আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২২ কেজি চালে জীবন দিয়ে ঘাতক হলো আহাদুল



অন্যরকম কষ্ট। গ্রামের মানুষ ওদের ঘাতক বলে, এ দুঃখ ওরা কাকে বলবে। মানুষ হত্যা তো দূরে থাক, ৩৮ বছরের জীবনে কোন মানুষের দিকে মুখ তুলে তাকায়নি আহাদুল। সেই আহাদুল এখন ঘাতক নামে পরিচিত। দৌলতপুরের মানুষ জানে, ১৩ই নভেম্বর এমপি আফাজউদ্দিনকে মারতে গিয়ে নিজের দেহে বাঁধা বোমায় মারা গেছে আহাদুল।

মাত্র ২২ কেজি চাল আর বউয়ের একটি শাড়ির বিনিময়ে ঘাতক হয়েছে সে। দৌলতপুর উপজেলা সদর থেকে আধা কিলোমিটার পশ্চিমে গোপীনাথপুর গ্রাম। এ গ্রামেই বাড়ি দিনমজুর আহাদুলের। জরাজীর্ণ একটি মাটির ঘর। মাথা গোঁজার ঠাঁই।

সম্বল বলতে এটুকুই। বাবা তারাচাঁদ আলী, মা গোলাপজান বেগম। দু’জনেই এখন বয়স আর শোকের ভারে নত হয়ে পড়েছেন। দিনমজুর আহাদুলের স্ত্রী রজনী খাতুন দুই বছর বয়সী ছেলে মিলন এবং সাত বছরের ছেলে রাসেলকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানে না। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোকটিও আর নেই, তবু তো দিনে একবেলা আহারের নিশ্চয়তা ছিল।

এখন সেটাও নেই। সামনে ঘোর অন্ধকার দেখছে রজনী খাতুন। আহাদুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় অন্যরকম কষ্ট। সাত বছরের ছেলে রাসেলও মনে করে, তার বাবা মানুষ মারতে পারে না। তার বাবা ঠিকমতো হিসাব করতে পারে না, বাজারে গেলে দোকানদাররা বাবাকে ঠকায়, পয়সা কম দেয়, কাজে গেলে মালিকরা ঠকায়, ঠিকমতো টাকা দেয় না, যা দেয় বাবা রাজি হয়ে যায়, বাবা কিভাবে বোমা বানাবে, কিভাবে মানুষ মারবে, বাবার কি সেই বুদ্ধি আছে? সবাই মিথ্যা কথা বলছে।

আহাদুলের মা গোলাপজান বেগম বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ছোটবেলা থেকে বোকা স্বভাবের ছেলেটাকে রাস্তাঘাটে কেউ মারলেও নীরবে তা সহ্য করে এসেছে, কোন প্রতিবাদ করেনি। আমার এই বোকাসোকা ছেলে বোমা মেরে মানুষ মারবে- এটা মিথ্যা কথা। রজনী খাতুন শোকে দুঃখে পাথর হয়ে গেছে, তার বিশ্বাস কেউ তাকে ফুঁসলিয়ে এ কাজ করিয়েছে। তার স্বামী এমন কাজ করতে পারে না, সে হলো বোকার হদ্দ। মানুষের মুখের দিকে চেয়ে কথা বলে না, কথা বলে মাটির দিকে তাকিয়ে।

এখন সেই নাকি এমপিকে মারার জন্য বোমা নিয়ে গিয়েছিল। রজনী খাতুন বলে, ঘটনার দিন সন্ধ্যার একটু আগে সে এসে ২২ কেজি চাল, আমার জন্য একটা শাড়ি আর দুই ছেলের জন্য দুইটা পিরান নিয়ে আসে। আমি তাকে জিগাই, তুমি টাকা পাইলা কই? কোন জবাব না দিয়ে সে চলে যায়। পরে রাতে শুনি এমপির বাড়িতে সে মারা গেছে। কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠে রজনী খাতুন, বলতে থাকে তার দুঃখের কাহিনী।

গত তিন দিনে ছেলে দু’টিকে নিয়ে খাবার খেয়েছে মাত্র এক বেলা। গ্রামের মানুষ এসে তাদের নানা কথা বলে। কেউ বলে, তোমার স্বামী এমপিকে মারতে গিয়েছিল- সরকার এখন তোমাকেও জেলে নেবে। কেউ বলে তোমরা আর কোন দিন সরকারি সাহায্য পাবে না। আপনারা কন তো আমরা কি দোষ করেছি? আমার অবুঝ ছেলে দুইটা কি দোষ করেছে? আমার স্বামী মারা গেল তার কোন বিচার তো হবেই না।

এখন শুনি আমাদের বিচার হবে। এ কি দোষের নিচে পড়লাম আমরা? এখন ছেলে দুইটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো, কিভাবে ওদের খাবার জুটাবো? ১৩ই নভেম্বর কুষ্টিয়া-১ আসনের এমপি আফাজউদ্দিনের বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় দিনমজুর আহাদুল এবং তার চাচাতো ভাই সিদ্দিক। সিদ্দিক এলাকায় প্রতারক হিসেবে পরিচিত। জানা গেছে, সিদ্দিকই আহাদুলের অভাবের সুযোগ নেয়। কিছু টাকা দিতে চেয়ে তার শরীরে বোমা বেঁধে এমপির বাড়িতে পাঠায়।

আহাদুলকে বলা হয়েছিল তোমার শরীরে একটি টেপরেকর্ডার বাঁধা আছে। এমপি এলে তুমি এই টেপরেকর্ডারের তারটা আলাদা করলে তার কথা টেপ হবে, এটা একজনকে শুনালে সে তোমাকে অনেক টাকা দেবে। সেই টাকার আশায় ইটভাটার শ্রমিক দরিদ্র আহাদুল নিজের অজান্তে ঘাতক বোমা শরীরে বেঁধে গিয়েছিল এমপি আফাজউদ্দিনের বাসায়। টাকা পাওয়ার আগেই লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরতে হয়েছে আহাদুলকে। অভাব আর ক্ষুধার যন্ত্রণা ঘাতকে পরিণত করেছে একজন নিরপরাধ মানুষকে।

এ এক অন্যরকম কষ্ট। মানব জমিন, ৫ /১২/২০১০ লায়েকুজ্জামান, কুষ্টিয়া থেকে:

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।