আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভুল বানান

শহীদের খুন লেগে, কিশোর তোমার দুই হাতে দুই, সূর্য উঠেছে জেগে। -------হাসান হাফিজ

ভুল বানান ও ভুলের সংস্কৃতি অক্সফোর্ডের সাবেক অধ্যাপক, উপমহাদেশের প্রখ্যাত কিন্তু জন্মসূত্রে ‘বাঙাল’ ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। একবার বাংলাদেশে আসার পর এক জায়গায় তাঁকে সস্ত্রীক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতার সঙ্গেই এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেখানে ‘সস্ত্রীক’ বানানে ‘স’-এর সঙ্গে ‘ব’ যুক্ত হয়, যাতে মনে হয় তিনি নিজের স্ত্রীকে নিয়েই এসেছেন, অন্য কাউকে নয়। কিন্তু এ ধরনের বানান ভুল বোধ হয় আমাদের জন্য স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।

নিজের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তদানকারী আমরা বোধ হয় ভুল বানানেও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি অথবা গেছি। তাই যদি না হবে, তাহলে ‘পথিকৃত্’ জেলা শহরের একেবারে কেন্দ্রে এ ধরনের লেখায় শোভিত হয়ে একটি ব্যানার কী করে দিনের পর দিন প্রদর্শিত হয়—‘বিজয় দিবস উপলক্ষে মাসব্যাপী/তাঁত বস্ত্র ও হস্তশিল্প মেলা-১০/উক্ত মেলায় আপনারা স্ব-পরিবারে আমন্ত্রীত?’ স্ব-র কথা আর না বলাই ভালো, দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে ‘আমন্ত্রীত’ লেখাও বোধ হয় আমাদের সয়ে গেছে। কলকাতার দেশ পত্রিকার (বর্তমানে পাক্ষিক) পঁচাত্তর বছরে পদার্পণ উপলক্ষে ২০০৭-এর ২ নভেম্বর সংখ্যায় তপন রায়চৌধুরী ‘আমাদের উচ্চশিক্ষার নিম্ন-উচ্চ’ প্রবন্ধে ভারতের উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে যা বলেছেন, আমাদের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে তা অধিকতর প্রযোজ্য। প্রবন্ধটির শুরুতেই তিনি বলেছেন, ‘এ দেশের উচ্চশিক্ষাকে একটি প্রাসাদের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, সেই বহু-মহলা পুরীর ছাদ আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু মেঝে বলে কিছু নেই।

অর্থাত্ উচ্চশিক্ষার মান কী, আমাদের দেশে এ প্রশ্ন তুললে তার কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। ’ এই অনুচ্ছেদ তিনি শেষ করেছেন এই বলে, ‘আমাদের ডিগ্রিধারীদের এক বিরাট অংশ প্রায় অশিক্ষিত থেকে গেছেন। ’ তাঁর প্রবন্ধের আরও কিছু অংশ উদ্ধার করলে বোঝা যাবে, আমাদের পরিস্থিতি তার চেয়েও কতটা খারাপ। ‘আমাদের শিক্ষা খাতে খরচের এক বিরাট অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য যেভাবে ব্যয়িত হয়, তার ফলে আমাদের উপকারের বদলে অপকারই হয়। ’ ‘প্রতি পেপারের জন্য কুড়ি থেকে ত্রিশ পৃষ্ঠা গলাধঃকরণ করে এবং পরীক্ষার খাতায় চর্বিত বস্তু উগরে দিয়ে বিদ্যালাভ সম্পূর্ণ হয়।

বাকি জীবন মা সরস্বতীর সঙ্গে মুখ দেখাদেখি না হলেও ক্ষতি নেই। ’ ‘পৃথিবীর কোনো অঞ্চলেই এ ধরনের শিক্ষাকে উচ্চশিক্ষা বলে না। ’ এমনকি স্নাতকোত্তর শিক্ষকদের কোনো কোনো ডিগ্রির অভিসন্দর্ভ পড়ে তিনি হাসবেন না কাঁদবেন ভেবে পাননি। এ রকম একটি উদাহরণ দিয়ে তপন রায়চৌধুরী লিখেছেন, ‘এক ব্যক্তি তাঁর রাজ্যে হস্তশিল্পের ইতিহাস লিখতে গিয়ে হরপ্পা থেকে শুরু করেছেন এবং উপসংহারে ওই রাজ্য সরকারে যাঁরা হস্তশিল্প দপ্তরে চাকরি করেন, তাঁদের কাকে কোথায় বদলি করা উচিত, সে বিষয়ে বিশদ মন্তব্য করেন। ’ এ বিষয়ে তাঁর শেষ দুটি মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য—‘তাঁর ডিগ্রি পেতে অসুবিধে হয়নি।

মনে করবেন না এটি বিরল দৃষ্টান্ত। ’ তিনি আরও বলেছেন, ‘ব্রাহ্মণের পইতের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ভদ্রজনের জন্য আবশ্যিক। ’ তিনি একে বলেছেন, ‘সোচ্চার শহুরে মানুষের দূরদৃষ্টিবর্জিত স্বার্থসন্ধান। ’ বাংলাদেশে বানানের নৈরাজ্য এরই নিম্নতম ও নিকৃষ্ট পরিণতি। ‘নবান্ন উত্সব, ১৪১৬’-র একটি আমন্ত্রণপত্রেও ওই ধরনের ভুল ঘটে।

বলা যায়, ভুল বানানের তাঁরা ‘পথিকৃত্’ হয়ে উঠেছেন। ‘সবান্ধবে’ এখানেও যথারীতি হয়েছে ‘স্ব-বান্ধবে’। আমন্ত্রণকারীদের একজন অ্যাডভোকেট ও অন্যজন দৈনিকের সম্পাদক হলেও ‘স’ ও ‘স্ব’-র পার্থক্য নিশ্চিতই তাঁদের অজানা। আমন্ত্রণের শুরুর বাক্যটিতেই ‘অপার্থিব’ বানান লেখা হয়েছে ‘অপ্রার্থিব’ হিসেবে। অর্থাত্ ভুল বানানের সংস্কৃতির ছড়াছড়ি।

সে জন্য ‘ধান ভানে’ হয়েছে ‘ধান বানে’। তথ্যগত ভুল তো আছেই, তদুপরি উদ্বোধকের নামটি দৃষ্টিকটুভাবে বড় হরফে লেখা ছিল। --------------------------------------------------------------------------------- অনুলেখন লেখক ও অধ্যাপক "শান্তনু কায়সার" এর রচনা হতে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।