুলো এখন বইয়ের সিলেবাসের মত পরিচিত লাগে, মনে হয় যেন প্রতিদিন রিভিশন দিচ্ছে ওরা। কথার করিডোরগুলো কেমন জানি ধীরে ধীরে বাক্সের মত সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে, শুধু দেয়ালের এখানে সেখানে সাজানো কিছু শ-পিস আর পোরট্রেট ঝুলে থাকে। অগাস্টে যেবার ছুটিতে দেশে গেল সে; পৌঁছে পরদিন সকালেই দেখা করতে গেল হেমার সাথে।

খুব অদ্ভুত ভালো লাগছিল। হেমার জন্য অনেক গিফট নিয়ে গিয়েছিল, সাথে ছিল স্পেশাল অর্কিড এর কিছু আইটেম, অনেক ঝামেলা করে নিতে হয়েছিল। ফোর সিজন অর্কিড। অথচ ওর চোখে সেই আগের দ্যুতি খুঁজে পাচ্ছিল না তানিম। দিনটা কেমন হুট হাট করেই শেষ হয়ে গেল এবং একসময় পুরো ছুটিটাই।

ছুটির প্রায় প্রতিদিনই দেখা হত, কথা হত, রিভিশন দেয়ার মত। ভার্সিটিতে থাকতে কত দিন একজন অন্যজনের জন্য ঘণ্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতো ওরা, কিন্তু হেমার পৌঁছুতে একদিন বিশ মিনিট দেরী হওয়াতেই কেমন অসহ্য লাগছিল তানিমের। তনিমার বিয়ের ছবিগুলো ফেইসবুকে দেখেছিল তানিম দেশের বাইরে থাকার সময়। হেমার আসে পাশে কত নতুন নতুন মুখ সেখানে। সামনা সামনি ব্যাপারটা আরও বেশি চোখে লাগছিল।

বন্ধুদের গেট-টুগেদারের দিন সবাই মিলে গেল বাটালি হিল এ। পাশে হেমাকে খুঁজে পাওয়াটা ভাগ্য মনে হচ্ছিল যেন। সামনে থেকে বেশ কয়েকবার ঘুড়ে ওর দিকে দেখছিল, কিন্তু কৈ নিজে তো এসে একবারও পাশাপাশি হাটলো না! কত সুন্দর বোঝাপোড়া ছিল একসময় ওদের। ঈদের বন্ধে বাড়ি ফেরার সময় ক্লাসের অন্য কেউ না, তানিমের ই ছিল হেমার টিকিট করে দেয়ার দায়িত্ব। সেই ট্রেনের করিডোর যা ছিল কত অদ্ভুত ভালো লাগার স্মৃতিময় কেমন যেন গুমোট বদ্ধ লাগছিল সিঙ্গাপুর এয়ার লাইনের প্লেনের ফিরতি টিকিটের ঝামেলা মিটিয়ে ঢাকা থেকে চিটাগাং ফেরার সময়।

মাঝখানে একদিন ভুল বোঝাবুঝি হল। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর; ইভানের ইদানিংকার আচরণ খুব আপত্তিকর লাগছিলো, তার চেয়েও কষ্টের ছিল হেমার প্রশ্রয়। কথাটা বলার ভঙ্গীটা হয়তো বেশ রুক্ষই ছিল, কিন্তু হেমার জবাবটার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। অনেকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে হেমা বলল “প্লিজ ডোন্ট টক লাইক মাই মাদার, তুমি আমার গার্জিয়ান না। ” ক্রমশ একটা দূরত্ব অনুভব করছিল তানিম, কিন্তু ওরও কিছু দায়বদ্ধতা আছে নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি।

হেমার কি বোঝা উচিত না? একসময় মায়ের জন্য শাল কিনতে ওকেই নিয়ে যেত দোকানে তানিম। আসার আগের দিন ওকে একটা বই গিফট করল হেমা। কবিতার বই, যেখানে একটা গোলাপ নিয়ে লেখা কবিতার নীচে হেমার সাথে তানিমের ছুটিতে দেশে আসার আগের কিছু অন লাইন মেসেঞ্জার কথোপকথন তুলে দিয়েছে। আগামী সপ্তাহে দেশে আসছি আমি ভাল। কি আনবো তোমার জন্য? কিছু না তুমি আসো।

আরে কি আনবো? বল না- অন্য ভাবেও তো বলতে পারতা- মানে? কিছু না, এমনিই বললাম। একদম শেষ লাইনে লেখা- তোমার জন্য কি আনবো, এভাবে বললে নিজেকে একটু ইম্পরট্যান্ট মনে হত। কাছাকাছি হত আমি আর তুমির দূরত্ব। এইসব কথার গাঁথুনিগুলোই এখন দূরত্বের পরিমাপক। হয়তো ঐ ভাবে বললে দূরত্ব কম হত।

করিডোরের রেখায় দূরত্বের পরিমাপে পদসংখ্যা এখন অধিক কার্যকর। লিফট থেকে নামার পর ফ্ল্যাট এর দরজা পর্যন্ত পনের থেকে সতের কদম, শহরতলীর গ্রোসারি থেকে সাবওয়ে শ দুই কদম, ল্যাব থেকে লাইব্রেরি একশ বিশ, আর ক্যাফে হয়ে গেলে দেড়শ। এসব দূরত্বই এখন মাপতে হয় নিত্যদিন। তোমার-আমার কথার দূরত্ব কত আলোকবর্ষ, কে যানে কোথায়, কিভাবে বাড়ছে। এয়ারপোর্টে বসে বইটা পড়ার রাতেও এরকম তারার মেলা ছিল আকাশে, আজকের মত।

সিগারেট হাতে নিয়ে তাই ভাবছিল তানিম। এই দূর পরবাসে তারা গুনে আকাশে আকাশে কাটে নিঃসঙ্গ রাত্রিগুলো। মাঝে মাঝে স্বপ্নের বেশে স্মৃতিরা এসে আমাকে করে যায় বড় বেশি এলোমেলো। । শেষ পর্যন্ত মাস্টার্স কমপ্লিট হয়েই গেল।

পি এইচ ডি এর অফার হাতে বেশ কয়েকটা। তবে দেশ থেকে ঘুরে আসার পর বাকিসব। অনেক কিছুই এখন অনেক সহজ আর হাতের মুঠোয়, আবার অনেক কিছু বহুদূর। হেমার আর তানিমের বাসার লোকজন এর কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছে ইদানিং। উভয় পরিবারের মুরুব্বীদের হৃদযন্ত্র এখন একই ডাক্তারের পরামর্শে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

মায়ের সাথে কথা বলার সময় হেমা প্রসঙ্গ উঠে আসছে প্রায়ই, মায়ের কল্যাণেই অবশ্য। কিন্তু হেমার সাথে এখনও সিলেবাস অনুযায়ী কথা চলে, দুজনের কেউই কোন পরীক্ষামূলক প্রশ্ন তুলে না। একটা অসহ্য কোল্ড ওয়ার। মা অবশ্য পাত্রী দেখা থামিয়ে রাখেন নি; হেমার পরিবারও ভিন্ন পথে তাদের কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছে। অয়নের কাছে অনেক প্রিন্স অব পারসিয়াদের গল্প শুনেছে সে।

এর মধ্যেই আবার একদিন মেসেঞ্জারে কথা- ষোল তারিখে ফ্লাইট কতদিনের জন্য আসছো এবার? নির্ভর করে- কিসের উপর? অনেক কিছুর উপর। ঠিক আছে, আসলেই শুনবো। ফেরার কয়েকদিন আগে ফোনে কথা বলতে বলতে করিডোরে হাটছিল তানিম। মা বলছিলেন ছোট খালার গাড়ি এক্সিডেন্টের কথা, খুব বেশী সিরিয়াস না অবশ্য। আব্বার প্রাক্তন কলিগ মারা গেছেন।

কিভাবে? বলতে বলতে দরজা খুলল তানিম, নীচে বেশ কিছু খাম পড়ে আছে। তুলে নিয়ে দরজা বন্ধ করে জানতে চায় আব্বার শরীর কেমন এখন। এখন ভালো। আরও কিছুক্ষন কথা হল। আম্মা কি সব ফুলের টব যোগাড় করেছেন, কিছু গোলাপের আর কি যেন ফুলের চাড়া দিয়ে গেছে হেমা।

ব্লাড সুগার এখন কন্ট্রোলে আছে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় একসাথে হাটেন দুজন। বড় ভাইয়ার বাচ্চার দাঁত উঠছে। রাতে ঘুমাবার আগে সিগেরেট খাওয়া কেন খারাপ এই আর্টিকেল টা পড়া শেষ করে উঠে সিগেরেট নিয়ে ব্যাল্কনিতে যাবার সময় খামগুলো চোখে পড়ল, লাইটারটা টেবিল থেকে নেয়ার মুহূর্তে। একটু ঝুঁকে কড়ে আঙুল দিয়ে একটা একটা করে সরিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল তানিম নতুন কোন বীমা, মার্কেটিং কোম্পানি যোগ হয়েছে কিনা খামের স্তুপে। শেষের দিকে একটা নতুন ধরণের অদ্ভুত খাম।

আরেকটু ঝুঁকে ভালো করে দেখলো। হেমার চিঠি!! তোমার বাসায় গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। খালাম্মার খুব পছন্দ, তাই কয়েকটা গোলাপের চাড়া দিয়ে এসেছিলাম। তুমি আসতে আসতে কলি ফুটে যাবে। আমার জন্য একটা নিয়ে এসো দেখা করার দিন।

ফাইভ পেটাল রোউস। আজকেও আকাশে অজস্র তারা। প্রতিটা তারাই যেন হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে! শুধু একটি গোলাপ চেয়ে পাঠালে চিঠি শুনে মনেরই আকাশে ভাসে তারা মিটিমিটি। । Strange Foreign Beauty - MLTR


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.