আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বৈদেশে আমি- ডায়েরী না, কিন্তু ওইরকমই কিছু একটা... (part 1)

কবে যাবো পাহাড়ে... কবে শাল মহুয়া কণকচাঁপার মালা দেব তাহারে....

২ নভেম্বর, ২০১০। আজ সকালে প্রথম ঘাসের উপর বরফকুচি দেখলাম। দৃষ্টিনন্দন, কিন্তু সেই সাথে আগামী দুর্যোগের বার্তাও বহন করে। আইওয়া সিটি পৃথিবীর শীতলতম শহরের নাম নয়, কিন্তু তাপমাত্রা যেখানে শূন্যের চল্লিশ ডিগ্রী নিচে নামে, সেদেশে শীতকালকে হালকাভাবে নেয়ার কোন কারণ নেই; বিশেষ করে, আমার মত কোন বাংলাদেশীর জন্য। প্রথমবারের মত যুক্তরাষ্ট্রে আগমন।

প্রথমবারের মত সম্পূর্ণ একা ভ্রমণ (জীবনে কখনো দশ কিলোমিটারের বেশি একা ভ্রমণ করিনি, আর পনেরো হাজার কিলোমিটার? হাহ!)। প্রথমবারের মত একেলা এপার্টমেন্টে থাকা। মাসের শুরুতে ব্যাংক একাউন্টে বেতন জমা পড়া- এ অভিজ্ঞতাও এর আগে হয়নি। প্রথমবারের মত বাবা-মা কে ছেড়ে সাত দিনের বেশি কোথাও থাকা। এই “প্রথমবারের মত”-র তালিকা শেষ হবার নয়।

আমার সম্পূর্ণ দুনিয়াটাকে কেউ হাতে ধরে উল্টে দিয়েছে যেন। এ অনুভূতি ঠিক ভালো লাগার মত নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে জীবনের বিশেষ একটা সময় কেটেছে। ছয় বছর। যুক্তরাষ্ট্রের কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করতে যাব- এই পরিকল্পনা শুরু থেকেই ছিল।

ধীরে ধীরে সেটা আকৃতি পেতে থাকে ২০০৯ সালের জুলাই-আগস্ট থেকে। টোএফল, জিআরই ইত্যাদি পরীক্ষা দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এপ্লিকেশন পাঠানো, তারপর তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষা। … তারপর একটা অফার এক্সেপ্ট করে ভিসার জন্য আবেদন করা। ওদিকে বাইরে যাবার প্রস্তুতি নেয়া। মোটামুটি একটা বছর লেগে গেছে এসবের পেছনে।

ধীরে ধীরে সময় ঘনিয়ে আসে। উৎসাহ-উত্তেজনায় রাতে ঘুম আসেনা। কবে যাব স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়! সময়ও এসে যায়। আম্মু-আব্বু আর আমার ছোট ভাই, তার সাথে এক দঙ্গল ভাই-বোন, চাচা-চাচী, মামা-মামী প্রমুখ-… সবাই এসেছে আমাকে সি-অফ করতে। হৈ-হল্লায় পুরো নরক গুলজার শুরু কে দিয়েছিলাম সবাই মিলে।

মোটামুটি হাওয়ার ভেসে ভেসে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালাম। তারপর হঠাৎ কি যেন একটা হয়ে গেল। হৃদয়ের কোন একটা গোপন কোণে কোন একটা সুক্ষ্ম অনুভুতি হঠাৎ করে সবকিছু ছাপিয়ে একাকার করে দিল। মনে হল যেন ছুটে পালিয়ে যাই। ওই লাইনটা একবার পার হলে আমার বাবা-মা’র সাথে একটা পাকাপাকি বিচ্ছেদ ঘটবে।

এরপর আর ক’বছর পর দেখা হবে- জানা নেই। প্রথমে চোখের কোণে হালকা জলের বিন্দু দেখা দিল, তারপর হুহু করে কেঁদে উঠলাম। ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে কাঁদছি। পেছন ফিরে আম্মুকে দেখার চেষ্টা করলাম। ঝাপসা চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা।

রুমাল বের করে চোখ মুছলাম। আবার তাকালাম। আম্মু শক্ত করে একটা লোহার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে। ভাবলেশহীন। হয়তো একটু হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু পারলনা।

আম্মু আবার ঝাপসা হয়ে গেলো। শিকাগো এয়ারপোর্ট অত্যন্ত ব্যস্ত এয়ারপোর্ট। প্লেন থেকে নেমেই দেখি হাজার হাজার মানুষ। এখান থেকে আমাকে সিডার র‍্যাপিডস এর প্লেন ধরতে হবে। ইমিগ্রেশনের লাইনটা এঁকেবেঁকে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা।

ইমিগ্রেশন পার হয়ে, লাগেজ কালেক্ট করে শাটল ট্রেনের জন্য দোতলায় উঠেই বিপত্তি। এয়ারপোর্টের একজন কর্মচারী আমাকে বলল, এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে লাগেজ জমা দিয়ে খালি হাতে ইন্টারনাল টার্মিনালে যেতে। আমি আবার ফিরে এলাম। ততক্ষণে এমেরিকান এয়ার এর কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। আবার দোতলায়।

লাগেজ নিয়েই ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম। কিছু বোঝার আগেই দেখলাম, ট্রেনের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছি আমি আর আমার ৩০ কেজির দুটো লাগেজ। শাটল ট্রেনের ত্বরণ যে এত বেশি হয়, জানা ছিলনা। বাকি যাত্রীরা সবাই আমাকে দেখেও না দেখার ভান করল।

টার্মিনাল ৩ এ পৌঁছে একবার দেশে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। জানতে পারলাম, ফোন করার জন্য কলিং কার্ড কিনতে হবে। কিনলাম। কিন্তু, ফোন বুথে ব্যবহার করার জন্য কোয়ার্টার (২৫ সেন্ট) লাগবে। টাকা ভাঙানোর জন্য একটা কোকাকোলা কিনলাম।

দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, “হাউ মাচ?”… “টু-ফিফটি”…!!! আমার ভিরমি খাবার যোগাড়। একটা আধা লিটারের কোকাকোলার বোতলের দাম আড়াইশ ডলার? আমি ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, “ডিড ইউ সে টু-ফিফটি ডলার?” জবাব এল: “টু ডলার এন্ড ফিফটি সেন্টস”। শুনে ধড়ে প্রাণ এলো। প্লেন আধা ঘন্টা লেট। এমেরিকান এয়ারওয়েজ এর সময়জ্ঞান বাংলাদেশ বিমানের থেকে কোন অংশেই ভাল নয়।

ঘন্টায় ১৫-২০ টা ফ্লাইট অপারেট করছে, একটাকেও সময়মতো ছাড়তে দেখলাম না। আমাদের সিডার র‍্যাপিডস এর প্লেন নিয়ে তো রীতিমত একটা নাটক হয়ে গেল এয়ারপোর্টে। প্লেনে সিটের সংখ্যা ৩০। কিন্তু, কোন কারণে ওরা টিকেট বিক্রি করেছে ৩১টা। যাত্রীদেরকে অনুরোধ করলো, কেউ যদি একটা টিকেট বিক্রি করতে রাজি থাকে, কর্তৃপক্ষ পুরো মূল্য দিয়ে কিনে নেবে।

কিন্তু, কেউই নিজের টিকেট বিক্রি করার আগ্রহ দেখাল না। শেষ পর্যন্ত ওরা টিকেট আসল মূল্যের তিনগুণ দাম দিয়েও কিনে নিতে চাইলো। তার সাথে ফাইভ স্টার হোটেলে এক রাত থাকা-খাওয়া, আর পরের দিনের প্রথম ফ্লাইটে বিনামূল্যে সিডার র‍্যাপিডস পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি। তবুও যাত্রীদের মন গলল না। শেষে ওরা ঘোষণা দিল, যে সবার শেষে লাইনে দাঁড়াবে, তার এই প্লেনে যাওয়া হবেনা।

মনে মনে ভাবলাম, বাংলাদেশ হলে এতক্ষণে গণধোলাই শুরু হয়ে যেত! প্লেনে এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয়। আমি আমেরিকায় নতুন- শুনে আমাকে বললেন, যেন আমার সব প্রয়োজনের কথা তাঁকে বলি। তাঁর চার্চ নতুন ছাত্রদের সব ধরণের সহযোগিতা করে। বিনামূল্যে আসাববপত্র ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান দেয়, যাতায়াতের জন্য গাড়ির বন্দোবস্ত করে, ইত্যাদি। আমি মোটামুটি অভদ্রভাবেই লোকটার প্রতি চরম উদাসীনতা দেখালাম।

কেন, কে জানে! হয়তো লোকটাকে আমার খুব বেশি সুবিধার মনে হয়নি! রাতের সাড়ে এগারোটায় প্লেন আইওয়ার মাটি ছুঁলো। আগের থেকেই শাটল কার বুক করা ছিল। সে গাড়ি আমাকে আইওয়া সিটি পৌঁছে দিল। রাতটা হোটেলে কাটিয়ে পরের দিন সকালে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এপার্টমেন্ট অফিসে রিপোর্ট করলাম। অফিস থেকে আমার মালপত্র আমার এপার্টমেন্টে পৌঁছে দিল জিম নামে এক লোক।

আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে ও অত্যন্ত উৎসাহের সাথে জানাল, যে সে বাংলাদেশের জন্য বিটলসের আয়োজিত কনসার্টটা দেখেছিল। সেখান থেকে সে বাংলাদেশের নাম জেনেছে। শুনে কি ধরণের অনুভুতি হল, সেটা ভাষার প্রকাশ করা অসম্ভব। যাই হোক, জিম আমার জীবনে দেবদুত। সে বলল, আমার যা কিছু কেনাকাটা করা দরকার, আমি তাকে বলতে পারি; সে তার গাড়িতে করে আমাকে বিভিন্ন দোকানে নিয়ে যাবে, এবং সবকিছু কিনে দেবে।

এরপর পুরো এক সপ্তাহ ধরে জিম আমার সাথে টইটই করে পুরো শহর ঘুরে বেরিয়েছে, আর আমার সব প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সে তার এবং তার পাড়া-পড়শীদের বাসা থেকে অব্যবহৃত বাসন-কোসন, চেয়ার-টেবিল, ফ্যান, মাইকোওয়েভ, টেবিল ল্যাম্প, আরো কত কিছু এনে দিয়েছে, তা বলে শেষ করার নয়। নতুন শহরে নতুন জীবন এত সুন্দর করে শুরু করতে পারার পেছনে শতভাগ অবদান জিমের। সে অবদান শোধ করা সম্ভব নয়। এপার্টমেন্টটাকে একটু গুছিয়ে নিয়ে একদিন ক্যাম্পাসে গেলাম।

ছবির মতো সুন্দর একটা ক্যাম্পাস। দেখছি, আর মুগ্ধ হচ্ছি। ঘন্টাখানেক ঘুরে বেড়ালাম। ততক্ষণে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। রোস্তোঁরার অভাব নেই।

কিন্তু ভেতরে ঢোকার সাহস হল না। আমেরিকান কোন খাবারের নাম জানিনা। কিভাবে অর্ডার করতে হয়, তাও জানিনা। ঢুকি-ঢুকি করেও ঢুকতে পারলাম না। শেষে একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে রাস্তার মাঝে পাকড়াও করে জিজ্ঞেস করলাম, যে আমি কিছু খেতে চাই।

ভাত-রুটি- কিছু একটা। কিন্তু, কোন রেস্তোঁরায় ঢুকবো বুঝতে পারছিনা। ব্যাপারটা হাস্যকর হতে পারে, কিন্তু ভদ্রলোক আমাকে সিরিয়াসলি নিলেন। আমাকে একটা রেস্তোঁরা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, যে এখানকার খাবার ভাল, দামেও সস্তা। রেস্তোঁরার নাম ‘পানচিরোস’ (Pancheros)।

ঢুকে প্রথমে খাবারের মেন্যুর দিকে চোখ বুলালাম। খাবারের নাম tortilla, quesadilla, burrito, ইত্যাদি। অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম নামগুলো। কিছুই বুঝতে পারলাম না। তারপর দোকানের কর্মচারীদের শরণাপন্ন হলাম।

জিজ্ঞেস করলাম- “হোয়াট ডু ইউ হ্যাভ ফর লাঞ্চ?” সে আমাকে উত্তরে একটা কিছু বলল ঠিকই, কিন্ত আমি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। আবার জিজ্ঞেস করলাম। আবার আজগুবি ভাষা কিছু একটা বলল, আমি আবারো কিছু বুঝলাম না। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। হায়! আমেরিকায় এসে এই প্রথম কোন রেস্তোঁরায় খেতে ঢুকেছি, আর সে রোস্তোঁরার সব কর্মচারী মেক্সিকান! আর শুধু তাই নয়, তারা এক বর্নও ইংরেজি বোঝেনা! বোঝে শুধু মাতৃভাষা স্প্যানিশ! শেষে সে তার নিজের পছন্দমত আমাকে কিছু একটা বানিয়ে দিল, আর আমিও তা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করলাম।

খাবারটি কিন্তু বেশ সুস্বাদু ছিল! পরে জেনেছিলাম, এর নাম quesadilla। (to be continued) ২য় পর্ব: Click This Link ৩য় পর্ব: Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।