আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উন্নয়ন খাতে বিতরণকৃত ঋণ বিনিয়োগ হচ্ছে অনুন্নয়ন খাতে



তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের অনুন্নয়ন খাতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ দিন দিন বাড়ছে। এর ওপর উন্নয়ন খাতে যে ঋণ বিতরণ হচ্ছে তাও যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে এ খাতে বিতরণকৃত ঋণ ব্যবহৃত হচ্ছে অনুন্নয়ন খাতে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর যথাযথ মনিটরিং নেই। এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। কমছেনা খেলাপি ঋণের পরিমান। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এমন তথ্য বেড়িয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক ব্যাংক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েই দায়মুক্ত হচ্ছে।

ওই ঋণ যথাযথভাবে নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় হচ্ছে কিনা তার কোন মনিটরিং করা হচ্ছে না। অনেকেই শিল্প খাতে ঋণ নিয়ে পুঁজি বাজারে বিনিয়োগ করছে। কেউবা গাড়ি কিনছে, বাড়ি করছে। অথচ ব্যাংকগুলোর এদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ব্যাংক ঋণ দিয়েই যাচ্ছে।

এতে একদিকে যেমন ব্যাংকের ঝুঁকি বাড়ছে। অন্যদিকে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। ব্যাংক সূত্র জানায়, আমাদের দেশে ব্যাংকগুলোর অনুন্নয়ন খাতে ঋণ বিতরণে আগ্রহ বেশি। এতে ব্যাংকগুলো অল্প সময়ে বেশি মুনাফা করতে পারে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করলেও ভোক্তা খাতের মতো অনুন্নয়ন খাতে ঋণ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা।

এরপরও উন্নয়ন খাতের নামে ব্যাংকগুলো যে ঋণ বিতরণ করছে তা অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় হচ্ছে না। আগে দেখা যেত শিল্প প্রতিষ্ঠান করার নামে ঋণ নিয়ে তা দিয়ে গাড়ি, বাড়ি করতে। এখন আরেকটি নতুন ক্ষেত্র যোগ হয়েছে। এখন মানুষ উন্নয়ন খাতের নামে ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে সেকেন্ডারি শেয়ার ব্যবসা করছে। অথচ পুঁজিবাজারের সেকেন্ডারি ব্যবসার সঙ্গে দেশের অর্থনীতির কোন সম্পর্ক নেই।

এতে অর্থনীতির ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ নেই। এটা অনেকটা জুয়া খেলার মতো যাতে করে দেশের মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ছে। ভোগবিলাস বাড়ছে। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানে তা কোনক্রমেই ৭ শতাংশের নিচে নামছে না। এসব অনিয়ম রোধে ব্যাংকগুলোকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এরপরও কোন ব্যাংকের বিরুদ্ধে মনিটরিংয়ে দুর্বলতার বা মনিটরিং না করার প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযুক্ত ব্যাংকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে অনুন্নয়ন (ভোক্তা) খাতে। এ খাতে ঋণ বিতরণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও সফল হচ্ছেনা। ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে উচ্চ সুদের এই ঋণ বিতরণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে অতি মুনাফার লোভে ব্যাংকগুলো এই ঋণ বিতরণ করছে বলে অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের বিতরণকৃত মোট ঋণের ১১ দশমিক ১০ শতাংশ অনুন্নয়ন খাতে বিতরণ করা হয়েছে। এ খাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। অথচ জুনেও এ হার ছিল ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অনুন্নয়ন খাতে বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২০ শতাংশ ব্যায় হচ্ছে পুঁজি বাজারে বাস্তবপক্ষে যা আরও বেশি। পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ঋণ বিতরণকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, আইএমএফ ও অর্থনীতিবিদরা।

বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও ব্যাংকগুলোর পুঁজি বাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ বন্ধ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, কোন ব্যাংক তাদের মোট দায়ের (আমানতের) ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসেও দেশের বেসরকারি এগারটি ব্যাংক নির্দিষ্ট সীমা না মেনে শেয়ারবাজারে বড় ধরণের বিনিয়োগ করেছে। অথচ চলতি মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে এ হার নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার কথা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিয়ম ভেঙ্গে শেয়ার বাজারে (নিজস্ব তহবিল বা পোর্টফলিও এবং গ্রাহকের হিসাবে ঋণ) সেপ্টেম্বর মাসে তার মোট দায়ের (আমানতের) ট্রাস্ট্র ব্যাংক ২৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ, আল আরাফা ব্যাংক ২১ দশমিক ৪২ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক ১৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ১৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ১৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ, দি সিটি ব্যাংক ২১ দশমিক ৯০ শতাংশ, সাউথইস্ট ব্যাংক ১৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংক ১২ দশমিক ৬৫ শতাংশ, স্টান্ডার্ড ব্যাংক ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ ও আইএফআইসি ব্যাংক ১২ দশমিক শুণ্য ২ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে।

এদিকে বর্তমানে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি স¤প্রতি ‘বাংলাদেশ : আর্থিক ব্যবস্থার ঝুঁকি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে তারা বলেছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে শেয়ারবাজারে ঋণ বিতরণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়িয়েছে। অনুন্নয়ন খাতে বিতরণকৃত ঋণের প্রায় এক পঞ্চমাংশই তারা পুঁজিবাজারে বিতরণ করেছে। এদিকে এ দেশের পুঁজিবাজার ততটা শক্তিশালী নয় বলে আইএমএফ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজার ততটা স্থিতিশীল না হওয়ায় যে কোন সময়ে বড় ধরণের ধ্বস নামতে পারে। এতে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। এ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ার বাজার, আবাসন, ভোক্তা প্রভৃতি খাতে বিনিয়োগে উচ্চ ঝুঁকি থাকে। ব্যাংকগুলো পূঁজিবাজারে বর্তমানে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করছে। দেশের পুঁজিবাজার নড়বরে হওয়ায় যেকোন সময়ে ধ্বস নামতে পারে।

এতে ব্যাংকিং খাতও বিপর্যস্ত হবে। এ সম্পর্কে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনুন্নয়ন খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়লে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হবে। এতে বাজারে অর্থের প্রবাহ বেড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রকাশ্যে অনুন্নয়ন খাতে যে ঋণ বিতরণ হচ্ছে তাই দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এর ওপর যদি উন্নয়ন খাতের নামে বিতরণকৃত ঋণ অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় হয় তাহলে সামগ্রিক অর্থনীতি খুব বেশি ঝুঁকিতে পড়ে।

তাই ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণের পর অবশ্যই মনিটরিং করতে হবে যে, ঋণের টাকা ঠিক খাতে ব্যয় হচ্ছে কিনা। প্রথম বারে দেয়া ঋণের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে ব্যাংক নিশ্চিত হলে পরই পরবর্তি ঋণ দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ঠিকভাবে মনিটরিং করা না হলে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। ###

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।