আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এম.এল.এম বিজনেস এর পোস্টমর্টেম।



বাংলাদেশে খুব প্রকট আকার ধারন করেছে ব্যবসার মূল প্রকৃতি বিরুদ্ধ এক ধরণের লেনদেন, যার নাম মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং বা সংক্ষেপে এম.এল.এম (MLM)। তরুন সম্প্রদায় এমনকি স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তরুনরা পর্যন্ত এদের চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে এবং খুব তাড়াতাড়ি জীবনে সমৃদ্ধি পাবার তাগিদ নিয়ে জড়িয়ে পড়ছে এ ব্যবসাগুলোতে। ব্যবসাটির অপরনাম নেটওয়ার্ক মার্কেটিং। অনেক অর্থনীতিবিদ এর গঠনতন্ত্রের কারণে অবশ্য একে পিরামিড স্কীম নামেও অভিহিত করে থাকেন। কিন্তু কথা এখানে নয়।

বাস্তবতা ঘাটলে দেখা যায় বহু লোক এর ফাঁদে পড়ে অহরহ প্রতারিত হচ্ছেন। অনেক নিম্নবিত্তরাও সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। চট্টগ্রাম, সিলেট-এ এসকল কোম্পানীর প্রকোপের কারণে অনেকে খুব নির্মমভাবে প্রতারিত হয়েছেন। খবর বেরুচ্ছে এখন এই সকল কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ ঢাকা শহরেও তাদের এ প্রতারনার জাল বিস্তার করে চলছে। শুধু তাই নয়, দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়ে বিদেশে মুদ্রা পাচারের অভিযোগও উঠছে এদের বিরুদ্ধে।

(সুত্রঃ দৈনিক কালের কন্ঠ- ২৫ ও ২৬ জানুয়ারী) রবার্ট এল. ফ্লিটজপ্যাট্রিক এর মত মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরাও কথা বলেছেন এ অস্বাভাবিক এবং প্রতারনামূলক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিশ্বব্যাপী প্রতারনার বিরুদ্ধে। অর্থনীতির মূল ধারার সাথে অসংগতিগুলোকেও তারা এক এক করে দেখিয়েছেন। ইসলামী অর্থনীতি এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে বিষয়টিকে কেমনভাবে দেখা হচ্ছে- এ মর্মে বিগত ৫/১২/২০১০ইং তারিখে বর্তমান বিশ্বের প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার ডাঃ জাকির নায়েক প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান “ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন” এর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। সেখানকার “ইসলাম ও তুলনামূলক ধর্ম” বিভাগের গবেষনা নির্বাহি ডঃ শুয়াইব সাইয়েদ এর উত্তর দিয়েছেন। উত্তরটির অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হলঃ এই ধরনের লেনদেন ইসলামে হারাম, কারন এ ধরনের ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা নয় বরং কমিশন লাভ করা।

এতে কমিশনের পরিমান দশ হাজার গুণ পর্যন্ত হতে পারে যেখানে মূল পণ্যটির মূল্য হয়তোবা ১০০ টাকার বেশি হয় না। যেকোন চালাক ব্যক্তিকে মূল ধারার ব্যবসা (বৈধ ব্যবসাসমূহ) এবং এধরণের কমিশন লাভের ব্যবসার মধ্যে যেকোন একটিকে বেছে নিতে বললে সে কমিশন লাভের ব্যাপারটিকেই পছন্দ করে। একারণে এ ধরনের কোম্পানীসমূহ তাদের পন্যের মার্কেটিং ও এডভার্টাইজিং এর ব্যাপারে এতে অংশগ্রহনকারীদেরকে উচ্চ অংকের কমিশনের উপরে জোর প্রদান করে এবং অল্প টাকা খরচ করে পণ্য কিনে অধিকহারে মুনাফা লাভের লোভ দেখায়। এধরণের কোম্পানিসমূহ যেসকল পণ্য বাজারজাত করে তা নামেমাত্র এবং নিছক কমিশন লাভের মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এ ধরনের কমিশন নেয়া ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ, তার কারনগুলো হচ্ছে- প্রথমত, এতে দু’ধরনের রিবা বা সুদ জড়িত- ১.রিবা আল ফজল (একই ধরনের পন্য বিনিময়, কিন্তু ভিন্ন পরিমাণে) এবং ২.রিবা আল নাসিয়াহ (তৎক্ষনাত পরিশোধ করলে যে পরিমাণ দিতে হত, সময়ের ব্যবধানে তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করা)।

এ ব্যবসায় অংশগ্রহনকারী ব্যক্তি খুব সামান্য পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে অনেক বড় অংকের অর্থ লাভ করে। অন্যকথায়, সে ক্ষুদ্র পরিমান টাকা দিয়ে বড় পরিমানের টাকা কিনে নেয় শুধু সময়ের ব্যবধানের কারনে। শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের মতে এ ধরনের লেনদেন সুদ এবং সুদ নিঃসন্দেহে হারাম। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম”। (বাকারা-২৭৫)।

এ সকল কোম্পানির পণ্যসমূহ উছিলা বা নামেমাত্র অর্থাৎ এমন পন্য নয় যা অংশগ্রহনকারীর অবশ্য প্রয়োজনীয় বা পছন্দনীয়। দ্বিতীয়ত, শরীয়তের ভাষায় এ ধরনের লেনদেনকে বলা হয় “ঘরর”(অনিশ্চিত লেনদেন) যা কিনা শরীয়তে নিষিদ্ধ। একজন অংশগ্রহনকারীকে আরো লোকজনকে এ ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট করাতে হয়। তাই যে এ ব্যবসায় প্রথম জড়িত হচ্ছে সে আদৌ জানে না যে সে এক্ষেত্রে পন্য বিক্রয় করতে অথবা অন্যদেরকে অংশগ্রহন করাতে সক্ষম হবে কিনা। পিরামিড স্কীম বা এম.এল.এম কোম্পানীটি যত দীর্ঘস্থায়ীই হোক না কেন, এটা গঠনগতভাবেই এক সময় শেষ হয়ে যেতে বাধ্য এবং যারা নতুন হিসেবে যোগদান করছে তারা কখনই জানতে পারে না তারা কি কোম্পানীর নিচের স্তরে যোগদান করল নাকি উপরের স্তরে।

বাস্তবতা হল বেশিরভাগ অংশগ্রহনকারীরাই ক্ষতির সম্মুখীন হয়, শুধুমাত্র উপরের স্তরের গুটিকয়েকজন ছাড়া। আবু হোরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “রাসুল (সাঃ) সে ধরনের লেনদেন নিষেধ করেছেন, যা পাথর ছুড়ে নির্ধারিত হয় আর যে ধরনের লেনদেনে অনিশ্চয়তা জড়িত”। (সহীহ মুসলিমঃ হাদীস নং-৩৬১৪) তৃতীয়ত, অবৈধভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাতের বিষয়টিও এধরনের লেনদেনের সাথে জড়িত। কারন এতে লাভবান হয় শুধুমাত্র কোম্পনীটি এবং কিছুসংখ্যক অংশগ্রহনকারী যাদেরকে কোম্পানী অন্যদেরকে প্রতারিত করতে উৎসাহিত করে। অবৈধভাবে সম্পদ আত্মসাত করা পবিত্র কোরআনে সরাসরি নিষেধ করা হয়েছে।

বলা হয়েছে, “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা পরস্পরের ধনসম্পদ অ্ন্যায়ভাবে আত্মসাত করো না”। (সুরা নিসাঃ ২৯) চতুর্থত, অন্যকে প্রতারিত করার বিষয়টি এ ব্যবসার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এরা নতুনদেরকে এমনভাবে ব্যবসাটির প্রতি আগ্রহী করে যেন কোম্পানীর নির্দিষ্ট কোন পন্য ক্রয়-বিক্রয়ই প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু বাস্তবিকভাবে তা হয় না। এছাড়াও এখানে উচ্চ অংকের কমিশনের প্রতি নতুন বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় যে সচরাচর এতে বেশি কমিশন কেউই অর্জন করতে পারে না যতটা বলা হয়ে থাকে।

এভাবে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে প্রতারিত করা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “ যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমাদের সমাজভুক্ত নয়”। হাকিম বিন হাজিম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “লেনদেনের ক্ষেত্রে দু’পক্ষের মধ্যে পছন্দের সুযোগ রয়েছে যতক্ষন না দু’পক্ষ পৃথক হয়ে যায়। যদি তারা তাদের লেনদেনের ব্যাপারে সতর্ক এবং স্বচ্ছ থাকে, তবে এ ব্যবসা তাদের জন্য রহমতস্বরূপ হবে; কিন্তু তারা যদি মিথ্যা বলে এবং কোন ব্যাপারে প্রতারণার আশ্রয় নেয়, তবে তাদের এ লেনদেন থেকে আল্লাহর রহমত উঠিয়ে নেয়া হবে”। (সহীহ মুসলিমঃ ব্যবসা-বানিজ্য অধ্যায়ঃ হাদিস নং-৩৬৬১)।

পঞ্চমত, এ ব্যবসা সম্পর্কে আরেকটি দৃষ্টিভংগি পেশ করা হয় যে এটা অনেকটা দালালী ব্যবসার মত। কিন্তু এটাও সত্য নয়। কেননা দালালি ব্যবসায় যে ধরনের লেনদেন হয় তাতে একজন দালালকে একটা পন্য বিক্রয়ের বিনিময়ে ক্রেতা ও বিক্রেতার পক্ষ থেকে কিছু অর্থ পরিশোধ করা হয়ে থাকে। অথচ এম.এল.এম ব্যবসায় একটি পন্য বাজারজাত করতে হলে উলটো অংশগ্রহনকারীকেই নির্দিষ্ট একটি ফি পরিশোধ করতে হয়। দালালির ক্ষেত্রে কোন একটি পণ্যকে বাস্তবিকভাবেই বাজারজাত করতে হয় যেখানে এম.এল.এম এর প্রধান উদ্দেশ্য পন্য বিক্রয় নয়, মূলত ব্যবসায়িক লেনদেন বা চুক্তিটাকেই বাজারজাত করা, সেটাকে পুঁজি করে নতুন লোকজন সংগ্রহ করা এবং এর থেকে কমিশন লাভ করা।

ফলশ্রুতিতে দেখা যায় নতুনভাবে যে অংশগ্রহন করছে তার প্রধান কাজই হয়ে দাঁড়ায় আরো লোকজনকে এতে অংশগ্রহন করানো। এভাবেই পুরো প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। দালালির ক্ষেত্রে ক্রেতা প্রকৃত অর্থেই পন্য কিনতে চায়, আর বিক্রেতারও প্রধান উদ্দেশ্য থাকে পন্যটি বিক্রয় করা। একজন দালাল শুধু ক্রেতা-বিক্রেতার যোগাযোগ ঘটিয়ে উভয়পক্ষ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হয়। ষষ্ঠত, আরো একটি দৃষ্টিভংগী প্রচলিত রয়েছে যে এম.এল.এম এ প্রাপ্ত কমিশন এবং পন্য এক ধরনের উপহারসরূপ দেয়া হয়ে থাকে।

এটাও সত্যি নয়। আর যদি আমরা এটাকে উপহার হিসেবে মেনেও নেই, তাহলে এটাও মনে রাখতে হবে যে ইসলামী শরীয়াতে সবধরনের উপহার গ্রহনের অনুমতি নেই। ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধের সময় ঋণ পরিশোধের অতিরিক্ত অর্থ বা অন্য কিছু দিলে তা সরাসরি রিবা অর্থাৎ সুদ। হযরত আবু বুরদাহ (রাঃ) যখন মদীনায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) এর সাথে দেখা করতে গেলেন তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম তাকে বললেন, “তুমি এমন একটি ভূ-খন্ডে আছ যেখানে সুদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। সুতরাং তোমার নিকট কেউ যদি ঋণগ্রস্থ থাকে আর সে যদি তোমাকে উপহার হিসেবে যব, বার্লি অথবা অন্যকোন খাদ্যশস্য পাঠায়, তাহলে তা গ্রহন করো না।

কেননা এটা সুদ। (সহীহ বুখারীঃ খন্ড ৫-অধ্যায় ৫৮, হাদীস নং-১৫৯) কেউ যখন কারো অধীনস্থ থাকে তখন উর্ধ্বতনকে খুশি করার জন্য অনেক সময় উপহার দিয়ে থাকে। একারনে যখন একজন যাকাত সংগ্রহকারী সাহাবী এসে রাসুল (সাঃ)কে বললেন, “ এটা আপনার জন্য এবং এটা আমার জন্য উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে”। রাসুল(সাঃ)তাঁকে বললেন, “তুমি কেন তোমার বাড়িতে তোমার পিতামাতার সাথে বসে থাকলে না এবং অপেক্ষা করলে না যে কেউ তোমাকে উপহার দিতে আসে কিনা?” পিরামিড স্কীম বা এম.এল.এম ব্যবসায় অংশগ্রনে আকৃষ্ট করার জন্যই কমিশন দেয়া হয়ে থাকে। এখন এই কমিশনকে উপহার/গিফট বলা হোক অথবা অন্য কিছুই বলা হোক না কেন।

নাম পরিবর্তনের ফলে এই কমিশনের প্রকৃতিগত সামান্যতম কোন পরিবর্তনও হয় না। আই.আর.এফ থেকে এই উত্তরটিই পাঠানো হয়েছিল। বাংলাদেশে এ ধরনের অনেকগুলো এম.এল.এম এখন সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ডেসটিনি, ইউনিপে টু ইউ, টি.ভি.আই এক্সপ্রেস, গেটওয়ে, স্পীক এশিয়া ইত্যাদি। এদের কারো আইওয়াস পন্য গোল্ড, কারো বা ট্যুরিজম, আবার কেউবা সার্ভেয়ার হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়।

কিন্তু ঘুরেফিরে সবই এক। মেম্বার কালেকশান করা আর কমিশন লাভ করা। আপনার কষ্টার্জিত অর্থ আপনি কোথায় বিনিয়োগ করবেন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। তবে পরামর্শ একটাই প্রতারক চক্রের হাতে সে অর্থ তুলে দিয়ে নিজেকে এবং দেশের অর্থনীতিকে হুমকির সম্মুখীন করা নিশ্চয়ই সমীচিন হবে না। আর ইসলামী শরীয়াতে নিষিদ্ধ এমন কোথাও বিনিয়োগ করে নিজের ইবাদত-বন্দেগীকে নষ্ট করবেন না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।