আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ড. ইউনূসকে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

আমি কবি নই তোমাদের একজন, আমি কবি নই প্রেমিক তোমাদের...

বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি দেশে এবং বিদেশের গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন। যে সংবাদটি নিয়ে এতো হৈ-চৈ তার সূত্র ইউরোপের দেশ নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ৩০ নভেম্বর প্রদর্শিত 'ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে' নামে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র এবং প্রথমে সংবাদটি বাংলাদেশে পরিবেশন করেছে একটি এদেশীয় বেসরকারি সংবাদ সংস্থা। ছবিটির নির্মাতা ডেনমার্কের চলচ্চিত্রকার পল হাইনেম্যান। সংবাদটি বাংলাদেশের কিছু কিছু প্রিন্ট মিডিয়াতে এমনভাবে ১লা ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় যে, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস কোটি কোটি ডলার ব্যক্তিস্বার্থে হাতিয়ে নিয়েছেন। বিষয়টি সেখানে থেমে থাকেনি।

তা নিয়ে পরবর্তী কয়েকদিন ধরে কোনো কোনো গণমাধ্যম ড. ইউনূস সম্পর্কে লাগাতার সংবাদ প্রকাশ করেছে। ইন্টারনেটের বিভিন্ন বস্নগেও আমাদের এই নোবেল বিজয়ীর পক্ষে-বিপক্ষে এখনো নানা মন্তব্য প্রচারিত হচ্ছে। এখানে দুটি বিষয় উলেস্নখ্য, পল হাইনেম্যান কী গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে এই ছবি বানিয়েছেন? না, তা কিন্তু নয়। ছবিটি হাইনেম্যানের একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনের অংশ যাতে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা কখনো দারিদ্র্য দূরীকরণের সহায়ক নয়। বরং ক্ষুদ্র ঋণ দরিদ্রকে আরো দরিদ্র করে এবং ঋণগ্রহীতা আরো ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

তিনি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করতে একাধিকবার সস্ত্রীক (তাঁর স্ত্রী একজন চিত্রগ্রাহক) মেক্সিকো, ভারত এবং বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং যে সকল অঞ্চলের মানুষ ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করেছেন তাদের সাথে কথা বলেছেন। বলা বাহুল্য, এরা সকলে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেননি। সারা দুনিয়াতে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে এরকম অনেক বেসরকারি সংস্থা আছে। বাংলাদেশে এর সংখ্যা হাজারের উপর। দ্বিতীয়ত, যখন ড. ইউনূস ও তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে এতো হৈ-চৈ তখন ড. ইউনূস নিজে বিদেশে অবস্থান করছিলেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এবং যা গত ১৩ ডিসেম্বর ড. ইউনূসও স্বীকার করেছেন এটি ছিল গ্রামীণ কল্যাণ যে কর রেয়াত ভোগ করে সে সুযোগ গ্রহণ করার জন্য করা হয়েছিল এবং তাঁর মতে তা করা হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের আইন মেনেই। তবে আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে যেটা দেখি তা হচ্ছে, স্থানান্তরের উদ্দেশ্য হয়ত ঠিক ছিল তবে তা সাহায্য দাতা দেশ নরওয়ে বা সাহায্য সংস্থার দৃষ্টিতে সঠিক ছিল না। এ বিষয়ে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নরওয়ের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী এরিখ সলহীম বলেছেন 'উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক না কেন সাহায্য যে কারণে দেয়া হয়েছে সে সাহায্যের অর্থ যদি অন্য কোন খাতে ব্যয় হয় তা নরওয়ে সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়'। দেশ হোক বা কোন সংস্থা, তৃতীয় কোন দেশ বা সংস্থা হতে যখনই শর্তযুক্ত ঋণ বা সাহায্য গ্রহন করে সে শর্ত অবশ্যই পালন করতে হয়। শর্তের ব্যত্যয় করতে চাইলে তাও সম্ভব এবং তা করতে হবে দাতার অনুমতিসাপেক্ষে।

এ সব কথা ড. ইউনূসের চাইতে অন্য কেউ ভাল জানার কথা নয়। সুতরাং এখানে সে সময় একটি শর্ত ভঙ্গ হয়েছিল এবং ড. ইউনূস স্বীকারও করেছেন একটি বড় গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি বড় সংস্থা পরিচালনা করতে গেলে ভুলত্রুটি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে যেহেতু কান্ডটি ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে হয়েছে সেহেতু বিষয়টা নিয়ে চারদিকে এতো বেশি তুলকালাম। ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে ড. ইউনূস, ঢাকাস্থ নরওয়ের দূতাবাস এবং নোরাডের মাঝে এ তহবিল স্থানান্তর নিয়ে বেশ কিছু চিঠি চালাচালি হয়। প্রথমে ঢাকাস্থ নরওয়ের রাষ্ট্রদূত ১৯৯৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর ডঃ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে তহবিল স্থানান্তর নিয়ে আপত্তি জানান।

৮ জানুয়ারি ডঃ ইউনূস সে রাষ্ট্রদূতকে সে চিঠির জবাব দিয়ে তহবিল স্থানান্তরের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। পরের বছর ১ এপ্রিল ড. ইউনূস নরওয়েতে নোরাডের মহাপরিচালককে একটি চিঠি লিখে এপ্রিলের ২৯ বা ৩০ তারিখে তার সাথে সাক্ষাৎ করে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য সময় প্রার্থনা করেন। এতে বুঝা যায়, ঢাকাস্থ নরওয়ের রাষ্ট্রদূত ড. ইউনূসের পূর্ববতর্ী ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। ড. ইউনূস তাঁর সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টি সে সময় নোরাডের সাথে আলোচনা করে ফয়সালা হয়ে গেছে। আমরা ড. ইউনূসের বক্তব্য বিশ্বাস করতে চাই।

আবারো বলি পুরো বিষয়টা ছিল অনিয়মিতভাবে তহবিল স্থানান্তর, তসরুফ বা আত্মসাৎ নয় যেটি বাংলাদেশের কোন কোন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে এমন ঘটনা তো হর হামেশা ঘটছে তাহলে ড. ইউনূসের বিষয়টি নিয়ে দেশবিদেশে কেন এতো হৈ-চৈ ? তার কারণ একটাই। এই অনভিপ্রেত অনিয়মটি ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠানেই ঘটেছে এবং যেহেতু বাংলাদেশের আপামর মানুষের কাছে ড. ইউনূস একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান সেহেতু পুরো বিষয়টি নিয়ে জগৎজুড়ে এতো হৈ-চৈ। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হওয়ার পর ড. ইউনূস বাংলাদেশের সম্পদ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থার কট্টর সমালোচকরা ছাড়া সকলে প্রত্যাশা করেন ড. ইউনূস নিজেকে সকল সমালোচনার ঊধের্্ব রাখুন।

যেদিন দুপুরে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে ২০০৬ সালে শান্তি পুরস্কার বিজয়ী হিসাবে যৌথভাবে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল সে দিন বাংলাদেশের সকল মানুষের মাথা আকাশ ছুঁয়েছিল। এরপর সকলের প্রত্যাশা ছিল এখন থেকে একজন নতুন ড. ইউনূসের জন্ম হবে যিনি সকল বিতর্কের বাইরে থাকবেন। মানুষের সে প্রত্যাশা কী পূরণ হয়েছিল? এমন প্রশ্ন আমাকে কেউ করলে বলবো না, তা পুরোপুরি পূরণ হয়নি। ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি তথাকথিত সুশীল সমাজের যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের সভায় গিয়ে প্রথম কৌশলগত ভুলটি করেন। তিনি শুধু যে সভায় গিয়েছেন তাই নয়, ঘোষণা করেছেন অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনে কোন এলাকায় কোন রাজনৈতিক দল যোগ্য প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হলে তাঁরা নিজেরাই যোগ্য প্রার্থী দেবেন।

পরে তাঁর সঙ্গী-সাথীরা বললেন, এটি তাঁর একান্ত নিজস্ব বক্তব্য। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ যখন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের পথটি গ্রহণ করে দেশকে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিলেন তখন কোন বোধগম্য কারণ ছাড়াই তিনি তাঁকে শুধু সমর্থনই দিলেন না এও বললেন, তিনি যা করছেন তা ঠিক করছেন এবং তাঁকে এ পস্নাস গ্রেড দেয়া যায়। সম্ভবত তাঁর সর্বশেষ আত্মঘাতী কৌশলগত ভুলটি ছিল 'নাগরিক শক্তি' নামের রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়ে নিজে তার প্রধানের পদ গ্রহণ করা। সেদিনের সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি তাঁর ভুলটি উপলব্ধি করেছেন বলে অকপটে স্বীকার করেছেন। মূল কথা এদেশে যারা ড. ইউনূসের গর্বে গর্বিত তারা সব সময় তাঁকে সকল বিতর্কের ঊধের্্ব রেখে একজন পূত পবিত্র ড. ইউনূস হিসাবে দেখতে চেয়েছেন।

কিন্তু তাঁর এসব কর্মকাণ্ডে এদের অনেকেই দারুণভাবে আহত এবং হতাশ হয়েছেন। সরকার ঘোষণা করেছে, ড. ইউনূসকে নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক অবসানের জন্য পুরো বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হবে। তিনি নিজে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তা যদি সত্যি সত্যি হয় তাহলে তা সকল মহলের জন্যই মঙ্গল। সবশেষে ড. ইউনূসের সাথে একটি ব্যক্তিগত আলাপচারিতার স্মৃতিচারণ করতে চাই।

সময়টা ১৯৮৫ সনের এপ্রিল মাস। তারিখটা মনে নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট প্রথম বারের মতো তিনজনের একটি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সিনেটররা ঠিক করলেন তাঁদের প্যানেলে প্রফেসর আনিসুজ্জামান, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং প্রফেসর মোঃ আলী ইমদাদ খান (বর্তমানে প্রয়াত) থাকবেন। ড. ইউনূস সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডেপুটেশন অথবা লিয়েন নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ব্যস্ত।

সিনেট সদস্য ড. মাহবুবউলস্নাহ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) এবং আমার উপর দায়িত্ব পড়লো প্রফেসর ইউনূসের সাথে এ বিষয়ে আলাপ করে তাঁর সম্মতি নিতে। ক'দিন পর তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের কাজে চট্টগ্রাম এলেন। টেলিফোনে তাঁর কাছ হতে সময় নিয়ে আমি আর মাহবুবউলস্নাহ ভাই ড. ইউনূসের পৈতৃক নিবাস পাঁচলাইশের 'নিরিবিলিতে' এক রাতে হাজির হলাম। বারান্দায় বসে তাঁর সাথে পুরো বিষয়টা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে অনেক আলাপ হলো। তিনি জানালেন, এমন না যে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে চান না, তবে গ্রামীণ ব্যাংকের এই উঠতি সময়ে তাঁর পক্ষে ব্যাংক ছেড়ে আসা সমীচীন হবে না।

সে সময় তাঁর এই সিদ্ধান্তটি যথাযথ ছিল। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলে তাঁর পক্ষে দেশের জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ের মতো এমন বিরল সম্মান বয়ে আনা সম্ভব হতো না। সেদিন তাঁকে একটি সরল প্রশ্ন করেছিলাম। আপনিতো আর আজীবন গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব বহন করতে পারবেন না। আপনার অবর্তমানে এটির কী হবে? তিনি সহজ কথায় আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, সময়মতো এটিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মানুষ তৈরি হয়ে যাবে।

পঁচিশ বছরের মাথায় এসে ড. ইউনূসের কাছে বিনীতভাবে জানতে চাই- এতোদিনে তেমন মানুষ কী গ্রামীণ ব্যাংকে তৈরি হয়েছে? যদি হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এখনতো সময় হয়েছে তাঁর নিজের এখান থেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়ে অন্য যেসব কাজ করবেন বলে তিনি চিন্তা করেছেন (যেমন গ্রামীণ মানুষের জন্য হাসপাতাল স্থাপন) সেগুলোতে হাত দেয়া। আর পঁচিশ বছরেও তেমন মানুষটি যদি তৈরি না হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে যে, কোথাও একটা গলদ আছে। বিশ্বাস করতে চাই যে, তিনি অচিরেই সফলভাবে বর্তমান বিতর্কের বাইরে আসতে পারবেন। আবদুল মান্নান [লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা]



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।