আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেতের হাওয়া (১২)


আলতাব আলী পার্ক আজ ২৫ মার্চ ২০১০ইং। সকাল ১১টা। যাচ্ছি বাঙালিদের সেকেন্ড সিটি হিসেবে খ্যাত নিউহাম। তাজুল ভাই’র সাথে। গাড়ি ড্রাইভ করে করে তাজুল ভাই ছোটখাটো অনেক তথ্য দিচ্ছেন আমাকে।

গিয়ে পৌছলাম ফরেষ্টগেটে। এখানে একটি রোডের নাম গ্রীণষ্টেট। রোডের নামে এই এলাকাও গ্রীণটেষ্ট নামে পরিচিত। ঘুরে দেখলাম নিউহাম টাউন হল। এটি লোকাল মেয়রের কার্যালয়।

নিউহামের মেয়রের নাম স্যার রবিন ওয়ালস। (Sir Rabin wales) আমরা গেলাম যুক্তরাজ্যের প্রবীণ কমিউনিটি নেতা আলহাজ্ব আফতাব আলী সাহেবের বাসায়। আফতাব আলী সাহেবের বাড়ি সিলেট বালাগঞ্জের বোয়ালজুর ইউনিয়নের নুরপুর গ্রামে। যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন ১৯৬২ সাল থেকে। আছেন স্বপরিবারে।

সত্তর উর্ধ্ব মানুষ। সুতরাং তাঁর অভিজ্ঞতার ভান্ডার যে কত বেশি সমৃদ্ধ, সেটা আর না বললেও চলে। যখন এদেশে এসেছিলেন, তখন সম্ভবত দাড়িই গজায়নি। আর এখন মুখভর্তি দাড়ি সাদা হয়ে গেছে। সুযোগ পেয়ে যুক্তরাজ্যের বাঙালি কমিউনিটি সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন করলাম তাকে? তিনি আগ্রহের সাথেই আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দিলেন।

তাঁর কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিলো, আপনাদের সময় এখানে বাঙালিরা কেমন ছিলো? এখন কেমন দেখছেন? বললেন, আমরা যখন এদেশে আসি, তখন সংখ্যায় আমরা খুবই কম ছিলাম। টিকে থাকতেই সংগ্রাম করতে হয়েছে অনেক। আর এখন তো বাঙালিদের সংখ্যা অনেক। মোটামুটি দাপটের সাথেই আছে। প্রশ্ন করলাম, টাওয়ার হামলেট এবং নিউহামে তো অনেক মসজিদ দেখলাম।

এগুলো কিভাবে হলো। তিনি বললেন, একটা সময় এখানে কোনো মসজিদ ছিলই না। ১৯১৬ সালে রিজেনবাগে শুধু একটি মসজিদ ছিলো। ওল্ডগেটে গুটি কতেক বাঙালি মুসলমান বাস করতো। আরো কিছু ছিলো ব্রিকলেনে।

অনেক সংগ্রাম করে আস্তে আস্তে মুসলমানরা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে। প্রশ্ন করলাম, আলতাব আলী পার্ক সম্বন্ধে বলুন। ওটি কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো? আফতাব আলী সাহেব বললেন, ১৯৭৮ সালের কথা। তখন বর্ণবাদীরা বড়বেশি অত্যাচার করতো বাঙালিদের। একদিন আলতাব আলী নামের এক নিরীহ বাঙালিকে সাদা’রা হত্যা করে ফেললো।

বাঙালিরা প্রতিবাদ করলেন কিন্তু প্রতিকারের আগেই ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় ইসহাক আলী নামে আরেক বাঙালিকে খুন করা হলো। ফলে ফুসে উঠলো বাঙালিরা। শুরু হলো তুমূল প্রতিবাদ। আন্দোলন গড়ে উঠলো জালাল উদ্দিন, সিরাজ মিয়া, মৌলভী তৈয়বুর রহমান, আব্দুল গফুর, সালিমদার এবং আব্দুল মতলিবদের নেতৃত্বে। নিয়মিত মিছিল মিটিং ও র‌্যালি হতে থাকলো।

প্রতিদিন বাঙালিরা এসে জড়ো হতে থাকে সেখানে, যেখানে আলতাব আলীকে খুন করা হয়েছিলো। জায়গাটি তখন খোলা মাঠ। পার্কের মতো। প্রথম প্রথম একজন অন্যজনকে মিটিংয়ের দাওয়াত দিত, স্থান বলতো আলতাব আলীকে যেখানে মারা হয়েছে, ওখানে। এক সময় বাঙালিরা এটাকে আলতাব আলী পার্ক বলতে শুরু করলো।

সকল বাঙালি ঐ সময় সাদাদের অত্যাচারে অতিষ্ট ছিলো। মারতো কালোরাও। আলতাব আলীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শুরু হলো বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। মিছিল, মিটিং, হাই কমিশনে চিঠি, বিচারের দাবি। এভাবেই জন্ম হয় আলতাব আলী পার্কের।

১৯৭৯/৮০ সালের দিকে ব্রিটিশ সরকারও এটাকে ‘আলতাব আলী পার্ক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আজ ওখানে বাংলাদেশি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছে। যদিও প্রতীকি সৌধ এটি। তবে বাস্তবতা বিচারে এই শহীদ মিনারে অনেক নির্যাতিত বাঙালির রক্তের দাগ লেগে আছে। আফতাব আলী বাংলাদেশের ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন অব ইউরোপের সেক্রেটারী ছিলেন।

ওয়েলফেয়ার সম্বন্ধে তাকে প্রশ্ন করার পর বললেনÑ সর্বপ্রথম ১৯৫২ সালে পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন নামে কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এটির নাম হয় বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত ১০ বছর এর কার্যক্রম বন্ধ থাকে। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে সংগঠনটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মামলা চলে যায় কোর্টে।

কোর্ট থেকে রায় দেয় ইলেকশনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করার। সরকার ইলেকশন কমিশন তৈরি করে দেয়। সেই নির্বাচনে সভাপতি হন বিয়ানীবাজারের আব্দুল আহাদ আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জনাব আফতাব আলী। আব্দুল আহাদ হলেন বাংলাদেশের বহুল আলোচিত হাওয়া ভবনের মালিক মাশুক আহমদের চাচা। ১৯৮৩ সালে আবারো ঝামেলা শুরু হয়।

তারপর থেকে এই সংগঠনের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। বর্তমানে এসোসিয়েশনের কার্যালয়39 Fournir Steet.ব্রিকলেন মসজিদের পেছনে। বালাগঞ্জ বিশ্বনাথের বর্তমান এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরী’র নেতৃত্বে আছে সংগঠনটি। আফতাব আলী সাহেবকে আমি ৭১ নিয়ে প্রশ্ন করলাম। বললাম, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিলেত প্রবাসীরা অনেক সাহায্য করেছেন।

সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে কিছু বলুন। তিনি বললেন, একাত্তরে আমরা এখানে ‘বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি’ গড়ে তুলেছিলাম। কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করা হয়েছে এখানে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ইপসউইচ (Ipswich) এরিয়ায় কাজ করেছেন বাংলাদেশের প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের ভাগ্নে আজিজুর রহমান, মোঃ মকররম আলী, হাজি মতলিব মিয়া, বালাগঞ্জের আব্দুল মতিন চৌধুরী সহ অনেকে। দিনরাত পরিশ্রম করে কাজ করেন তৈয়বুর রহমান, গৌছ খান, নবীগঞ্জের চান মিয়া, শফিকুর রহমান, বিয়ানীবাজারের হাজি মিম্বর আলী, শামসুর রহমান, হাফিজ মজিরুদ্দিন সহ অনেকে।

কেউ ফান্ডরাইজিং করেন, কেউ আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন, আবার কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র কিনে দিয়ে সাহায্য করেন। আমি জনাব আফতাব আলী সাহেবকে প্রশ্ন করলাম আপনাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ তো স্বাধীন হলো। দেশে যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, তারা তো অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা। আপনারা যারা যুক্তরাজ্যে অবস্থান করে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অর্থের যোগান দিয়েছেন, অস্ত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আমি তো মনে করি আপনারাও মুক্তিযোদ্ধা। দেশ থেকে আপনারা কেউ কোনো সম্মান পেয়েছেন কখনো? ছলছল করে উঠলো আফতাব আলী সাহেবের চোখ।

দীর্ঘ একটি শ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। বললেন, সম্মান! সেটাতো পরের ব্যাপার। তার আগে তো স্বীকৃতি দরকার। এ পর্যন্ত তো সেটাই পেলাম না। একাত্তরের পরে উল্টো আমার ওয়াইফ’কেই বাংলাদেশে হেরাসমেন্ট করা হয়েছে।

অবশ্য এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। ব্যক্তিগত পাওয়া না পাওয়ার সম্পর্ক একাত্তরের সাথে নেই। আমরা যা করেছি, প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা থেকেই করেছি। প্রতিদানের আশায় নয়। যত দূরেই থাকি, মনটাতো আমাদের দেশেই পড়ে থাকে।

আমরা চাই প্রিয় দেশটা উন্নতি করুক। দেশ আমাকে কী দিলো না দিলো, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে, আমি আমার দেশকে কী দিতে পারলাম? বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখন। বৃষ্টির ঝিলিক আমি আবিষ্কার করলাম আফতাব আলী সাহেবের চোখেও। ১৫ কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে মনে মনে আমি ক্ষমা চাইলাম তার কাছে। বললাম, আপনাদের সহায়তায় আমরা একটি পতাকা পেয়েছি কিন্তু আপনাদেরকে সম্মান জানানোর উদারতাটুকু দেখাতে পারি নি।

আমাদের ক্ষমা করবেন। ...চলবে
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।