আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণিত যাত্রা ২০১১ : প্রথম পর্ব

অলসদের দিয়ে কী আর হয়। আলসেমি ছাড়া!

১৯ ডিসেম্বর রোববার আমাদের এবারের গণিত যাত্রা শুরু হয়েছে। এ যাত্রাটির জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি, নানা কারণে। গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার বেলায় স্যারদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর এটি আমাদের একমাত্র উপায়। কাজে, গণিত যাত্রায় আমাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আলোচনা হয়।

যেমন - গত একবছরের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন। লুৎফুজ্জামান স্যার, জাফর স্যার, কায়কোবাদ স্যার, হুমায়ুন কবীর, ইলিয়াস স্যার, রাশেদ তালুকদার, খোদাদাদ খান স্যার সহ মুকুল ভাই অন্যরা থাকেন। আমাদের একাডেমিক কাউন্সিলর সোহাগ ও সুবিন, কোঅর্ডিনেটর সুব্রত, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা (এবারে অভীক রায়), কোর কোর্ডিনেটর (এবার জুয়েল), সেন্ট্রাল মুভার্স টিমের সদস্যরা এবার নিউ মিডিয়া টিমের সদস্য। কাজে আলোচনাটা খুব জম্পেশ হয়। সঙ্গে থাকে সোহাগের গান,জাফর স্যারের 'ওয়াজিউল্লাহর গল্প', কায়কোবাদ স্যারের মজার সব অভিজ্ঞতা, লুৎফুজ্জামান স্যারের নানান গল্প।

এসবের মধ্যদিয়ে হয়ে যায় পরের বছর আমরা কী কী করবো। আলোচনাটা চলতে থাকে শেষ যাত্রা পর্যন্ত। বাহন কখনো মাইক্রোবাস, কথনো ট্রেন, বাস বা লঞ্চ। আলোচনার অনেকখানি জুড়ে থাকে স্বপ্ন আর স্বপ্নপূরণের গল্প। তা, যথারীতি এবারের যাত্রা শুরু হয়েছে।

গাড়িতে আমরা ৯ জন। আমি ছাড়া কায়কোবাদ স্যার, সোহাগ, জুয়েল, অভীক, মোহাম্মদ আলী (নিউ মিডিয়া), হাসিব, প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক মনিরুল। সঙ্গে পাইলট বিল্লাল। সবাইকে তুলে রওণা হতে হতে ৫টা। শুরুর দিকে আলাপ হচ্ছে প্রস্তুতি নিয়ে।

কাল কি হবে, সব ঠিক আছে কী না। বেশিরভাগ সময় সব কিছু আগেভাগে চলে যায়। আমাদের সঙ্গে (পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে) কিছু গোপনীয় কাগজপত্র থাকে। এছাড়া তেমন কিছু থাকার কথা নয়। এবার একটি নতুন ব্যানার করা হয়েছে- বাংলাদেশ গণিত উৎসবের ১০ বছরের ইতিহাস।

প্রতি বছরের তিনটি ছবি দিয়ে বছরটাকে ধরা হয়েছে। সেটা আমাদের সঙ্গে আছে। যে জিনিষগুলো পুন:ব্যবহার্য সেগুলো আমরা দুইটি করে তৈরি করি, যেমন ব্যানার। দুইটি পরপর দুই ভেন্যুতে চলে যায় এডভান্স টিমের সঙ্গে। ভেন্যুতে গণিতের বই-এর স্টল থাকে।

যার একটি আমাদের, ইংরেজি বইগুলো। এবার আমরা রুবিক কিউবও রেখেছি। কারণ আমরা এবার রুবিক কিউব প্রতিযোগিতা করছি। এগুলো এডভান্স টিমের সঙ্গে যায়। যাকগে।

রাত ৯টার দিকে আমরা ফুড ভিলেজে পৌছাঁলাম। সেখানেি রাতের খাওয়া। আমি প্রথমে পরোটা -মাংস খেতে চাইলাম। পরে দেখা গেল সেটার পাল্লা ভারি। ভাতের দলে লোক কম।

রাত ১০.৩০ এর দিকে আমরা বগুড়া রেডচিলিতে পৌছালাম। সকালে নাস্তা করে আমরা যখন উৎসব প্রাঙ্গণে যাই, তখন আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। কারণ স্কুলের সামনে কোন মাঠ নেই। পরে বুঝলাম মাঠঠা স্কুলের সামনের ভবনের পেছনে। সুন্দর স্কুল।

তথনো জানতাম না স্কুলের অধ্যক্ষ আরো সুন্দর মানুষ। গেলবার রংপুরের জেলা প্রশাসক ১ ঘন্টা দেরী করিয়েছিলেন। ওটা সবার দেখলাম মনে আছে। সবার সাড় বেধে দাড়ানো, জাতীয় পতাকা সঙ্গে দেশের ও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত গাওয়া। তারপর পরীক্ষা।

১ ঘন্টা ১৫ মিনিটের পরীক্ষার সময় প্রতিবার্ই ব্যাপক দৌড়াদৌড়ি থাকে কারণ প্রশ্ন সর্ট, ভুল সংশোধন ইত্যাদি। এবার সেরকম কিছু হয়নি। ফলে, প্রথম ঘন্টা নিরুত্তাপে কেটেছে। বগুড়ায় অনেক অভিভাবক এসেছে। মায়েদের সংখ্যা বেশি।

সন্তানকে নিয়ে এসেছেন। আয় আয় আয় গণিতের আঙ্গিনায় ... উৎসবের গান দিয়ে পরের পর্ব শুরু। যখন খাতা দেখা হয়। প্রশ্নোত্তর পর্বের প্রশ্নগুলোর মান খুবই ভাল। পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেশি দেখা গেল।

ওদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমাকে এক পর্যায়ে হিগস বোসন আমদানী করতে হয়েছে! এই পর্বের ফাঁকে চলেছে কায়কোবাদ স্যারের সমস্যা দেওয়া, তিন ম-কে না বলা, চার অঙ্গীকার করা। আর এবারের বিশেষ শ্লোগান - উদ্যোক্তা হও (একটি গুগল পাওয়ার তরে হাজার গুগল গড়ো)। কাজে একজন উদ্যোক্তা সেখানে ছিলেন যিনি বগুড়ার কিছু প্রোডাক্ট বিপনন করেন। সঙ্গে এখন কিছু অন্যান্য প্রোডাক্ট। তাঁর প্রতিষ্ঠানে এখন ৭৬ জন ডিপ্লোমা প্রকোশলী সহ মট ২১২ জনের কর্মসংষ্থান হয়েছে।

কী হতে চাও আমার এ প্রশ্নের উত্তরে মাত্র ৬ জন উদ্যোক্তা হতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ফলাফল ও দিনের অন্যান্য ঘটনাবলী গণিত ব্লগে আর প্রথম আলোতে পাওয়া যাবে। তবে, অন্যরা বললেও আমাকে বলতে হবে দুপুরের খাবারের কথা। আজ আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি মুজতবা আলী 'রান্নাঘরে আরো আছে'র মরতবা কী। শাক, ভাজি, দুইপদের মাছ, দুইপদের মাংস,কয়েক পদের সবজি, দই... মানে আমরা যখন মিলন ভাই এর বাসা থেকে বের হই তখন আমাদের সবার ওজন ২ কেজি করে বেড়েছে।

পথে একজায়গায় থেমে চা খাওয়া আর সরাসরি জিলা স্কুলের মাঠে যাওয়া। সেখান থেকে এখন এসেছি এই রেস্ট হাউসে। কায়কোবাদ স্যারের নতুন গণিত ব্ই-এর রিভিউ করছে সোহাগ, সুব্রতরা দিছ্ছে আড্ডা। রকি ব্যস্ত প্রশ্ন সর্টিংএর কাজে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে আমরা ঘুমিয়ে পড়তে পারবো আশা করি।

আজকের দিনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বগুড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে পরিচয়। ১৯এ১ সনে তিনি অনার্সের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। তাঁর একটি অভিজ্ঞতা শোনালেন। গেয়ে শোনালেন একটি গানের অস্থায়ী। যা যুদ্ধের সময় তিনি কোন এক মাঝির মুখে শুনেছেন।

গানের কথাগুলো অনেকটা এরকম - আমার চাউল দিয়ে তুমি খাও পোলাও আর আমারে খেতে বল তোমার গম। তা হবে না। এবার তোমায় আমরা ছাড়বো না। এমন অধ্যক্ষ আমাদের দেশের স্কুল কলেজে বিরল। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে থাকেন তিনি, তাদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টায় যোগ দেন, তাদের সঙ্গে নাচ গানে আপত্তি নেই, আমার শিক্ষার মান উন্নয়নেও লড়ে যাচ্ছেন।

তোফাজ্জল স্যারকে দেখে আমার বিপ্লবের পর রাশিয়ার কথা মনে পড়েছে। বিপ্লবের পর সেখানে প্রথম নজর দেওয়া হয় স্কুলে। বেশিরভাগ স্কুলে শিক্ষক নেই। সেনা বা নৌবাহিনীর সদস্যদের পাঠিয়ে দেওযা হয়েছে বিভিন্ন স্কুলে। তারা যতো না পড়া লেখার কথা বলছেন, তার চেয়ে বেশি বলছেন দেশের কথা, বলশেভিক বিপ্লবের কথা, সংগ্রামের কথা।

পুরো দেশজুড়ে ঘটেছে এমনটি। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশের জন্য ভালবাসাটা শুরু থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। আহা। আমরা যদি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের পর পর সব স্কুলে পাঠাতাম, তাহলে আজ আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশকে ভালবাসার কথা মনে করিয়ে দিতে হতো না। তোফাজ্জল স্যার যুদ্ধ করেছিলেন বলে কতো সহজে তিনি দেশকে সত্যিকারের ভালবাসার কথা বলতে পারেন।

তোফাজ্জল স্যার, আপনাকে সালাম। সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক। ২০ ডিসেম্বর, ২০১০

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.