আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছয় রানি আর এক রাজপুত্র

সারাক্ষণ সিংহাসনে বসে রাজ্যের হাল-হকিকত শুনতেন, আর বিচার-আচার করতেন। এই করতে করতেই তার তার দিন কেটে যায়। যেদিন আর কারও কোনো অভিযোগ থাকে না, সেদিন মন্ত্রীমশাই বানিয়ে বানিয়েই রাজাকে নানা অভিযোগ শোনান।
না শুনিয়ে উপায় কী! সিংহাসনটুকুই তো কেবল রাজার। অন্দরমহলে ছয় রাণির ঝগড়ায় একদণ্ডও টিকতে পারেন না রাজা মহাশয়।

এই রাণি বলছেন, “তুই আমার চিরুনি নিয়েছিস!” ওই রাণি বলছেন, “তুই আমার চুলে হাত দিয়েছিস!” এমনি সব সামান্য ব্যাপার নিয়ে সবসময় রাণিদের মধ্যে খুনসুঁটি লেগেই আছে।
তা হবেই বা না কেন? এতগুলো রাণি কোনো রাজার থাকে নাকি! সব রাজার থাকে দুই রাণি- সুয়োরাণি আর দুয়োরাণি। তবু সব রাজার ঘরে সুখ থাকে না। তা রাজার যখন কেবল দুই রাণি ছিল, সুয়োরাণি আর দুয়োরাণি, বেশ চলছিল তার সংসার। কিন্তু হঠাৎ রাণিমা, মানে রাজার মায়ের খুব শখ হল রাজপুত্রের মুখ দেখার।

তাও আবার যে সে রাজপুত্র হলে হবে না!
মুখে রাজা বলেছিলেন, “তাই হবে। কোনো সমস্যা নেই। ”
কিন্তু সমস্যা একটা ছিল বটে। মারাত্মক সমস্যা। সুয়োরাণি-দুয়োরাণি কারও-ই যে ছেলেপুলে হয় না।

কিন্তু রাণিমা একেবারে অধৈর্য্য হয়ে উঠলেন একসময়। প্রতিদিন ছেলের সঙ্গে দেখা হলেই বলেন, “ও বাবা! রাজপুত্র দেখব না? কবে দেখাবি? রাজপুত্র না দেখে তো মরতেও পারছি না। ”
শেষমেষ আর কোনো উপায় না পেয়ে রাজা আরেক রাণি আনলেন ঘরে। তারপর আরেক রাণি... তারপর আরেক... কিন্তু কী যে সমস্যা, রাণিদের কোনো ছেলেই হল না। হল কেবল দুটো মেয়ে।


কিন্তু রাজার তো চাই ছেলে- রাজপুত্র! রাণিমা যে রাজপুত্র দেখবেন। রাণিমার হাত থেকে বাঁচতে রাজা ঘর থেকে বেরুনোই বন্ধ করে দিলেন। খুব ভোরে চুপিচুপি সিংহাসনে গিয়ে বসেন, আর খুব রাতে আবার চুপিচুপি ঘরে ফেরত আসেন। শেষে নিরুপায় হয়ে আবার রাণি আনলেন রাজা।
অবশেষে এই রাণির ছেলে হল।

রাজার ধমক খেয়ে মুখ কালো হয়ে যাওয়া রাজ্যের সব বদ্যি-হেকিমদের মুখে এবার হাসি ফুটল। হাসি ফুটল রাজার মুখেও।
তবু কিন্তু রাণিমার রাজপুত্রের মুখ দেখা হল না। শুধু এবারই না। এরপর রাণির আরও দুটি ছেলে হল।

কিন্তু তাদের মুখও দেখা হল না রাণিমার। তার আগেই তো ওরা আতুঁড় ঘরে মরে গেল। রাজা কাঁদলেন, রাণি কাঁদলেন, কাঁদলো হেকিম-বদ্যিরাও!
কিন্তু কাঁদলে কী সমাধান হবে? সমস্যার সমাধান করতে আবার রাণি এল রাজার ঘরে। এবার সবার কান্না ধুয়ে-মুছে একেবারে ফকফকে একটা হাসি সবার মুখে লেপে দিয়ে রাজার ঘর আলো করে এল এক রাজপুত্র। রাজপুত্র রামসিংহ! রাজ্যের সবাই খুশি।

রাণিমাও এবার খুশি মনে দুচোখ বুজলেন। আজ তার দুচোখ রাজপুত্রকে দেখেছে। ধন্য হয়ে গেল ও চোখ দুটো বুঝি!
কিন্তু তা হলে কী হবে, রাজার আর পাঁচ রাণির, মানে সুয়োরাণি, দুয়োরাণি, আলতারাণি, মিষ্টিরাণি আর ন রাণির চোখগুলো যেন একেবারে জ্বালা করে উঠল রাজপুত্রকে দেখে। রাজা অবশ্য চালাক লোক। আগেভাগেই সব বুঝে গেলেন।

রাণিরা কিছু করার আগেই রাজপুত্র আর ছোটরাণিকে সরিয়ে নিলেন এক গোপন ডেরায়।
সরিয়ে নিলে কী হবে, পাঁচ রাণি ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলল রাজপুত্রকে। আলতারাণি আর মিষ্টিরাণির রাগ ছিল বেশি। তাদের মেয়েরা থাকতে রাজার সব রাজ্য বুঝি এবার ঐ রাজপুত্রই নিয়ে গেল! রাজপুত্রকে না মেরে কী আর তাদের শান্তি আছে?
কত কায়দা যে করল তারা! সুয়োরাণি-দুয়োরাণি গিয়ে কথার মায়ায় ভুলিয়ে রাজপুত্র রামসিংহকে খাদের মধ্যে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। আলতারাণি গিয়ে চোখে কাজল দেওয়ার নাম করে বিষ মাখিয়ে অন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করল।

মিষ্টিরাণি গিয়ে মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলে মিষ্টির মাঝে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই সুবিধা করতে পারল না।
এদিকে রাজপুত্র বড় হচ্ছেন। একসময় তার বয়স আঠার বছর পূর্ণ হল। রাজাও সেদিন তার কাছে সিংহাসন ছেড়ে দিলেন।


সেদিন রাজ্যের সব লোক জড়ো হয়েছে রাজপ্রাসাদের সামনে। তা জড়ো হবে না! রাজপুত্র যে আজ সিংহাসনে বসবেন। ঐ যে এগোচ্ছেন রাজপুত্র। সিংহাসনের দিকে। ছোট রাণির হাতে মধু মেশানো দুধের গ্লাস।

সিংহাসনে বসার আগে নতুন রাজাকে এটা খেতে হয়। দীর্ঘদিনের প্রথা এটা। রাণি নিজের হাতে ছেলেকে খাওয়াবেন। আর রাজার হাতে মুকুট। ছেলের মাথায় পরিয়ে দেবেন দুধটুকু খাওয়া হয়ে গেলেই।


রাজপুত্র গ্লাসে চুমুক দিবেন, এমন সময় হঠাৎ দৌড়ে এল তার দুই দিদি- আলতারাণি আর মিষ্টিরাণির দুই মেয়ে।
আলতারাণির মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “না ভাই! ও দুধ খেও না। ”
“কেন?”
“ওতে আমার মা বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। ”
বিষ মেশানো দুধ তো আর খাওয়া যায় না। কাজেই রাজা দুধ না খাইয়েই রাজপুত্রকে মুকুট পড়াতে গেলেন।

পরে না হয় বিষ মেশানোর বিচার করা যাবে।
তখন চিৎকার করে উঠল মিষ্টিরাণির মেয়ে, “না ভাই। ওটা পর না তুমি। ”
“কেন বোন?”
“ওতে যে মা বিষ লাগিয়ে রেখেছে। ”
“কেন? সেজো আর মিষ্টি মা কেন এমন করেছেন?” রাজপুত্র অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।

সব কথা জানানো হল তাকে। বলা হল আলতারাণি আর মিষ্টিরাণির ইচ্ছের কথা। সব শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন রাজপুত্র। তারপর নিজের বড় বোন, আলতারাণির মেয়ের হাত ধরে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন, “তুমিই আমাদের মধ্যে বড়। আমি ছেলে হলে কি হবে, এই সিংহাসনে বসার অধিকার তোমারই সবচেয়ে বেশি।


রাজপুত্রের কথা শুনে তো সবাই অবাক। রাজ্যের সব্বাই খুব প্রশংসা করল রাজপুত্রের। এমনকি রাণিদের সব রাগও গলে জল হয়ে গেল। তারা তো এমন রাজপুত্রকে এতদিন হত্যা করার চেষ্টা করেছে বলে আরেকটু হলে কেঁদেই দিচ্ছিল। সব সুয়োরাণি, দুয়োরাণি, আলতারাণি, মিষ্টিরাণি আর ন রাণি এসে রাজপুত্রের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিল।


সেই থেকে রাজার ঘরে কী রাজ্যে- কোথাও আর কোনো অশান্তি রইল না। রাজা আর তার ছয় রাণি সকলে মিলেমিশে খুব সুখে বসবাস করতে লাগল।
লেখক: তরুণ গল্পকার ও অনুবাদক

সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।