আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্যালাইডোস্কোপ : প্রতিবিম্বের গোলক ধাঁধা

লেখক/কবি
ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহ্বর থেকে কোন কিছুই বের হতে পারে না। সেখানকার আলোর কণাগুলো পর্যন্ত এই অসীম অভিকর্ষের ফাঁদে বন্দী। এ ধরনের কোনকিছু এখনো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কল্পনার বাইরে। তিন মাত্রার এমন জগতে বসে সেই অসীম মাত্রার জগৎ সম্বন্ধে ধারণা করার চেষ্টা আসলেই যথেষ্টই কঠিন কাজ। তবে হাল ছাড়বেন না।

ব্ল্যাকহোলের মতো জটিল জগৎ সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পেতে আমাদের সাহায্য করতে পারে কোনো আলোর ফাঁদ। যে ফাঁদ থেকে আলো বের হবে না বরং বারবার প্রতিফলিত হবে আর ঘুরপাক খাবে। আলোর এমন একটি ফাঁদ হচ্ছে ক্যালাইডোস্কোপ। এর মূল বিষয়টি খুব সহজ। কতগুলো প্রতিফলক তলের সাহায্যে খানিকটা জায়গা বন্ধ করে নিতে পারলেই তৈরি হবে একটি আলোর ফাঁদ।

তবে, খেয়াল রাখুন, এর ভেতরের দিকের তলে থাকতে হবে প্রতিফলন ৰমতা। এরকম কোন জায়গায় বন্দি আলোকরশ্মিগুলো বার বার প্রতিবিম্বিত হবে। ফলে যে দৃশ্য তৈরি হবে তা কিন্তু দেখতে যথেষ্টই বিস্ময়কর। প্রতিবিম্বের ওপারে প্রতিবিম্ব। দিগন্তহীন।

সীমানাহীন অথচ সংক্ষিপ্ত এক জগৎ। একই বস্ত'র প্যাটার্ন ঘুরে ফিরে গঠন করবে আকর্ষণীয় জ্যামিতিক ত্রিমাত্রিক ফ্র্যাক্টাল চিত্র। বিষয়টি খানিকটা পরিস্কার হবে লিফটে ওঠার পর চোখ-কান খোলা রাখলে। লিফটের ধাতব দেয়াল জুড়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে খেয়াল করেছেন কি? চার দেয়ালের সম্পুর্ণ বন্ধ ঈষৎস্বচ্ছ এই প্রতিবিম্বের ঘরে কি নিজেকে কখনো একলা আবিষ্কার করতে পেরেছেন। পারার কথা নয়।

হলিউডি সিনেমা মেট্রিক্স রেভ্যুলিউশনের কোনো দৃশ্যের মতোই আপনার অনেকগুলো ক্লোন দেখতে পাবেন লিফটের দেয়াল জুড়ে। তবে এটি আরো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হলে আপনাকে ঢুকতে হবে প্রাচীন কোন জমিদার বাড়ির সাজ ঘরে। এক সময় দামি আয়নার তৈরি কাচের সাজঘরে বসে জমিদার বাড়ি ও রাজ প্রাসাদের নারীরা সৌন্দর্য চর্চায় নিজেদের দেহ সুষমার প্রতিটি অংশকে নানাভাবে দেখার সুযোগ পেতেন। আবার এমন গল্পও শোনা যায়, কোথও দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নিজের একাকীত্ব ভুলে থাকার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিভৃত এই ঘরে সময় পার করতেন দুঃখী কোন প্রাসাদ রমণী। আলোর গোলক ধাঁধার মজাদার এই ঘরের বৈচিত্র্য দৃশ্য দর্শকদের কাছে তুলে ধরার জন্য এমন একটা কুঠুরি কিন্তু সত্যিই রয়েছে ঢাকার বিজ্ঞান যাদুঘরে।

দামি আয়না দিয়ে তৈরি সম্পুর্ণ কাচের এই কুঠুরিতে ঢোকার পর নিজের মাঝেই নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হয়। সঙ্গী সমেত ঢুকলে তো কথাই নেই। প্রতিবার এক চুল স্থান বদলের জন্যই অবতারণা হয় নতুন সব দৃশ্যের। এ সময় আলোর এই গোলক ধাঁধাঁ সবার মনে খানিকটা হলেও বিস্ময়ের জন্ম দেয়। ছোট বা বড় আয়তাকার আয়নার বদ্ধ সুরঙ্গই হচ্ছে ক্যালাইডোস্কোপ।

এটি আসলে প্রতিবিম্বের ফাঁদ ছাড়া অন্য কিছু নয়। নামের ধাঁধা : ক্যালাইডোস্কোপ শব্দটি একটু কঠিন শোনালেও এর জন্য মোটেই ইংরেজদের দায়ী করা চলে না। কারণ গ্রীক শব্দ ক্যালস যার মানে হচ্ছে সুন্দর এর সঙ্গে ইডস অর্থাৎ আকৃতি এবং স্কোপো মানে দেখা এই তিনটি শব্দ মিলিয়ে শব্দটি তৈরি করা হয়েছে। যার পুরো মানে দাঁড়ায় সুন্দর গড়নের দিকে চেয়ে দেখা। তাই কঠিন হলেও একে বাদ দিয়ে অন্য কোন নাম যেন কল্পনাই করা যায় না।

আবিষ্কার : ক্যালাইডোস্কোপ আসলে অনেক পুরাতন একটি যন্ত্র। প্রাচীন গ্রীকরাও এর কথা জানতো। সে সময়ের বিভিন্ন বইপত্র ও প্রাচীন নিদর্শন এমন ইঙ্গিত বহন করে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবার পর ১৮১৭ সালে আলোর পোলারাইজেশন ধর্ম নিয়ে গবেষণার সময় পুনরায় এটি আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী ডেভিড ব্রিউস্টার। ১৮১৭ সালে তিনি এর পেটেন্ট করান।

আরো পরে এক সময় তার এই বৈজ্ঞানিক যন্ত্রটি বাচ্চাদের খেলনায় পরিণত হয়। ব্রিউস্টার ভেবেছিলেন যুগান্তকারী এই আবিষ্কার তাকে অর্থ উপার্জনে সাহায্য করবে। কিন্তু পেটেন্ট নেবার সময় সামান্য ভুলের কারণে তিনি আবিষ্কারটি অন্যদের অনুকরণের কথা লিখেছিলেন। আর এ কারণেই তার সে আশা ভেস্তে যায়। একই মাপের তিনটি কি চারটি আয়তাকার আয়না অথবা কাঁচ নিন।

এদের তিনটিকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে পাশাপাশি জোড়া দিয়ে তিন তলের এবং ৯০ ডিগ্রি কোণে বা সমকোণে জোড়া দিয়ে চার তলের ক্যালাইডোস্কোপ তৈরি করা খুবই সহজ কাজ। কাঁচের নল তৈরি করার পর এর খোলা প্রান্তের এক পাশে পর পর দুটি প্লাস্টিকের সিট কাগজের ফ্রেমের মাধ্যমে সামান্য দূরত্ব রেখে সেঁটে নিন। আগে থেকেই প্লাস্টিকের সিট দুটোর মাঝে ছোট আকারের রংবেরঙের বস্তু ঢুকিয়ে নিন। সম্ভব হলে একই মাপের শক্ত প্লাস্টিকের চেম্বার লাগিয়ে নিতে পারেন। এ ধরনের চেম্বারে তরল ভরে নিলে আরো ভালোভাবে ক্যালাইডোস্কোপের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা যায়।

নক্সার বৈচিত্র্যও পাওয়া সম্ভব এর মাধ্যমে। চেম্বার লাগানোর পর মোটা কাগজে বাইরের দিকটি মুড়ে অন্য প্রান্তটি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের কাগজ বা কাঁচ দিয়ে বন্ধ করে স্কচ টেপ দিয়ে আটকে নিন। হাতের কাছে আয়না না পাওয়া গেলে কেবল কাঁচ দিয়ে নল তৈরি করে ভাল কাগজে মুড়ে নিলেই হবে। আলাদা চেম্বার তৈরি করতে না পারলে ঈষৎস্বচ্ছ কাগজ দিয়ে এক মুখ বন্ধ করে সরাসরি নলের ভেতর পুঁতি, কাঁচ বা কাগজের টুকরো ভরে নিন। তাতেও মোটামুটি ভালোই কাজ হবে।

ক্যালাইডোস্কোপ নলের ভেতর বস'কণার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের পরস্পর সজ্জারীতির সম্ভাব্যতাও বাড়বে। সঙ্গে আয়নার তলের পরিমাণ বাড়ালে প্রতিবিম্বগুলোর প্রতিফলনের বিন্যাস মাত্রা যাবে বদলে। এ ধরনের নল প্রতিবার নাড়াবার সঙ্গে এর মাঝের বস'গুলোর সজ্জারীতির বিশৃঙ্খলা যাবে বেড়ে। সঙ্গে এনট্রপির মাত্রাও বাড়তে থাকবে। এনট্রপি হচ্ছে যাবতীয় বিশৃঙ্খলা পরিমাপের একটি মানদন্ড।

এমন গাণিতিক বিশেৱষণে দেখা গেছে সাধারণ কোনো ক্যালাইডোস্কোপেও অসীম সংখ্যক নক্সা পাওয়া যায়। মজার ব্যপার হলো, সজ্জারীতির এমন বহুমাত্রিকতার কারণেই কিন্তু মাত্র চারটি প্রোটিন বেইজের অৰরে লেখা ডিএনএ দিয়ে অসংখ্য চেহারা, ভাব অবয়বের বৈচিত্রময় মানুষের আবির্ভাব ঘটছে পৃথিবীতে। কারো চেহারা, গঠন, আচার আচরণের সঙ্গে অন্যের তাই এতটা পার্থক্য। তবে হাতে তৈরি ক্যালাইডোস্কোপের সাফল্য কিন্তু নির্ভর করছে আপনার নিজস্ব মুন্সিয়ানার ওপর। এতসব করার পর সন্তুষ্ট হতে না পারলে ইন্টারনেট ঘেঁটে একটি যুতসই ডিজিটাল ক্যালাইডোস্কোপ ডাউন লোড করে নিন।

বৈচিত্র্য আনার জন্য ডেস্কটপে স্ক্রিন সেভার হিসেবে এটিকে সেভও পর্যন্ত করে রাখতে পারেন। সূত্র: বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম/সুমন/এইচবি/এইচআর/নভেম্বর ১৮/০৯ (ঈদ সংখ্যা টেক-ভি ম্যাগ এ প্রকাশিত)
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.