আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৩ ডিসেম্বর ১৯তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১০ পাসের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীদের মূলস্রোতধারায় অন্তর্ভূক্তিকরণ প্রয়োজন



বিশ্বে প্রতিবন্ধিতা বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে ১৯৮১ সাল থেকে। ১৯৮১ সালে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী বর্ষ’ উদযাপন শেষে ১৯৮২ সালের ৩ ডিসেম্বর জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদের ৩৭/৫২ নং রেজুল্যুশন-এর মাধ্যমে গোটা বিশ্বের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠির জন্য পূর্ণ অংশগ্রহণ, সামাজিক সাম্য ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক বিশ্ব কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় যাতে বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ সমর্থন প্রদান করেছে। প্লেনারি সভায় সংশিস্ন¬ষ্ট রাষ্ট্র সমূহের দায়িত্ব নিরূপণ করে ২২ দফা ষ্ট্যান্ডার্স রুলস গৃহীত হয়। অতপরঃ জাতিসংঘ ১৯৮৩-৯২ ইং সালকে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দশক’ হিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ১৯৯২ ইং সনের ১৪ অক্টোবর সাতচলিস্নশ তম অধিবেশনের সিদ্ধান্ত নং ৪৭/৩-এর মাধ্যমে ৩ ডিসেম্বর কে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

Keeping the Promise: Mainstreaming disability in the Millennium Development Goals towards 2015 and beyond অর্থাৎ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতধারায় অমত্মর্ভূক্তির প্রতিশ্রুতি ’’ প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে এবারে ১৯তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ২৮ এবং ২৯ নং ধারায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম-সুযোগ, সম-অংশগ্রহণ ও সম অধিকার রক্ষার কথা নির্দিষ্ট করে বলা রয়েছে। ফলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা ডিসেম্বর ১৯৯৫ প্রণয়ন করেন। ২০০১ সালের ৪ এপ্রিল জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবসে ‘জাতীয় সংসদ’ এর অনুমোদনক্রমে ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন-২০০১’ পাস হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দুর্দশার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে।

ফলে দেশের সূশিল সমাজের প্রত্যাশা ছিলো মন্ত্রিপরিষদে পাস হওয়া ‘প্রতিবন্ধী বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা-১৯৯৫’, ২০০১ সালে সংসদে পাসকৃত ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন-২০০১’ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাগ্যন্নোয়নে যথাযথ কার্যকর ভূমিকা রাখবে। যদিও কিছুটা কাজ হয়েছে কিন্তু বাসত্মবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১০ এর খসড়া নিয়েও নানা ছল চাতুরি ছলছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এটা নিয়ে একাধিকবার সেমিনার এবং সভা হলেও তা আজও চুড়ামত্ম হয় নি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মুখে মুখে জল্পনা-কল্পনা চলছে যে, খসড়ার ক্ষেত্রেও একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষু মহল নিজেদের ফায়দা লুটার উদ্দেশ্যে আইনে কিছুটা ফাক ফোকর এবং অস্পষ্টতা রাখার চেষ্টা করছে।

এটা নিয়ে বাক-বিতন্ডও চলছে বলে জাতীয় সংসদে আইনটি পাস হওয়ার জন্য দ্রম্নত উত্থাপন করা হচ্ছে না। আইনটি খসড়া তৃণমূল প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আলোচনা না করায় অনেক অস্পষ্টতা লক্ষ্যণীয়। এই জন্য আমাদের দেশের সরকার যতটুকু দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে নামধারী কিছু সংগঠক যারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের লক্ষ্যে শুধু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মডেল হিসেবে ব্যবহার করে। অথচ যাদের (প্রতিবন্ধী) নিয়ে আন্দোলন করা হচ্ছে তাদের মতামতের গুরম্নত্ব না দিয়ে সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে কৌশলে সুসম্পর্ক স্থাপন করে যা খুশি তাই করছে। যা অবহেলিত প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

আবার লোক দেখানো তাদেরই তৈরি কিছু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নেতা বানিয়ে ইচ্ছামত ব্যবহার করছে। অথচ ওসব নেতাদের কার্যক্রম নিয়ে সকল ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জাতীয় নেটওয়ার্ক সমূহের কমিটিতে না থাকায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী অনেক যোগ্য নেতাও তাদের হাতে জিম্মি। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কর্মরত সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি নিয়ে তেমন ভূমিকা পালন করতে পারছে না। আরেকটি কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের দেশে মাত্র ৪ ভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে।

আর যারা সুযোগ পাচ্ছে তাদের কর্মসংস্থানের পথও কম। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকুরি প্রদানের জন্য। কিন্তু বাস্তবে সে নির্দেশ কতটুকু পালন করেছে আমাদের দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ। বেশ কয়েকবছর থেকে কতিপয় নামধারী সংগঠন শিক্ষিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বায়োডাটা সংগ্রহ করে চাকুরি প্রদানের জন্য। কিন্তু এই বায়োডাটা প্রদাণের পর চাকুরি নামের সোনার হরিণতো ভাগ্যে জোটেনি কিন্তু হয়রানীর শিকার হয়েছে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।

কারণ, ওসব সংগঠকরা মুখে এক কথা বলে আর কাজ করে অন্য। তারা এ্যাডভোকেসির জন্য বড় বড় ফান্ড আনলেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য তেমন কাজ করে বলে মনে হয় না। আজ সত্যিকার অর্থে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, যারা তাদের অধিকার আন্দোলনের নামে কাজ করছে । বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গলার স্বর উঁচু করে কথা বলছে। বড় বড় চাপা মারে।

তারা সত্যিকার অর্থে নিজেদের সংগঠনের মাধ্যমে কতটুকু উন্নয়ন করেছে সবচেয়ে অবহেলিত তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্রতম দেশ। এই দেশের মাথাপিছু আয় মাত্র ৪৬৬ ডলার। ২০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ আয়োজিত বিশ্ব সম্মেলনে গৃহীত হয় মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এমডিজি। বাংলায় যাকে বলা হয় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য।

এটাতে ৮টি টার্গেট রয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে টার্গেট সমূহ পূরণে বিশ্বের প্রায় সকল দেশই একমত হয়ে স্বাক্ষর করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ২০১০ সাল পর্যন্ত টার্গেট দেওয়া হয়। সরকার এসমস্ত টার্গেট পূরণে আশাবাদী হলেও তা সম্ভব হবে না প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন না হওয়ায়। বিশেষ করে কয়েকটি ক্ষেত্রে টার্গেট অর্জনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পিছিয়ে পড়বে।

ক্ষেএ সমূহ হচ্ছে- 1. চরম দারিদ্র ও ক্ষুধা দুর করা; ২.সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার্জন; ৩.নারী পুরুষের ক্ষমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন; ৪.শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস; ৫.মাতৃস্বাস্থের উন্নতি; ৬.টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ এসব টার্গেটের অনেক গুলোতে এগিয়েছে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতী হয় নি। তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে না পারায় সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারায় তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী চরম দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করায় তারা অপুষ্টিহীনতায় ভুগছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। মাত্র ৪ ভাগ প্রতিবন্ধী সুযোগ পাচ্ছে। ব্যয় বেশি হওয়ায় তা আবার দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের নাগালের বাইরে। প্রতিবন্ধী নারীরা এখনও দুর্দশার মধ্যে বসবাস করছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে নিয়ে কর্মরত জাতীয় নেটওয়ার্ক সমূহেও প্রতিবন্ধী নারীদের পদ সৃষ্টি করা হয় নি যা প্রতিবন্ধী নারীদের নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে এক বিরাট বাধা।

অন্যদিকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী নারীদের পিছিয়ে রাখা রয়েছে। পরিশেষে বলতে চাই, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে; যেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণ এবং উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রতীয়মাণ হয়েছে। সে জন্য অতি দ্রুত ’প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১০’ জাতীয় সংসদে পাস করে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। লেখক- আজমাল হোসেন মামুন উন্নয়নকর্মী এবং সাংবাদিক () মোবাইল নং-০১১৯১০৮৯০৭৫.

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।