আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিল্কি তারেকের হত্যা এবং উত্তরাধিকারের নেতৃত্ব

এক. ২৯ জুলাই যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য আমি টেলিভিশনে দেখি বেশ দেরিতে। আমাকে একজন ফোন করে বলেছিলেন ভাগ্য ভালো শপার্স ওয়ার্ল্ডে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ছিল। নাহলে সরকার এতক্ষণে বলে বসত বিএনপি-জামায়াত এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। টেলিভিশনে হত্যাকারী জাহিদ সিদ্দিকী তারেকের ছবি এবং হত্যার দৃশ্য উল্লেখ করে একজন আমাকে বললেন, পায়জামা-পাঞ্জাবি, টুপি পরিহিত তারেককে কিন্তু সহজেই শিবিরের ক্যাডার বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু এই সিসি টিভি সেসব কিছু করতে দিল না।

আমি জানি, দলকানা আওয়ামী লীগের যেসব নেতা, ক্যাডার আমার এই লেখা পড়ছেন তারা আমার ওপর রুষ্ট হয়েছেন। লোকটা শুরুতেই আওয়ামী লীগের নামে একটা বদনাম করার চেষ্টা করছে। দলকানাদের জন্য এই লেখা আমি লিখছি না। আমি লিখছি তাদের জন্য আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি নেতা-কর্মী যারা মন-চোখ-কান খুলে রাজনীতি করেন। বাস্তব এরকমই, যেরকম আমি বললাম।

বিশ্বাস বাবু! মারা গেছেন। কেবল যে বড় দল দুটি পরস্পর পরস্পরকে অবিশ্বাস করে তা নয়, সাধারণ মানুষও বড় দলগুলোকে বিশ্বাস করে না। জানে ওরা দায়িত্ব স্বীকার করে না, অন্যের ঘাড়ে তা চাপিয়ে দিতে চায়। আর কেবল প্রশংসা কুড়াতে চায়।

মিল্কি হত্যার পরের দিনের ঘটনা আরও মারাত্দক।

র্যাবের পাহারায় এই দুর্ধর্ষ খুনের মূল নায়ককে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল অস্ত্রের সন্ধানে। তাদের ওপর হামলা করেছে সন্ত্রাসীরা। আর পরস্পরের মধ্যে গুলিবিনিময়ে মারা গেছে জাহিদ সিদ্দিকী তারেক ও তার সহযোগী শাহ আলম। র্যাবের এই বয়ান কেউ বিশ্বাস করেছে? বেছে বেছে গত নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল এরকম ক'জনকে জোগাড় করুন এবং গোপনে তাদের মতামত জেনে নিন। দেখুন তারা কি বলে।

আমার আজকের লেখার প্রতিপাদ্য কিন্তু সেটি নয়। মিল্কিকে খুন করেছে তারেক। মিল্কি ছিল যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আর তারেক ছিল যুগ্ম সম্পাদক। কীভাবে এটি হলো? মানে কীভাবে তারা ঢাকা মহানগর যুবলীগের এতবড় নেতা হয়ে গেলেন? খুনের ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর জানা গেল এই তারেক অন্তত ৩০টি খুনের মামলার আসামি ছিল। এটা কি কেউ জানত না? এই হত্যাকাণ্ডের সবই কি তার যুবলীগের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে সংঘটিত হয়েছে? নাকি আগেও এরকম খুনের রেকর্ড ছিল তার? হঠাৎ করে একরাতে এতবড় খুনি বনে গেছে সে? পত্রিকায় প্রকাশ রিয়াজুল হক মিল্কির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল এই জাহিদ সিদ্দিকী তারেক।

তাদের মধ্যে ব্যবসার সম্পর্ক ছিল। সেই ব্যবসার কর্তৃত্ব নিয়েই এতবড় লোমহর্ষ ঘটনা ঘটল। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী যুবলীগের এক নেতার নাম ও ছবি উঠে এসেছে যিনি এই ব্যবসা ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের প্রধান নায়ক ছিলেন। মানে কি দাঁড়াচ্ছে? পত্রিকা মারফত জানা যায়, ঢাকা সিটি করপোরেশনে অন্য কারও ব্যবসা করার সুযোগ ছিল না। এর আগে যুবলীগের মহানগরের আরেক শাখার অন্যতম এক নেতার গাড়িতে যুবলীগের এক কর্মীর লাশ পাওয়া গেছে, যে মামলা এখন হিমাগারে।

এই মাত্র তিন মাস আগে সাভারের বিশ্বকাঁপানো, দেশকাঁদানো ট্র্যাজেডির নায়ক যুবলীগের এক নেতা। যুবলীগে এসব ব্যক্তি নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হলেন কীভাবে? এমনিতেই যুবলীগের গত কাউন্সিল নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। নিজেরা কমিটি গঠন করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে এ জন্য ধরণা দিতে হয়েছিল এবং অতঃপর বহু প্রশ্ন ও দ্বন্দ্বের মুখে যুবলীগের মহানগরের দুই কমিটি ঘোষিত হয়। আমি যদি ধরেও নেই যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গঠন মোটামুটি ভালোই ছিল কিন্তু তারা যে মহানগর কমিটি গঠন করলেন তা এমন হলো কেন? তারা কি এদের চিনতেন না? চিনেই করেছেন? চিনেননি? চোখ-কান বন্ধ ছিল? কিসে তাদের চোখ-কান বন্ধ ছিল? এখন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি একটি প্রেস ব্রিফিং করলেই সব দোষ ধুয়ে-মুছে ছাফ হয়ে গেল? এদের হাতে যুবকরা নিরাপদ? যুবলীগ নিরাপদ? দেশ নিরাপদ?

আমরা দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের কথা বলি।

জবাবদিহিতার কথা বলি। এখন সেই কথা আরও বেশি করে বলার প্রয়োজন হয়নি কি? নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অঙ্গসংগঠন নিষিদ্ধ করেছিল অনেকটা এসব কারণেই। আমি রাজনৈতিক দলগুলোর যুব শাখা রাখার পক্ষে। কিন্তু যা চলছে তাতে রাজনৈতিক দলগুলো ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো ব্যবহার করছে। তারা ছাত্র-যুবকদের পালছেন, পোষছেন, বড় করছেন, উসকে দিচ্ছেন।

কিন্তু তাদের মানুষ করার দায়িত্ব নিচ্ছেন না। অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের প্রতি যে দায়িত্ব তাদের থাকার কথা ছিল তারা তা পালন করছেন না। নাহলে যুবলীগের ভেতরে এত সন্ত্রাসীর বাস হতে পারে না।

দুই. পত্র-পত্রিকায় কয়েক দিন ধরে জয়-তারেককে নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়েছে। উভয়পক্ষই নাকি নতুন ধারার রাজনীতির সূচনা করবে।

আমি জানি না এরকম কথা কোথাও বলেছেন কিনা? সজীব ওয়াজেদ জয় এবার দেশে আসার পর থেকে জনসম্মুখে তার দেওয়া বক্তব্যগুলো আমি খেয়াল করে দেখেছি। নতুন কোনো কথা কোথাও বলেছেন বলে আমার মনে হয় না। তার মা তাকে যেভাবে শিখিয়েছেন, এতদিন ধরে আওয়ামী লীগ যেসব কথা বলেছে, সেগুলোই আওড়াচ্ছেন তিনি। একাত্তর টেলিভিশনকে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারে কোনো নতুনত্ব চোখে পড়েনি। সর্বক্ষেত্রে নিজেদের সাফল্য দাবি করেছেন আর বিরোধী দল বিএনপির লাগাতার সমালোচনা করেছেন।

তবুও আমি ভাবতে ভালোবাসি যেহেতু জয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আগামী দিনের কাণ্ডারি, তিনি নতুন কিছু করতে চাইবেন। কেবল ডিজিটাল বাংলাদেশের সিগনেচারটিউনে কোনো কাজ হবে না। ভারত এবং আমেরিকায় লেখাপড়া করা সজীব ওয়াজেদ জয় দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দলীয় নেতৃত্বকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেবেন। নিশ্চয়ই তিনি যুবলীগের এই কুৎসিত দাঁত বের করা চেহারায় সন্তুষ্ট নন। যুবলীগ এবং ছাত্রলীগকে এই খুনি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাস্তানদের হাত থেকে রক্ষার জন্য সক্রিয় কার্যকর উদ্যোগ নেবেন।

কেউ কেউ জয়ের অতিরিক্ত শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে হয়তো বলবেন, তিনি তো কেবল রাজনীতিতে এলেন। তাকে তো সবকিছু বুঝতে হবে। আমার জবাব তিনি মাত্র রাজনীতিতে আসেননি। ২০০৫ সালে যখন তিনি বাংলাদেশে আসেন লাখো মানুষ বিমানবন্দরে গিয়েছিল তাকে স্বাগত জানাতে। তার মা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলের ব্যানার ছাড়াই সেরকম আয়োজন করেছিলেন।

সেদিন রাজনীতিতে জয়ের অভিষেক হয়ে গিয়েছিল। পাঠকদের মনে থাকার কথা, তখন রংপুর জেলা আওয়ামী লীগ জয়কে দলের প্রাথমিক সদস্য প্রদান করেছিল। জয় প্রথম সেটা বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আবার নতুন করে দীর্ঘ ৮ বছর পর ওই রংপুরে গিয়ে অভিষিক্ত হলেন। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র বলে কথা।

তাকে কি আর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কর্মীর মতো আজীবন নিজ এলাকার মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে?

জয়ের বয়স কিন্তু কম নয়। বাচ্চা ছেলে নন তিনি। তার মা তার চেয়ে প্রায় দশ বছর কম বয়সে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়েছিলেন। আর জয় স্বাধীনতার সমান বয়স নিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে সামলাতে পারবেন না?

তিন. কোনো একটি পত্রিকায় দেখলাম তারেক রহমানও নাকি রাজনীতিতে নতুন করে অভিষিক্ত হচ্ছেন। নতুন ধারার রাজনীতি দেবেন তিনি।

মজার কথা না? তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। বিএনপিতে বেগম খালেদা জিয়ার পর তিনি। মওদুদ নন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার নন, এমকে আনোয়ার নন, খন্দকার মোশাররফ হোসেন নন। আর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তো বুদ্ধি-পরামর্শ নেওয়ার জন্য তারেক রহমানের কাছে উড়াল দিচ্ছেন। সেই তারেক রহমানের আবার নতুন করে অভিষেক কি? তিনি তো বিএনপির রাজনীতিতে অভিষিক্ত এবং প্রতিষ্ঠিত।

তিনিও কি নতুন ধারার কোনো রাজনীতির কথা বলেছেন। লন্ডনে যে বক্তৃতা তিনি দিয়েছেন তাতে নতুন সংস্কৃতির কথা বলেছেন। সে কথা তো গতবার নির্বাচনে জিতে আগেই বলেছেন। দেশের অর্থনীতির বিষয়ে, সেক্টর ধরে ধরে বেশকিছু কথা তিনি বলেছেন কিন্তু সেগুলো কোনো নতুন কথা নয়। নতুন ধারার কোনো কথা তিনি বলেননি।

তার মা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, নতুন ধারার সরকারের কথা। তার ব্যাখ্যা আমরা এখনো পাইনি।

সজীব ওয়াজেদ জয় কিংবা তারেক রহমানের কাছে যদি মানুষ শুনত যে, তারা যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন সংঘর্ষের রাজনীতি বন্ধ করবেন, দলের অভ্যন্তরে খুনি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের প্রশ্রয় দেবেন না, পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে তুলবেন_ তবেই মানুষ আশাবাদী হতো। আশার সময় শেষ হয়ে যায়নি অবশ্য। কিন্তু তাদের সেরকম কিছু বলে এবং করে দেখাতে হবে।

তাদের দুজনের মধ্যেই যদি মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকে তবে এ ব্যাপারে যিনি সততা দেখাতে পারবেন তিনিই এগিয়ে যাবেন। এই মুহূর্তে বিএনপি খানিক এগিয়ে আছেন তা সত্যি। কিন্তু সেটা খুবই আপতিক। যুবলীগের সাম্প্রতিক এই ঘটনার কথাই ধরি। বিএনপি ভাব দেখাতেই পারে যে, সেটা আওয়ামী লীগের ব্যাপার আমার নয়।

কিন্তু মানুষ অতীত ভুলে যায়নি।

অতীতের আলোকে বর্তমানকে যাচাই করে নিতে চায় তারা। বর্তমানের যুবলীগের ঘটনার মতো ঘটনা তাদের আমলেও হয়েছিল।

প্রাসঙ্গিকতার প্রয়োজনে একটি ঘটনার কথা বলি। '৯১ এ ছাত্রদলের সম্মেলনে রিজভী-ইলিয়াস কমিটি গঠিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীরা তা মানেনি। প্রতিদিন নিজেরা দিনভর গোলাগুলি করত। এরই মধ্যে বেগম জিয়া বিদেশ যান। সূর্যসেন হলে আক্রমণ করে ছাত্রদলের এক গ্রুপ। মামুন নামে একজন খুন হয় সূর্যসেন হলে।

বেগম জিয়া বিদেশ থেকে ফিরে ছাত্রদলের কমিটি বাতিল করে দেন। গ্রেফতার করা হয় ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে। এ নিয়ে আর কথা বাড়াব না। প্রাসঙ্গিকতার কারণেই ইলিয়াস আলী নামটি আনতে হলো। যাকে আর কোনো দিন দেখতে পাব কিনা জানি না।

এই মৃত্যু উপত্যকা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় দেশবাসী। জয়-তারেক কি সেই নতুন পথের সন্ধানী?

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য

ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.