আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চোরনামচাঃ কয়েকটি চোরের গল্প।

এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি

যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আমাদের এলাকাতে খুব চুরি হত। একদিনের কথা মনে আছে, স্কুল থেকে ফিরে বাসার বাইরের ঘরে বসে চেয়ার টেবিল সব একত্র করে আমি আর আমার তিন বছরের বড় ভাই ট্যাঙ্ক বানিয়ে খেলছিলাম, হঠাৎ বাইরে ভয়াবহ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ছুটে বের হলাম। আমাদের অপ্রশস্ত গলির ভেতর বিদ্যুতের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে একজন হতদরিদ্র মানুষকে, হাত পিছমোড়া করে, আর আমাদের এলাকার মোটাসোটা একজন সেই বেঁধে রাখা লোকটাকে ভীষণ মোটা একটা লাঠি দিয়ে প্রচন্ড জোরে জোরে আঘাত করছে। মারতে মারতে ঐ লোকটার নাকমুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে এল, খালিগায়ে ছিল লোকটা, মোটা মোটা বীভৎস নীল দাগ বসে গেল তার শরীরে, তবু তাকে ছেড়ে দেয়া হলো না, একজন ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় আরেকজন এসে ধাঁই করে তার পেটে লাথি বসিয়ে দিল, সাথে সাথে গলগল করে বমি-রক্ত-লালা বেরিয়ে এল লোকটার মুখ দিয়ে। কিছুক্ষণ আগেও লোকটা তাকে ছেড়ে দিতে বলছিল, এরপর তাও বলছিল না, আসলে বলার মতো অবস্থাই আর তার ছিল না।

জবাই করে রাখা মুরগীর মতো কিছুক্ষণ ছটফট করে লোকটা স্থির হয়ে গেল। কেউ কেউ বলল, অজ্ঞান হয়ে গেছে চোরটা; কেউ বলল, মরে গেছে মনে হয়। যেই লোকটা মারছিল, সেই লোকটা কপালের ঘাম মুছে বলল, এই হারামজাদাদের এর চেয়েও বেশি মার খেয়েও কিছু হয় না, এরা তবু চুরি করে। কিছুই যে হয়নাই এর, দেখেন- বলে লোকটার অন্ডকোষে হাতের লাঠিটা দিয়ে একটা গুঁতো দিল। লোকটা অঁক করে একটা শব্দ করে সামান্য নড়ে উঠল, আর হাসির রোল উঠল চারপাশে জড়ো হয়ে থাকা নারী পুরুষের মাঝে।

এইসময় এলাকার মুরুব্বী গোছের একজন এগিয়ে এসে বললেন, এই এড়ে ছাইড়া দেও, বহুত মাইর খাইছে। জন্মের মতো এই মহল্লায় চুরি করতে আওনের সখ মিট্যা গেছে। একজন গিয়ে লোকটার হাতের বাঁধন খুলে দিল। লোকটা অনেক কষ্টে লুঙ্গির গিঁট ধরে দেয়াল ধরে ধরে উঠে বসল। - আর চুরি করবি কোনদিন? মুরুব্বী কান ধরে মোচড় দিল লোকটার।

- জ্বে না, আর জীবনেও করুম না, আমারে আর মাইরেন না, আমি মইরা যামু তাইলে। - তাইলে যা ভাগ, এক দৌড়ে যাবি। - দৌড়ানির শক্তি নাই চাচা, আমারে মাইরেন না আর। - শুওরের বাচ্চা, আবার মুখে মুখে কথা কস? মুরুব্বী কষে চড় মারল একটা লোকটার গালে। আমি ভয়ে ততক্ষণ খেয়াল করি নি, তারপর দেখলাম দূরে বসে অল্প বয়স্কা একজন মহিলা, কাজের বুয়াদের মতো শাড়ী পড়া, ফোঁপাচ্ছিল, এগিয়ে এসে লোকটার হাত ধরে টেনে তুলল।

মুরুব্বী আবার তেড়ে গেলেন- শুওরের বাচ্চার কারবারটা দেখছস? বউ লয়া আইসে চুরি করতে! আবার হাসির রোল উঠল। অল্পবয়স্কা বউ এর চেহারাতে একটা কিছুর ছাপ পড়েছিল, বড় হয়ে বুঝেছিলাম, অপমান বড় ভয়াবহ জিনিস। লোকটা তার বউ এর হাত ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে যাচ্ছিল, একজন এগিয়ে গিয়ে লোকটার পশ্চাৎদেশে কষে একটা লাথি ঝাড়ল- কুত্তার বাচ্চা, দৌড়াস না ক্যান? লোকটা প্রায় পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিল, বউ এর হাত ধরে যত দ্রুত সম্ভব চলে গেল আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি সম্ভবত। বাসায় ফিরে ব্যস্ত করে তুললাম মাকে, আম্মু, চোরকে কেন মারে? চোর কী করে? চোরকে মারতে মারতে যদি চোর মরে যায় তাহলে কী হবে? চোর কিছু করে না কেন? ভিক্ষা করলেও তো পারে।

রিকশাই বা চালায় না কেন? এই লোকগুলো যে চোরটাকে মারল, ওদের আল্লাহ গুনাহ দিল না কেন......মা কিছুক্ষণের মধ্যেই ত্যক্ত হয়ে আমাকে বকা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন। আমার সেদিন আর খেলায় মন বসল না। আমার শিশু মনে সেই চোর পেটানোর ঘটনাটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছিল, অনেক রাত আমি দুঃস্বপ্ন দেখতাম সেই চোরকে লাথি মারছে সবাই, আর মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে চোরের। ধীরে ধীরে আমার মন থেকে মুছে যায় সেই ঘটনাটা, শুধু একটা জিনিস প্রতিজ্ঞা করি, জীবনে আর যাই করি, কখনও চুরি করব না। এরপর অনেকদিন কেটে গেছে।

জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। বুক ভরা স্বপ্ন, ইঞ্জিনিয়ার হব। বন্ধুদের মধ্যে যারা সিভিল বা ইলেকট্রিকালে ভর্তি হয়েছিল তাদের কে খেপাচ্ছি 'ভবিষ্যৎ ঘুষখোর' বলে বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক জ্ঞানী, অনেক সংযত, অনেক সৎ পেশার মানুষ বলে মনে হত। ধীরে ধীরে কেটে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুটো বছর।

তৃতীয় বর্ষে উঠে বুঝতে পারলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে খুব কম মানুষই আছেন যাঁরা সত্যিকার অর্থে সৎ ও সত্যিকারের পন্ডিত। বেশিরভাগ শিক্ষকই আসলে খারাপ মানুষ, কোন না কোন ভাবে এরা দুর্নীতি করেন, যদিও আমার আগে কোন ধারণাই ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক আবার কী করে দুর্নীতি করতে পারেন? তাঁদের দুর্নীতি করার ক্ষেত্রটাই বা কোথায়? আরও অনেকদিন পর বুঝতে পারলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক যে শুধু দুর্নীতি করেন তাই নয়, এঁদের কেউ কেউ চুরিও করেন। আমার শৈশবের সেই দরিদ্র চোরের মতো পেটের দায়ে চুরি নয়, এরা বৈভব বাড়ানোর জন্য চুরি করেন। অনেকে বলে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কম, কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়, ওয়ার্কিং আওয়ার হিসাব করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন অন্য অনেক পেশার চেয়ে বরং বেশি। তাই দারিদ্র্য তাঁদের চৌর্যবৃত্তিতে উৎসাহ যোগায় ব্যাপারটা তেমন নয়।

শিক্ষকদের সবাই এমন নন, কেউ কেউ এমন, তাঁদের অধিকাংশই জ্ঞানী না হলেও অন্তত সৎ ও নির্বিবাদী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই কাজগুলো করে থাকেন হলের প্রভোস্ট পদে যাঁরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ছাত্ররা মেস করে খাবে, কে খাবে কে খাবে না সেটা ছাত্রের ব্যাপার। কেউ না খেলে তাকে ১০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে হলে সিট বরাদ্দ রাখার জন্যে? ঠিক আছে মানলাম, মেসে সবাই খেলে খাবার মান উন্নত করার সম্ভাবনা আছে, খেলাম সবাই। অনেক টাকা অনেকেই জরিমানা দিয়েছে সেটার কিন্তু কোন হিসাব নেই, নিলাম না হিসাব।

খাবারে কোন লবণ নেই, মশলা নেই, চায়ের চামুচের পরিমাণ ভাজি, এক টেবিল চামুচ পরিমাণ তরকারীর ঝোল, এক কেজি মুরগীকে ৪৫ টুকরো করে তার এক টুকরো মাংস আর বাজারের সবচেয়ে নিম্নমানের চালের মূল্য জনপ্রতি ১১০০ টাকা কী করে হয়? প্রতিদিন ছাত্ররা গালি দিত প্রভোস্ট ও ডাইনিং ম্যানেজারকে, এই মানের খাবার বাইরে খেলেও ১০০০ টাকায় খেয়ে ফেলা যায়(একজন রিকশাওয়ালার দুইবেলার খাবারের খরচ), হলে তাহলে মেস করে খাব কেন? মেস করে খাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে গড়ে খাবার খরচ কমিয়ে ফেলা, সেখানে এই অবস্থা কেন? মেস চালু করার সময় প্রভোস্টরা অনেক বাণী দেন, একটি বাণী থাকে- নিয়মিত খাবারের মান পরীক্ষা করা হবে, যদিও কোনদিন তাঁদের দেখা যায় না হলের ডাইনিংয়ে। বরং গুজব শোনা যায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে, একজন প্রভোস্ট স্যার তাঁর স্ত্রী বাসায় না থাকলে হলের মেস থেকে খাবার নিয়ে যান! এখানেই শেষ নয়, আরও আছে- আপনি মেসে দশ দিন খান আর দুই দিন খান, টাকা তাঁদের সম্পূর্ণই দিতে হবে। কোন মাসে আপনি যদি কয়েক দিন না খান, তাঁরা সেই টাকা ফেরতও দিবে না। রোজায় বন্ধ হবে বিশ্ববিদ্যালয়, ঈদের পর এসে ডাইনিং চলবে, রোজার মধ্যে কেন টাকা জমা দিতে হবে? একমাস কয়েক লক্ষ টাকা জমা থাকলে কত পাওয়া যায় সুদ? অন্তত ৫০০ টাকাও কি হবে না? দশ টাকাও হবে না? হলে এই দশ টাকার হিসাব কোথায়? হলের কর্মকর্তারাও মাঝে মাঝে চুরি করেন, কোন মাসে আপনি টাকা ফেরত পাবেন, হিসাব খুঁজে খুঁজে বের করেছেন, হয়তো পরীক্ষা/পড়াশোনার চাপে সেটা আনতে দুদিন দেরিতে গেছেন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা অহরহই হয়; এর মাঝে এক্সেল ফাইল থেকে মুছে ফেলা হয়েছে সব প্রমাণ, আপনি এখন আর কোন টাকা পান না। আপনার কাছে হল ৮ টাকা পাবে, দশ টাকার নোট দিলে আর ভাংতি থাকে না, অথচ আপনি যদি ১৮.২৫ টাকাও পান হলের কাছে, এমনিতে তো টাকা দেয় না, জোর করলে এই যুগেও কী করে যেন ১৮ টাকার সাথে খুচরো ২৫ পয়সাও বেরিয়ে আসে! চতুর্থ বর্ষে উঠে যখন প্রতিদিন ছাত্রদের গালি শুনতাম, ভাবতাম, এইসব গালির চেয়ে ভালো ছিল ছোটবেলার সেই চোর পেটানো, অন্তত ব্যাথা গায়ে লাগত, হৃদয়ে নয়।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্টদের কানে যদি পৌঁছায় এসব গালি, সেই ব্যাথার কোন মোচন কি সম্ভব? ছোটবেলায় চোর পেটাতে দেখে ভয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনেও চুরি করব না, আর এখন প্রভোস্টদের গালি দিতে শুনে প্রতিজ্ঞা করি জীবনেও চুরি করব না, তাহলে হয়ত আমার মা-বাবাকেও মানুষ এইভাবেই গালি দিবে। শেষ কথাঃ শিক্ষকদের কাছ থেকে আমারা সবসময়ই শিখি, আমি এই ধরণের শিক্ষকদের কাছ থেকেও শিখেছি। না, চুরি করা শিখিনি, শিখেছি কী করে সৎ থাকা যায়, কারণ, চোর সে যেমনই হোক না কেন, মানুষ তাঁকে কিছু না বলতে পারলেও অন্তত অন্তর থেকে ঘৃণা করে। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধরণের শিক্ষকদের সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি এই জন্যেই যে, তাঁরা চুরি না করলে হয়তো জানতে পারতাম না মানুষ শুধু চোরকে পিটিয়েই ক্ষান্ত হয় না, যাঁদের পেটানো যায় না, তাঁদের কে ভয়াবহ ঘৃণা করে। বি.দ্রঃ এই লেখার সাথে কোন চরিত্রের সাথে কেউ ব্যক্তিগত মিল খুঁজে পেলে সেটা দয়া করে নিজ দায়িত্বে পাবেন, লেখককে কোনভাবেই দায়ী করা যাবে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.