আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণরোষ আতঙ্কে এমপিরা

মহাজোটের অনেক সংসদ সদস্য এবার ঈদে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারেন। দলের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, গত সাড়ে চার বছরে সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশ না নেওয়া, এলাকার উন্নয়ন না করাসহ অঙ্গীকার খেলাফের দায়ে তাদের গণরোষে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কঠিন এই পরিস্থিতি এড়াতে এক বছর ধরে অনেক মন্ত্রী-এমপিই এলাকায় যান না। ধারণা করা হচ্ছে, আতঙ্কের মুখে এবার ঈদেও অনেকেই নির্বাচনী এলাকায় পা দেবেন না।

জানা গেছে, মহাজোটের সংসদ সদস্যদের মূল সমস্যা নিজ দলে।

কারণ জনবিচ্ছিন্ন এই নেতাদের ভালোভাবে নিচ্ছেন না কর্মীরা। অনেক সংসদ সদস্য গত বছর ঈদের আগে পরে নিজ এলাকায় লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। যশোর এলাকায় এক সংসদ সদস্যের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পিস্তল উঁচিয়ে বাঁচতে হয়েছিল আরেক সংসদ সদস্যকে। সূত্রমতে, পরিস্থিতির উত্তরণতো হয়ইনি, বরং অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা আগের চেয়েও বেশি ক্ষুব্ধ।

আর সাধারণ মানুষও চরম বিরক্ত।

সূত্র জানায়, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পর ১৮টি জেলার ৪২টি স্পটে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় শিবির কর্মীরা। সবার প্রত্যাশা ছিল স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবে কেউই তখন মাঠে যাননি। তারা ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়াননি।

আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা সেই সময় অরক্ষিত অবস্থার মধ্যে পড়ে যান। দল ক্ষমতাসীন থাকলেও অনেকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ওই সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুরসহ এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু সংসদ সদস্যরা বাস্তবমুখী ভূমিকা না নেওয়ায় এখনো কোনো হামলার বিচার হয়নি। এমনকি দোষীরা আটক হননি।

ক্ষমতায় থাকাকালে মন্ত্রী-এমপিদের এমন আচরণে আওয়ামী লীগ কর্মীরা বিস্মিত। শুধু মন্ত্রী-এমপি নন কেন্দ্রীয় নেতারাও তখন এলাকায় যাননি। এবার কেন্দ্র থেকে সবাইকে এলাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারপরও গণরোষ আতঙ্কে অনেক মন্ত্রী-এমপির এলাকায় না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের মধ্যে প্রথম ২০১০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আক্রমণের শিকার হন বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনের মনিরুল ইসলাম মনি।

ঢাকা থেকে বরিশাল নগরীর ল' কলেজ এলাকায় নিজ শ্বশুরবাড়ির সামনে রাত ২টার দিকে তিনি অতর্কিত হামলার শিকার হন। দলেরই নেতা-কর্মীরা এ হামলা চালায় বলে জানা যায়। একই বছরের ১৪ নভেম্বর নিজ বাড়িতে হামলার শিকার হন কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের সংসদ সদস্য আফাজউদ্দিন আহম্মেদ। তার বাড়িতে বোমা হামলায় তিনজন নিহত হন। নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য কবরী সরোয়ার বেশ কয়েকবার হামলার শিকার হয়েছেন।

পাগলার মুন্সিখোলা এলাকায় গত বছর ৪ নভেম্বর তার গাড়িবহরে হামলা চালান আওয়ামী লীগেরই স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। সরকারের মেয়াদের তৃতীয় বছরে ২০১২ সালে একের পর এক ঘটতে থাকে হামলার ঘটনা। বছরের শুরুতে ২৮ জানুয়ারি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জনবল নিয়োগ নিয়ে লাঞ্ছিত হন গঙ্গাচরার সংসদ সদস্য, এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ। সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির এ এমপির মাথা লাঠির আঘাতে ফেটে যায়। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, জাতীয় পার্টির লালমনিরহাটের সংসদ সদস্য মজিবর রহমানের ওপর ৪ এপ্রিল হামলা চালান সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা।

খুলনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ননী গোপাল মণ্ডলকে ১৪ এপ্রিল চড়কপূজায় অতিথি না করায় তার হাতে দাকোপ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জয়ন্তী রানী সরদার লাঞ্ছিত হন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও এলাকাবাসী সংসদ সদস্যকে লাঞ্ছিত করেন। এর দুই দিন পর এলোপাতাড়ি কুপিয়ে নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর গাড়িটি ক্ষতবিক্ষত করে দলীয় সন্ত্রাসীরা। ঢাকার সংসদ সদস্য সানজিদা খানমের ওপর ৩১ মার্চ হামলা চালান দলের অন্য পক্ষের নেতা-কর্মীরা। সানজিদার মঞ্চও ভাঙা হয়।

১৯ মে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিনের ওপর হামলা চালান তার নির্বাচনী এলাকার লোকজন। এর আগেও বিভিন্ন সময় লাঞ্ছিত হওয়া গিয়াস এ দিন তার লাইসেন্স করা পিস্তল উঁচিয়ে জনগণের উদ্দেশে গুলি ছোড়েন। ক্ষুব্ধ জনতা পরে তার গাড়ি ভাঙচুর করে। নিজ নির্বাচনী এলাকা যশোরে ২ জুন হামলার শিকার হন সংসদের হুইপ আবদুল ওহাব। তারসহ কয়েকটি গাড়িতে আগুনও ধরিয়ে দেন বিক্ষুব্ধরা।

জানা যায়, সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে এসে সাধারণ মানুষ ও দলীয় কর্মীদের মধ্যে এই ক্ষোভ আরও বেড়েছে। চলতি রমজানে নিজ এলাকায় কর্মীদের তোপের মুখে পড়েন সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইসহাক হোসেন তালুকদার। মুরাদপুর ফাজিল মাদ্রাসা মাঠে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ইফতার মাহফিলে ঘটে এ ঘটনা। পরে পুলিশি প্রহরায় তাকে এলাকা ছাড়তে হয়েছে। বিগত সাড়ে চার বছরে নির্বাচনী এলাকায় দলীয় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ না নেওয়া, সুবিধাভোগীদের দিয়ে টিআর-কাবিখার কাজ করানো, দলীয় নেতাদের অবমূল্যায়নের পাশাপাশি জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এই ক্ষোভের কারণ।

এ বছর ঈদে তার এলাকায় যাওয়া অনিশ্চিত। একই অবস্থা ঝালকাঠি-১ আসনের সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনেরও। নির্বাচনী এলাকার রাজাপুর থানা অডিটোরিয়ামে গত ৫ জুলাই দলীয় নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়ার পর আর এলাকামুখী হননি। ঈদ করবেন ঢাকার বনানীর বাসায়। ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর মামলার রায়ের পর পাবনা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মী জামায়াতের তাণ্ডবের শিকার হন।

কিন্তু সংসদ সদস্য শামসুল হক শরিফ তাদের পাশে দাঁড়াননি। অন্যদিকে, গাইবান্ধা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে রাব্বী মিয়া তার নিজ দলের নেতা-কর্মীদের রাজনীতির শিকার হয়ে এখন এলাকায় অবাঞ্ছিত। তার আসনে দলীয় সব কর্মী এখন সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতার অনুসারী। সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা থাকলেও ফজলে রাব্বী দলীয় কর্মীদের কারণে এলাকায় যেতে পারছেন না। তাকে এবার ঈদে নির্বাচনী এলাকার বাইরে জেলা সদরেই হয়তো থাকতে হবে।

নেত্রকোনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন গত সাড়ে চার বছরে বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছেন বিদেশে। এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাননি। ঝিনাইদহ-২ আসনের সফিকুল ইসলাম অপু সাড়ে চার বছর কাটিয়েছেন গার্মেন্ট ব্যবসার ব্যস্ততা নিয়ে। তাই এলাকার কর্মীরা এখন তার সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন বোধ করেন না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন এলাকার সংসদ সদস্যরা টিআর, কাবিখাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম ও নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মে জড়িয়েছেন।

এসব কাজ ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন সংসদ সদস্যের ভাই, ভাতিজা বা কাছের লোকজন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন দলীয় নেতা-কর্মীরাই। সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যদের দাপট ও প্রভাবের কারণে ক্ষুব্ধ এ নেতা-কর্মীরা সুযোগ পেলেই বিক্ষোভ করছেন। তাদের এই অসন্তোষ আগামী নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

 



সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।