আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

করিবকর্মা (আবদুশ শাকুর)



আমার করিবকর্মা-শব্দটির ব্যবহার করিতকর্মা-শব্দটির বিপরীত অর্থে। বাংলা অভিধানের করিতকর্মা তাঁকে বোঝায় যিনি করণীয় কর্মটিকে করিত করে ছাড়েন, করিব বলে ফেলে রাখেন না। প্রতিপক্ষে আমার কড়চার করিবকর্মা, কেবল প্রাকৃতিক কর্মগুলি ছাড়া, করণীয় কর্মমাত্রকেই করিব বলে ফেলে রাখেন। দৃষ্টান্ত চাই? আমার নিকটাত্মীয় আলমভাই। বস্তুত তাঁর চরিত্রটি হুবহু অঙ্কনের প্রয়োজনেই শব্দটি আমি বানিয়েছিলাম।

আমার করিবকর্মা-নামক কড়চাটি মধ্যসত্তরের সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছাপা হবার পর যখন-তখন যেখানে-সেখানে সকলের করিবকর্মা সম্বোধনে ক্ষুব্ধ হতে হতে আলমভাই এক পর্যায়ে বুদ্ধ হয়ে গেলেন, মানে সমাধিস্থ। সেই সমাধি থেকে পুনরুত্থিত হয়ে একদিন তিনি আমাদের সম্পূর্ণ নতুন একটা জ্ঞান দান করলেন : দীর্ঘ ধ্যানের মাধ্যমে এতদিনে আমার বোধিলাভ হয়েছে যে আমি একাই কেবল করিবকর্মা নই, আমার গোটা জাতিই তাই। তাঁকে পাল্টা জ্ঞান দান করে আমরা বললাম : তবে যে বাপ-দাদার আমল থেকে শুনে আসছি--হোয়ট বেঙ্গল থিংক্স টুডে...রেস্ট অফ দ্য ওয়র্লড থিংক্স টুমরো? আমাদের ভুলটি শুধরে দেন তিনি ত্বরিতে : শুনেছ বেঙ্গল থিংক্স টুডে, বেঙ্গল ডাজ্ টুডে নয়। বস্তুত বেঙ্গল ডাজ টুমরো হোয়ট রেস্ট অফ দ্য ওয়র্লড ডাজ টুডে। অতএব আমাকে আর করিবকর্মাভাই ডাকা যাবে না, আমাকে ডাকতে হবে আলমভাই বা আলমবাঙ্গালী।

আমাদের অখ্যাত কথক আলমবাঙ্গালী কিন্তু বিখ্যাত লেখক শিবরাম চক্রবর্তীর মতো নকল করিবকর্মা নন। শিবরাম চক্রবর্তীর তিনটি বিষয়ে নেশা ছিল প্রচন্ড---আহার, নিদ্রা আর সিনেমা। কথায় কথায় তাঁর ক্ষুধা পায়, ঘণ্টায় ঘণ্টায় না-খেলে তিনি কাহিল হয়ে পড়েন। তাই তাঁর নিয়মিত রুটিন ছিল পালা করে ভোজন আর নিদ্রাগমন। ঘুম থেকে উঠে খাওয়া, খাওয়ার পর আবার ঘুম যাওয়া।

জেগে ফের আহারগ্রহণ, খেয়ে ফের নিদ্রাগমন। এ-ভাবেই চলে শিবরামের সারাটা দিন। সন্ধ্যার দিকে আড্ডায় যান, আড্ডার পর নাইট শো দেখেন, বেশি রাতে মেসে ফেরেন এবং খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন সকাল নটায় জাগেন এবং হুবহু আগের দিনের জীবনটিই যাপন করেন একই রুটিনমাফিক। প্রিয় লেখকের এহেন জীবনধারাটি দেখতে দেখতে একদিন এক বিস্মিত পাঠক জিজ্ঞাসা করেছিল : সারাদিন আহার আর নিদ্রা, সারারাত আড্ডা আর সিনেমা--তাহলে লেখেন কখন? ততোধিক বিস্মিত লেখকের জবাব ছিল--কেন, পরদিন! তার মানে মহান লেখক শিবরাম চক্রবর্তী কি করিবকর্মা ছিলেন? মোটেই না।

প্রমাণ তাঁর লেখার পরিমাণ। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত তাঁর গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, যা ২০০৮ সাল নাগাদ দাঁড়িয়েছে ২৩৬টিতে। সংখ্যাটি আরো বাড়তে বাধ্য। কারণ লেখা তিনি যে চাইত তাকেই দিতেন, নিজের কাছে কপিও রাখতেন না। অনেক প্রকাশক এই আত্মভোলা লেখকটিকে মুদ্রিত বইটির কপিও দিতেন না, দিলেও তা দান করে দিতেন শিবরাম।

সুতরাং ক্রমে ক্রমে নতুন নতুন উৎস থেকে তাঁর নতুন নতুন পুস্তকের খবর অনবরতই বেরিয়ে আসছে। শিবরাম চক্রবর্তী নকল প্রমাণিত হওয়াতে আমি সিনা টান করে বলে বেড়াতাম যে এ-ধরাধামে আসল করিবকর্মা মাত্র একজনই এবং তিনি আমার আপনজন খোরশেদ আলম। পরে আলমভাই সমগ্র বাঙালি জাতিটিকেই তাঁর সঙ্গে জড়াতে চাওয়াতে আমার সেই পুরাতন কড়চাটি আজকের পাঠকের উদ্দেশ্যে পুনরায় উপস্থাপন জরুরি হয়ে দাঁড়াল। সেবার অনেক কাল পরে এসেছিলেন আলমভাই। তাঁর সঙ্গে দেখা তো হয়ই নি স্বাধীনতার পর, তাঁর সম্পর্কে শোনাও হয়নি বহু বছর।

আপন-আপন পরান নিয়ে এমন লবেজান হয়ে আছে সবাই, এখন আর কে-ই বা কার খবর রাখে। সকলের সঙ্গে একতরফা যোগাযোগ রক্ষা করে যাওয়াটাকে কর্মযোগ জ্ঞান করতেন আমাদের মধ্যে একমাত্র আলমভাই, যে-জন্যে হয়তো অন্য কোনো কর্মই তাঁর জীবনে আর যোগ হয়নি। কিন্তু সে কর্মযোগটিও বিয়োগ হয়েছে দেখে, ধরে নিয়েছিলাম যে এবার আলমভাই কিছু-একটাতে লেগেই গিয়েছেন নির্ঘাত। অবশ্য না-লেগে থাকতে পারার কথাও তো নয়। পাকিস্তানী আমলের সকল বেকারকেই তো রাজনৈতিক শিকার পদবি দিয়ে বেশ উচ্চ শাখে আসীন করে দিয়েছেন সদাশয় সরকার।

এসব কর্ণধার আবার এমন মগডালে বসে জাতির কর্ণ ধারণ করেছেন যে আমার আকাশ-ছোঁয়া আন্দাজের ঢিল তাঁদের পদটিও স্পর্শ করতে পারে না। আলমভাই সম্পর্কে তো সবর্শেষ খবরে প্রকাশ ছিল যে তিনিও চাপ সৃষ্টিকারী চাপকান পরে--নিষ্ঠীবনের মতো বাণীবর্ষণ আর চোঙার ফুৎকারে সমাজসৎকারের শীতল শয়তানির কর্ষণেই শামিল হয়ে গিয়েছেন। সুতরাং পার্টির একজন পেটি কুতুব হিসেব তিনি কোন্ কুতুবমিনারের পেশ-এমাম হয়েছেন, সেটা আগেভাগে একটু জেনে না-নিয়ে এগোনো ঠিক হবে না। তাই আলাপ শুরু করলাম অতিশয় সতর্ক সংলাপে : শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামলেন আলমভাই? আলমভাই তাঁর বিখ্যাত সেই আলস্যমণ্ডিত মুদ্রায় শরীরখানি এলিয়ে দিলেন সোফায়। এর মধ্যে বয়েসটাও অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে মনে হল।

হয়তো দুরন্ত যৌবনটা কাজ-বিনা কাটিয়ে দেওয়াতে পড়ন্ত যৌবনে এসে কর্ম বস্তুটিকে একটু কষ্টকরই ঠেকছে। একান্ত কর্মক্লান্ত কণ্ঠেই কথা বললেন তিনি : জীবনে অনেক কিছুই তো করলাম হে। শেষ পযর্ন্ত ভাবলাম চাকরিটাই আমার জন্যে ঠিক- শুনে আমার তো উল্লাসে ফেটে পড়ার অবস্থা : সাংঘাতিক ভালো খবর শোনালেন তো আলমভাই। এই মহান বিপ্লবটা ঘটল কোন্ সালে? আপনার মতো মানুষেরও চাকরিতে মন বসল কত দিন হল? আলমভাই তাঁর মুখবন্দী ধূম্রপুঞ্জ দিয়ে, থেকে থেকে তিনটি রিং রচনা করে যেন উদারহরণসহকারেই বোঝাতে চাইলেন : তিন বছর। এটুকু বলেই অবশ্য থেমে গেলেন গুরুদেব।

থেমে থেমে কথা বলাও তাঁর ব্যক্তিত্বের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল বরাবর। তবু খবরটা তো জবর। বাঙালির সাধারণ আয়ু পার করে দিয়ে হলেও, একটা কর্মান্ত-সিদ্ধান্ত তো যাহোক এ-জন্মেই নিতে পেরেছেন তিনি। এবং বেকারির ভোঁতা দাঁতের আঘাত থেকে বেশক নাজাত পেয়েছেন--হোক না তা দলীয় উর্দির উপদ্রবের পথে। ওদিকে জনসেবার লগ্ন বয়ে যাচ্ছে দেখে আমার তৃষিত মনকে বোঝালাম যে বাকি বৃত্তান্ত অফিস-ফেরতই শোনা যাবে সবিস্তারে।

জনসেবা তো নয়, বস্তুত দুর্জনসেবা। সম্যক অর্থে--শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালন। পরগাছা পোষণের জোগাড়যন্ত্রেই জনসেবার কম্ম কাবার হয়ে যায়। মস্তিষ্কের করোটি পর্যন্ত চারিত হয়ে গেলে, স্বৈরতন্ত্রের শিরস্ত্রাণ থেকে পরিত্রাণ কী করে সম্ভব? অতএব, টাউটের রিপোর্টেই আপনার ওপর কোর্ট বসে। তবু আজ কট্কটে কোট আর চট্চটে চাদর দেখলেই সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছিলাম শুধু আলমভাইয়ের কথা স্মরণ করেই--এসবের চোটেই তো তাঁর জন্মের জটটা শেষতক খুলল।

আলমভাই আমার অদূরাত্মীয় এক জ্ঞাতির বংশের একমাত্র বাতি। খালুজান তাঁর সুপ্ত আশা আদৌ গুপ্ত রাখেননি। পুত্রের নামের ভাষাতেই সব খোলাসা করে গিয়েছেন--খোরশেদ আলম, অর্থাৎ কিনা জগতের সূর্য। কিন্তু সূর্যটা দেখা গেল জন্মাবধিই রাহুগ্রস্ত--যাবজ্জীবন নানাদণ্ডপ্রাপ্ত। তবু যেহেতু সূর্যই--এক রূপের আগুন রাবেয়া খাতুন ছাড়া যা-কিছুর সংস্পর্শেই তিনি গিয়েছেন, ভস্ম হয়ে গিয়েছে; যা কিছুতেই হাত দিয়েছেন, বিফলে গিয়েছে; যা-কিছুই আঁকড়ে ধরেছেন, ফসকে গিয়েছে।

ফসকাননি শুধু আমাদের রাবেয়া ভাবী। তিনি বিফলেও যাননি--বরং বেজারটিও না হয়ে চারচারটি হারে পুত্রকন্যা প্রসব করে একটিমাত্র বাতির ঘরে ঝাড়বাতির ব্যবস্থাই করে দিয়েছেন। আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে আই.এ পাশ দিয়ে আলমভাই মাস্টারি, ব্রোকারি, ঠিকাদারি, দোকানদারি--অনেক কিছুই গভীর ভাবে ভেবেছেন অনেক কাল এবং অস্থিরভাবে করেছেন কিছুকাল। কিন্তু উদ্যোগের অভাব আর আলস্যের প্রভাব হেতু, হয়নি কিছুই বরং গিয়েছে সবই--বাবার জমি থেকে মায়ের জমা, মনের উদ্যম থেকে দেহের দম। এক কথায় লোটাকম্বল-পথসম্বল--সব গিয়ে আলম ভায়ের ছিল এক পিতৃদত্ত নাম আর পত্নীদত্ত বদনাম।

অথচ তিনি নিজে নিতান্তই নিবির্কার, নিষ্কাম। তাঁর বুকে কোনো বিক্ষুব্ধির লেশ নেই, তাঁর অন্তরে কোনো অশান্তির রেশ নেই। কেননা, ভাণ্ডারে তাঁর বিবিধ রতন--স্বস্তির আর সান্ত্বনার। আলমভাইয়ের নেই কী? সব অভাবের যুৎসই জবাব আছে। সব ব্যর্থতার বিশদ ব্যাখ্যা আছে।

তাঁর যাবতীয় ব্যর্থতার অব্যর্থ ব্যাখ্যাগুলিকে দুটি সারিতে সাজানো যায়। প্রথম সারি--তাঁর যাপিত জীবনটির কার্যকারণ সম্পর্কিত। যেমন, কার্যটি হল--আলম ভাই মাস্টারিটা করতে গিয়েও করলেন না। সংশ্লিষ্ট কারণটি হল--মাস্টারে আর ডাস্টারে তফাত নেই। ধরুন, ব্যর্থতাটি হল--আলম ভাই ঠিকাদারি করতে পারলেন না।

সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যাটি পাবেন--ঠিকাদারি মানেই চুরিচামারি, যা ভালো পারাও ভালো নয়। তেমনি ব্রোকারি হল না, কারণ ওটা বাটপারি। দোকানদারি চলল না, কারণ ওটা বাকিবকেয়ার ঝকমারি। আর দালালি তো--খোলাখুলিই একটি গালি। এ-তো গেল এক সেট।

আলম ভায়ের আরেক সেট ব্যাখ্যা হল--যে-জীবনটি তাঁর হতে পারত, সেটি না-হওয়ার কারণ সংবলিত। যেমন তিনি আজ বিলেত-ফেরত ব্যারিস্টার হিসেবে মাসে এন্তার হাজার টাকাই বানাতেন--কিন্তু তা তিনি বানাচ্ছেন না যেহেতু আই. এ. পরীক্ষার পরই তাঁকে বেকাদায় ফেলে তাঁর বাবাকে মারা যেতে হয়েছিল। অথবা আজ তিনি এক বিরাট শিল্পপতি হয়ে দেশের শ্রেষ্ঠতম আবাসিক এলাকায় থাকতেন--কিন্তু তা তিনি থাকছেন না শুধু এ-জন্যে যে আইয়ুবী আমলে কেউ তাঁকে প্রাথমিক মূলধনটুকু দিয়ে চালু করে দেননি। কিংবা আলম ভায়ের কনসাল্ট্যান্সিফার্ম আজ মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত--তবে সেটি জন্মগ্রহণই করেনি শুধু দশটি পয়সার রেটের তফাতে সেবার একশ দশ লাখ টাকার ওয়াপদা-টেন্ডারটি ফসকে গিয়েছিল বলে। নিদেনপক্ষে আলমভাই আজ তাঁর বনানী-গুলশান-বারিধারার বাড়িগুলি ভাড়া দিয়ে ধানমন্ডিতে ভাড়াবাড়ি নিয়ে জনৈক প্রাক্তন মন্ত্রীর শৌখিন জীবনটি যাপন করতেন--কিন্তু তা তিনি করছেন না যেহেতু তিনি একাত্তরের রাজনীতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যে বেকার বসে না-থেকে, রাবুভাবীর যৌবনজোয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংসারের কারাগারে বন্দী হয়ে গিয়েছিলেন।

মোট কথা আলমভাই খ্রিস্টের মতোই ক্ষমাসুন্দর--যেমনি নিজের প্রতি, তেমনি জগতের প্রতি। যেহেতু ওঁর মতে--সৌরজগতের সকল অপরাধই মহাকাশের ওই গ্রহতারার, তাঁর নয়। কার্যত কিন্তু যত মনে হয়, তত নিষ্কর্মা আলমভাই নন। বরং তাঁকে করিতকর্মা না বললেও, করিবকর্মা তো বলতেই হবে। কেননা কর্মটা তিনি বরাবরই করেন--তবে বর্তমানকালে নয়, ভবিষ্যৎকালে।

বর্তমানে কেবল ভবিষ্যৎকর্মের ছক কাটেন, আর অতীতকর্মের দোষ ঘাঁটেন। ফলে, তখন অমন করলে এখন এমন হত আর এখন এমন করলে তখন অমন হবে--এবংবিধ বচনই শুধু শ্র“ত হয় তাঁর শ্রীমুখ থেকে। এক কথায়, কর্তব্য সম্পর্কে সদা-সচেতন এবং সম্পাদন সম্বন্ধে আপাত-অচেতন আলমভাই আমাদের অনেক বিশেষণেই বিশ্র“ত ছিলেন--অতীতের স্বাপ্নিক, বর্তমানের দার্শনিক, ভবিষ্যতের নাগরিক এবং এমনি অবৈতনিক আরো-যে কতকি। এহেন আলম ভায়ের এমন ঘোরতর রূপান্তর। তাঁর ঊনচল্লিশ বছর বয়সের মোট তিন বছরের এই কর্মজীবনটা কেমন লাগছে, তা সবিস্তারে জানার অদম্য কৌতূহল সারাক্ষণ কেবল কাতুকুতু দিচ্ছিল আমাকে।

তাই সন্ধ্যানাগাদ বাসায় ফিরেই তাঁকে বারান্দায় টেনে এনে কেদারায় বসিয়ে দিয়ে বললাম : একেই বলে মানুষের মন আলমভাই! প্রায় চল্লিশ বছরের গবেষণার পরে আপনি কর্মজীবনটি শুরু করলেন--তাও ওই চাকরি দিয়েই? আপনার সেই জন্ম-জন্মান্তরের কৃপার বস্তুটি দিয়ে? যাক, থাকগে ওসব। আগে বলুন চাকরিটি কী? রেখায়িত চেহারায় ঈষৎ জ্যোৎস্নার মতো স্নিগ্ধ এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে স্খলিত স্বরে আলমভাই শুধু দুটো শব্দই করলেন : ভাবতে হবে। অপয়া সেই অসমাপিকা ক্রিয়াপদের অপ্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তনে একটু অস্বস্তিই বোধ করলাম--ভাবতে হবে! তবু ভাবলাম--দায়িত্বটার বিষয়বস্তু হয়তো এককথায় বোঝানো মুশকিল। তাই একেবারে নির্দিষ্ট একটি প্রশ্নই করলাম : কাজটা কোথায় আলমভাই? এবারে ভাই একটু নড়েচড়ে বসলেন এবং বসতে বসতে উত্তর দিলেন--তাও দ্বিশাব্দিক : দেখতে হবে। আমি এবারে আঁৎকেই উঠলাম : সে কি, আবারো সেই অলক্ষুণে অসমাপিকা ক্রিয়া--দেখতে হবে! একি শুধু নির্দোষ মুদ্রাদোষ? না কি এই অন্তিম ত্রিশের ত্রিকাল দর্শনের অবসানেও সেই ভবিষ্যতের নাগরিকই রয়ে গেলেন আলমভাই।

সহসা সন্দেহটা আমার উচ্চকিতই হয়ে উঠল--তাই তো। সেই আসা-অবধিই তো কেমন জানি ঠাণ্ডা মেরে আছে মানুষটা। না, তবে তো আর দেরি নয়। দেখি, লোকটাকে অন্তত খোঁচা মেরে চাঙ্গা করা যায় নাকি--খোঁচার বিরুদ্ধে তো তিনি ছিলেন বরাবরই তপ্ত বারুদ। অতএব সসংকোচে এবারে একাধিক নগ্ন প্রশ্নই ছুঁড়ে মারলাম একাধারে : কিছু মনে করবেন না আলমভাই, চাকরি আপনি ঠিক নিয়েছেন তো? মানে কাজে যোগ দিয়েছেন তো? তাঁর কাজের যা-ই হোক আমার কাজ অবশ্য হল--এবার আলমভাই কথা বলতে শুরু করলেন : তাছাড়া আর কীইবা করার আছে এ-দেশে বল? কোনো রকমের চাকরিবাকরিতেই তো যোগ--দিতে হবে।

দিতে হবে! বুঝলাম। চাকরি করার নিয়তটা বাঁধার পরও মনের মতো কাজ জোটাতেই বেচারির তিনটি বছর পার হয়ে গিয়েছে। অতএব আর শরম না করে আমিও আমার মনের মতো আলাপই শুরু করে দিলাম : চাকরিটা তাহলে হাতেই পেয়েছেন মাত্র এবং পেয়েই ছুটে এসেছেন যোগ দিতে? হ্যাঁ, একরকম চলেই এসেছি বলতে পার। তোমার ভাবীর ভাবে-সাবে মনে হল--এদিক-ওদিক দুচার দিন ঘুরে ফিরে ঘরে ফেরা আর যাবে না। তারই বা দোষ কী বল।

ঘর-সংসারের যা অবস্থা! আমিও শেষ পর্যন্ত ভাবলাম : আর লজ্জাশরম নয়। কাজকর্ম যা-ই হোক, কিছু-একটাতে এবার আমাকে--লাগতে হবে। লাগতে হবে! তা হলে ভায়ের বেলায় কোনো ভাবান্তর নয়, ভাবীর ঠেলায় দেশান্তর মাত্র। আসলে আলম ভায়ের এই সুপক্ক বয়সে তেমন বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আশাও করা যায় না। তবু ইতিমধ্যে এত বেশি দিন পার হয়ে গেল যে বেশি না হলেও কিছু উন্নতি তো হওয়ারই কথা।

সেটুকু একটু মেপে দেখার খেয়ালেই অবশেষে জিজ্ঞাসা করলাম : কিন্তু দেরি হয়ে যায়নি তো? কবে খোঁজ পেয়েছেন কাজটার? ম্লান হেসে মন্তব্য করলেন আলমভাই : চাকরির খোঁজ কি কেউ কাউকে দেয় ভাই! খোঁজখবরও তো নিজেকেই--নিতে হবে। নিতে হবে! তার মানে ব্যাপারটা খবরের স্তরেও পৌঁছায়নি এখনো। তবু আমি একটা অসাধারণ শান্তি বোধ করছি যে-অভাবনীয় আবিষ্কারে, সেটি হল--রাজকীয় শোষক-শাসক দলের চোগা-চোঙা ধারণ-পরিধান করেও আলমভাই আপন বিবেক বধ করে নিজের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণই আদায় করে নেননি তাঁদের পাতিনেতা-জাতিনেতাদের মাধ্যমে। সেই সুবাদে এই ত্যাগী পুরুষটির প্রতি অতি-লোভী আমি বরং আরো সসম্ভ্রমই হয়ে উঠলাম : তা ঘরের কাছের চাটগাঁয়ও কোনো কিছুর খোঁজ পেলেন না? ক্ষমতাসীন দলের একজন নির্লোভকর্মী হয়েও সামান্য একটা চাকরির খোঁজে আপনাকে ঢাকা পর্যন্ত ছুটে আসতে হল? ছুটে আসা ছাড়া উপায় কী বল! কোনো কাজই কি ছোটাছুটি ছাড়া সম্ভব? প্রথমে এখানে ছুটে এলাম, না হলে চট্টগ্রামে ছুটব! এবং সেখানেও না-হলে তো খুলনা-পাবনাও--ছুটতে হবে। ছুটতে হবে! এবং ছোটাছুটিরও এখান থেকেই শুরু।

চমৎকার! তার মানে, মনে হচ্ছে আলমভাই নিঃসন্দেহে আদি এবং অকৃত্রিমই রয়ে গিয়েছেন। সুতরাং আমিও মুক্তছন্দই হয়ে যেতে পারি : অযথা ছোটার আগে, ছুটে গিয়ে যে-শক্তিধরদের ধরতে হবে তাঁদের ধরার ব্যবস্থা করেছেন? যাঁদের নাম এককালে ছিল নগর-কুতুব, বর্তমানে শহর-সম্রাট --আসলে সবর্কালের সেই ষণ্ডা-গুণ্ডা আর কি! আলমভাই যেন এই প্রথম একটু আহত হয়েই কথা বললেন : ও, মামার কথাটাও শিখিয়ে দিচ্ছ? তা, মামা ছাড়া যে আজকাল কোনো প্রাপ্তবয়স্কেরও হামা ছেড়ে দাঁড়ানোরই জো নেই, সে জ্ঞানটুকু অন্তত ঊন থাকেনি এই ঊনচল্লিশটি বছরে। আরে ভাই, সর্ব অবস্থাতে সবর্প্রথমে ওই মামাই তো--ধরতে হবে। ধরতে হবে! বিলক্ষণ। তবু রক্ষে যে গুরুমশাই রাগের বশে রিশতাটাই ভুলে গিয়ে বলে বসেননি যে তোমাকেই মামা ধরলাম ভাই! তবে তাঁর কথার ঢঙে সন্দেহ আমার ঘোরতর ঘনীভূত হল যে ভাই আমার হালের মামা ধরার হাতিয়ারটুকুও জোগাড় করেছেন কি না আদৌ! না কি পীর-ফকির ধরার সেকেলে ফুলমিষ্টির সিধে দিয়েই তিনি একালের পার্টি-ক্যাডার ধরার সুখস্বপ্ন দেখছেন।

লোকটাকে তাই গোড়াতেই কিছু মোটামুটি জ্ঞান দান করা জরুরি ভাবলাম আমি : সরকার সারাদেশের তামাম মাতুলতার একমাত্র এজেন্ট হিসেবে শুধুমাত্র স্বীয় গোষ্ঠীটিকেই স্বীকৃতি দেওয়ার কারণে ইদানীং মামা আর এমনি ধরা যায় না--নিলামেই ধরতে হয়। সুতরাং নিলামের দামটা--অন্তত উপস্থিত অগ্রিমটা জোগাড় করে এনেছেন তো আলমভাই? সে কি আর কারো অজানা ভাই! আমরা তো সরকারেরই ওয়ার্কার। মামার মধ্যেও, ধর--বংশমর্যাদায়, ধ্বংসক্ষমতায় পিওর মাল আর কত। অতএব নিলাম তো চড়া দামেই হবে। তাই মোটামুটি টাকার জোগাড়েই--নামতে হবে।

নামতে হবে! অবশ্য। এবং আমাকেও দেখছি এবার ঘামতে হবে। নগদ-নিলামের মামা-বাজারে তিনি এসেছেন যত বাকি ক্রিয়াকলাপের বাজেটসবর্স্ব হয়ে! এতক্ষণে আমি সম্পূর্ণ হতাশ হলাম। লোকটির রত্তিভর উন্নতিও হয়নি দেখছি--অন্তত বর্তমানকালের বিচারে। এবার শুধু পরখ করে দেখতে হবে যে ভবিষ্যৎকালের ব্যাপারেও করণীয় কর্মটির সুসমাপ্তি পর্যন্ত পরিকল্পনা প্রণয়নে নিষ্ঠার সঙ্গে লেগে থাকার সেই সীমাহীন অধ্যবসায়টুকু তাঁর এখনো বাকি আছে কিনা।

মানে বিস্ময়কর এই করিবকর্ম-পুরুষটির অতঃপর মৌলপ্রতিভাটির মূল্যায়নই করতে চাইলাম : তবে কেনা-মামা নাকি আসল জাতের হলেও যৎকিঞ্চিৎ অধিক দাম পেলেই বেহাত হয়ে যায়। অথচ সঠিক চিনে-শুনে যে-কোনো একটি পদ জড়িয়ে ধরলেই নাকি পদবি-পদক থেকে পদস্থ চাকরি পর্যন্ত সবই সুনিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু আলমভাই, আপনি কি অতটা পারবেন? হবুকর্মী ভাইটি আমার জবাব দিলেন নির্দ্বিধায় : সে-খেয়ালও আছে বইকি! সঠিক পদখানি লিকলিক লেহন করতে পারলে যে-কোনো পদেরই নিরাপদে নিশ্চিতপ্রাপ্তি--এ-তো আমাদের দলীয় সমাজতন্ত্রেরই অন্যতম মূলনীতি। সুতরাং ভাই, কর্তব্য-কর্মই যখন : প্রয়োজনবোধে পায়ের ওপরও--পড়তে হবে। পড়তে হবে! মাশাল্লা! একেই বলে কর্তব্যসচেতন সমাজতন্ত্রী! তবু আরেকটু বাজিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে একটুখানি বাড়িয়েই বললাম : আপনি তো জানেনই আলমভাই, এসব লেহ্যপদাবলী সংবলিত পদস্থ পুরুষদের পদলেহনপ্রার্থীর লাইন সীমাহীন এবং সুযোগের সন্ধানে উমেদারগুলি ঘুরঘুরও করে নিশিদিন।

অতএব আপনি একটি পা ধরতেই আরেকজন যদি আরেকটা পা ধরে ফেলে, তাহলে তো ড্র হয়ে যাবারই আশঙ্কা। অথচ যত পদস্থই হোন--নিতান্ত পশু যখন নন, পদ তো মাত্র দুইখান। অতএব হিসেবটা একেবারেই সোজা--দুখানি চরণই যদি আপনি দু’হাতে জাবড়ে ধরে ফেলতে পারেন, তবে আর কোনো রিস্ক্ই থাকে না। কিন্তু ভাই, এতখানি আপনার পক্ষে কি সত্যি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? না! তাড়াতাড়ি আমার বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দিতে পারে--তেমন কিছুই বাড়াবাড়ি হবে না। তুমি তো জানো ভাই, বিগত ঊনচল্লিশটি বছর ধরে কেবল করণীয়-কর্মের কর্ষণ করতে করতে আমি এক ধরনের অসাধারণ কর্মী হয়ে উঠেছি।

অতএব কর্তব্য-কর্মে গাফলতি, সে আমার নয়। চাকরির জন্যে দরকার হলে আমাকে দুপায়ে মাথা খুঁড়েই--মরতে হবে। মরতে হবে! নাউজোবিল্লা! একেই বলে কর্তব্যে নিষ্ঠা। সত্যিকারের মরণপণ কর্তব্য-পরায়ণ আমাদের করিবকর্মা আলমভাই। অতএব সেই ভাবতে হবে থেকে দেখতে হবে, দিতে হবে, লাগতে হবে, নিতে হবে, ছুটতে হবে, ধরতে হবে, নামতে হবে, পড়তে হবে, মায় মরতে হবে পর্যন্ত--তাঁর সঙ্গেকার এই সারগর্ভ সংলাপের সার-সংক্ষেপটাই শুধু অনুমোদন করিয়ে নেবার আশায় নিবেদন করলাম : তাহলে আলমভাই, আপনার চাকরির সব কিছুই এখনো সেই চিরশ্র“ত ‘হবে’ই--হয়েছে শুধু করার সিদ্ধান্তটাই।

উপায় কী ভাই! কর্তব্যকার্য কিংবা করণীয়কর্ম ছাড়া কাজের মানুষের তো বাঁচাই দায়। তাই একটা কিছু তো আমাকে অবশ্যই--করতে হবে। করতে হবে! ইনশাল্লা! তবে শেষ মুহূর্তে হলেও আমার দীর্ঘক্ষণের পুঞ্জিত বিরক্তিটা ব্যক্তই হয়ে গেল : এ-আপনার নিতান্তই বিনয় আলমভাই। শুধু আপনাকে কেন এবং কেবল একটা-কিছু কেন, কবির প্রত্যয় এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি যদি সত্যই হয়--তবে বাংলাদেশ তো ভবেরই ভবিষ্যৎ। অতএব বাঙালির ক্রিয়ামাত্রই তো ভবিষ্যৎকালেই--করতে হবে।

প্রায় তিন যুগ পর কনফার্ম্ড বেকারটির সঙ্গে আমার আবার দেখা হলে আকুল আগ্রহেই জানতে চাইলাম : করিবকর্মা হিসাবে এতদিনে নিশ্চয় আপনি নিতান্তই একা হয়ে পড়েছেন আলমভাই? না ভাই, তোমরা ছাড়লেও জাতি আমার সঙ্গ ছাড়েনি। প্রমাণ? প্রমাণ বাংলাদেশ টেলিভিশন। বিগত চারটি দশকে গণতন্ত্রী-স্বৈরাচারী এত সরকার এল আর গেল, দেশের সবর্ত্র-দৃষ্ট এই একটিমাত্র টিভি-চ্যানেলের অবশ্য-করণীয় অসরকারীকরণ-কর্মটি সম্পর্কে আজো পর্যন্ত কী শুনছ? আমার অনভ্যস্ত কণ্ঠের সঙ্গে আলমভাই তাঁর রেয়াজী গলাটি মিলিয়ে বললেন : করতে হবে। রচনাকাল ২০০৯ আমার করিবকর্মা-শব্দটির ব্যবহার করিতকর্মা-শব্দটির বিপরীত অর্থে। বাংলা অভিধানের করিতকর্মা তাঁকে বোঝায় যিনি করণীয় কর্মটিকে করিত করে ছাড়েন, করিব বলে ফেলে রাখেন না।

প্রতিপক্ষে আমার কড়চার করিবকর্মা, কেবল প্রাকৃতিক কর্মগুলি ছাড়া, করণীয় কর্মমাত্রকেই করিব বলে ফেলে রাখেন। দৃষ্টান্ত চাই? আমার নিকটাত্মীয় আলমভাই। বস্তুত তাঁর চরিত্রটি হুবহু অঙ্কনের প্রয়োজনেই শব্দটি আমি বানিয়েছিলাম। আমার করিবকর্মা-নামক কড়চাটি মধ্যসত্তরের সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছাপা হবার পর যখন-তখন যেখানে-সেখানে সকলের করিবকর্মা সম্বোধনে ক্ষুব্ধ হতে হতে আলমভাই এক পর্যায়ে বুদ্ধ হয়ে গেলেন, মানে সমাধিস্থ। সেই সমাধি থেকে পুনরুত্থিত হয়ে একদিন তিনি আমাদের সম্পূর্ণ নতুন একটা জ্ঞান দান করলেন : দীর্ঘ ধ্যানের মাধ্যমে এতদিনে আমার বোধিলাভ হয়েছে যে আমি একাই কেবল করিবকর্মা নই, আমার গোটা জাতিই তাই।

তাঁকে পাল্টা জ্ঞান দান করে আমরা বললাম : তবে যে বাপ-দাদার আমল থেকে শুনে আসছি--হোয়ট বেঙ্গল থিংক্স টুডে...রেস্ট অফ দ্য ওয়র্লড থিংক্স টুমরো? আমাদের ভুলটি শুধরে দেন তিনি ত্বরিতে : শুনেছ বেঙ্গল থিংক্স টুডে, বেঙ্গল ডাজ্ টুডে নয়। বস্তুত বেঙ্গল ডাজ টুমরো হোয়ট রেস্ট অফ দ্য ওয়র্লড ডাজ টুডে। অতএব আমাকে আর করিবকর্মাভাই ডাকা যাবে না, আমাকে ডাকতে হবে আলমভাই বা আলমবাঙ্গালী। আমাদের অখ্যাত কথক আলমবাঙ্গালী কিন্তু বিখ্যাত লেখক শিবরাম চক্রবর্তীর মতো নকল করিবকর্মা নন। শিবরাম চক্রবর্তীর তিনটি বিষয়ে নেশা ছিল প্রচন্ড---আহার, নিদ্রা আর সিনেমা।

কথায় কথায় তাঁর ক্ষুধা পায়, ঘণ্টায় ঘণ্টায় না-খেলে তিনি কাহিল হয়ে পড়েন। তাই তাঁর নিয়মিত রুটিন ছিল পালা করে ভোজন আর নিদ্রাগমন। ঘুম থেকে উঠে খাওয়া, খাওয়ার পর আবার ঘুম যাওয়া। জেগে ফের আহারগ্রহণ, খেয়ে ফের নিদ্রাগমন। এ-ভাবেই চলে শিবরামের সারাটা দিন।

সন্ধ্যার দিকে আড্ডায় যান, আড্ডার পর নাইট শো দেখেন, বেশি রাতে মেসে ফেরেন এবং খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন সকাল নটায় জাগেন এবং হুবহু আগের দিনের জীবনটিই যাপন করেন একই রুটিনমাফিক। প্রিয় লেখকের এহেন জীবনধারাটি দেখতে দেখতে একদিন এক বিস্মিত পাঠক জিজ্ঞাসা করেছিল : সারাদিন আহার আর নিদ্রা, সারারাত আড্ডা আর সিনেমা--তাহলে লেখেন কখন? ততোধিক বিস্মিত লেখকের জবাব ছিল--কেন, পরদিন! তার মানে মহান লেখক শিবরাম চক্রবর্তী কি করিবকর্মা ছিলেন? মোটেই না। প্রমাণ তাঁর লেখার পরিমাণ। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত তাঁর গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, যা ২০০৮ সাল নাগাদ দাঁড়িয়েছে ২৩৬টিতে।

সংখ্যাটি আরো বাড়তে বাধ্য। কারণ লেখা তিনি যে চাইত তাকেই দিতেন, নিজের কাছে কপিও রাখতেন না। অনেক প্রকাশক এই আত্মভোলা লেখকটিকে মুদ্রিত বইটির কপিও দিতেন না, দিলেও তা দান করে দিতেন শিবরাম। সুতরাং ক্রমে ক্রমে নতুন নতুন উৎস থেকে তাঁর নতুন নতুন পুস্তকের খবর অনবরতই বেরিয়ে আসছে। শিবরাম চক্রবর্তী নকল প্রমাণিত হওয়াতে আমি সিনা টান করে বলে বেড়াতাম যে এ-ধরাধামে আসল করিবকর্মা মাত্র একজনই এবং তিনি আমার আপনজন খোরশেদ আলম।

পরে আলমভাই সমগ্র বাঙালি জাতিটিকেই তাঁর সঙ্গে জড়াতে চাওয়াতে আমার সেই পুরাতন কড়চাটি আজকের পাঠকের উদ্দেশ্যে পুনরায় উপস্থাপন জরুরি হয়ে দাঁড়াল। সেবার অনেক কাল পরে এসেছিলেন আলমভাই। তাঁর সঙ্গে দেখা তো হয়ই নি স্বাধীনতার পর, তাঁর সম্পর্কে শোনাও হয়নি বহু বছর। আপন-আপন পরান নিয়ে এমন লবেজান হয়ে আছে সবাই, এখন আর কে-ই বা কার খবর রাখে। সকলের সঙ্গে একতরফা যোগাযোগ রক্ষা করে যাওয়াটাকে কর্মযোগ জ্ঞান করতেন আমাদের মধ্যে একমাত্র আলমভাই, যে-জন্যে হয়তো অন্য কোনো কর্মই তাঁর জীবনে আর যোগ হয়নি।

কিন্তু সে কর্মযোগটিও বিয়োগ হয়েছে দেখে, ধরে নিয়েছিলাম যে এবার আলমভাই কিছু-একটাতে লেগেই গিয়েছেন নির্ঘাত। অবশ্য না-লেগে থাকতে পারার কথাও তো নয়। পাকিস্তানী আমলের সকল বেকারকেই তো রাজনৈতিক শিকার পদবি দিয়ে বেশ উচ্চ শাখে আসীন করে দিয়েছেন সদাশয় সরকার। এসব কর্ণধার আবার এমন মগডালে বসে জাতির কর্ণ ধারণ করেছেন যে আমার আকাশ-ছোঁয়া আন্দাজের ঢিল তাঁদের পদটিও স্পর্শ করতে পারে না। আলমভাই সম্পর্কে তো সবর্শেষ খবরে প্রকাশ ছিল যে তিনিও চাপ সৃষ্টিকারী চাপকান পরে--নিষ্ঠীবনের মতো বাণীবর্ষণ আর চোঙার ফুৎকারে সমাজসৎকারের শীতল শয়তানির কর্ষণেই শামিল হয়ে গিয়েছেন।

সুতরাং পার্টির একজন পেটি কুতুব হিসেব তিনি কোন্ কুতুবমিনারের পেশ-এমাম হয়েছেন, সেটা আগেভাগে একটু জেনে না-নিয়ে এগোনো ঠিক হবে না। তাই আলাপ শুরু করলাম অতিশয় সতর্ক সংলাপে : শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামলেন আলমভাই? আলমভাই তাঁর বিখ্যাত সেই আলস্যমণ্ডিত মুদ্রায় শরীরখানি এলিয়ে দিলেন সোফায়। এর মধ্যে বয়েসটাও অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে মনে হল। হয়তো দুরন্ত যৌবনটা কাজ-বিনা কাটিয়ে দেওয়াতে পড়ন্ত যৌবনে এসে কর্ম বস্তুটিকে একটু কষ্টকরই ঠেকছে। একান্ত কর্মক্লান্ত কণ্ঠেই কথা বললেন তিনি : জীবনে অনেক কিছুই তো করলাম হে।

শেষ পযর্ন্ত ভাবলাম চাকরিটাই আমার জন্যে ঠিক- শুনে আমার তো উল্লাসে ফেটে পড়ার অবস্থা : সাংঘাতিক ভালো খবর শোনালেন তো আলমভাই। এই মহান বিপ্লবটা ঘটল কোন্ সালে? আপনার মতো মানুষেরও চাকরিতে মন বসল কত দিন হল? আলমভাই তাঁর মুখবন্দী ধূম্রপুঞ্জ দিয়ে, থেকে থেকে তিনটি রিং রচনা করে যেন উদারহরণসহকারেই বোঝাতে চাইলেন : তিন বছর। এটুকু বলেই অবশ্য থেমে গেলেন গুরুদেব। থেমে থেমে কথা বলাও তাঁর ব্যক্তিত্বের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল বরাবর। তবু খবরটা তো জবর।

বাঙালির সাধারণ আয়ু পার করে দিয়ে হলেও, একটা কর্মান্ত-সিদ্ধান্ত তো যাহোক এ-জন্মেই নিতে পেরেছেন তিনি। এবং বেকারির ভোঁতা দাঁতের আঘাত থেকে বেশক নাজাত পেয়েছেন--হোক না তা দলীয় উর্দির উপদ্রবের পথে। ওদিকে জনসেবার লগ্ন বয়ে যাচ্ছে দেখে আমার তৃষিত মনকে বোঝালাম যে বাকি বৃত্তান্ত অফিস-ফেরতই শোনা যাবে সবিস্তারে। জনসেবা তো নয়, বস্তুত দুর্জনসেবা। সম্যক অর্থে--শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালন।

পরগাছা পোষণের জোগাড়যন্ত্রেই জনসেবার কম্ম কাবার হয়ে যায়। মস্তিষ্কের করোটি পর্যন্ত চারিত হয়ে গেলে, স্বৈরতন্ত্রের শিরস্ত্রাণ থেকে পরিত্রাণ কী করে সম্ভব? অতএব, টাউটের রিপোর্টেই আপনার ওপর কোর্ট বসে। তবু আজ কট্কটে কোট আর চট্চটে চাদর দেখলেই সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছিলাম শুধু আলমভাইয়ের কথা স্মরণ করেই--এসবের চোটেই তো তাঁর জন্মের জটটা শেষতক খুলল। আলমভাই আমার অদূরাত্মীয় এক জ্ঞাতির বংশের একমাত্র বাতি। খালুজান তাঁর সুপ্ত আশা আদৌ গুপ্ত রাখেননি।

পুত্রের নামের ভাষাতেই সব খোলাসা করে গিয়েছেন--খোরশেদ আলম, অর্থাৎ কিনা জগতের সূর্য। কিন্তু সূর্যটা দেখা গেল জন্মাবধিই রাহুগ্রস্ত--যাবজ্জীবন নানাদণ্ডপ্রাপ্ত। তবু যেহেতু সূর্যই--এক রূপের আগুন রাবেয়া খাতুন ছাড়া যা-কিছুর সংস্পর্শেই তিনি গিয়েছেন, ভস্ম হয়ে গিয়েছে; যা কিছুতেই হাত দিয়েছেন, বিফলে গিয়েছে; যা-কিছুই আঁকড়ে ধরেছেন, ফসকে গিয়েছে। ফসকাননি শুধু আমাদের রাবেয়া ভাবী। তিনি বিফলেও যাননি--বরং বেজারটিও না হয়ে চারচারটি হারে পুত্রকন্যা প্রসব করে একটিমাত্র বাতির ঘরে ঝাড়বাতির ব্যবস্থাই করে দিয়েছেন।

আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে আই.এ পাশ দিয়ে আলমভাই মাস্টারি, ব্রোকারি, ঠিকাদারি, দোকানদারি--অনেক কিছুই গভীর ভাবে ভেবেছেন অনেক কাল এবং অস্থিরভাবে করেছেন কিছুকাল। কিন্তু উদ্যোগের অভাব আর আলস্যের প্রভাব হেতু, হয়নি কিছুই বরং গিয়েছে সবই--বাবার জমি থেকে মায়ের জমা, মনের উদ্যম থেকে দেহের দম। এক কথায় লোটাকম্বল-পথসম্বল--সব গিয়ে আলম ভায়ের ছিল এক পিতৃদত্ত নাম আর পত্নীদত্ত বদনাম। অথচ তিনি নিজে নিতান্তই নিবির্কার, নিষ্কাম। তাঁর বুকে কোনো বিক্ষুব্ধির লেশ নেই, তাঁর অন্তরে কোনো অশান্তির রেশ নেই।

কেননা, ভাণ্ডারে তাঁর বিবিধ রতন--স্বস্তির আর সান্ত্বনার। আলমভাইয়ের নেই কী? সব অভাবের যুৎসই জবাব আছে। সব ব্যর্থতার বিশদ ব্যাখ্যা আছে। তাঁর যাবতীয় ব্যর্থতার অব্যর্থ ব্যাখ্যাগুলিকে দুটি সারিতে সাজানো যায়। প্রথম সারি--তাঁর যাপিত জীবনটির কার্যকারণ সম্পর্কিত।

যেমন, কার্যটি হল--আলম ভাই মাস্টারিটা করতে গিয়েও করলেন না। সংশ্লিষ্ট কারণটি হল--মাস্টারে আর ডাস্টারে তফাত নেই। ধরুন, ব্যর্থতাটি হল--আলম ভাই ঠিকাদারি করতে পারলেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যাটি পাবেন--ঠিকাদারি মানেই চুরিচামারি, যা ভালো পারাও ভালো নয়। তেমনি ব্রোকারি হল না, কারণ ওটা বাটপারি।

দোকানদারি চলল না, কারণ ওটা বাকিবকেয়ার ঝকমারি। আর দালালি তো--খোলাখুলিই একটি গালি। এ-তো গেল এক সেট। আলম ভায়ের আরেক সেট ব্যাখ্যা হল--যে-জীবনটি তাঁর হতে পারত, সেটি না-হওয়ার কারণ সংবলিত। যেমন তিনি আজ বিলেত-ফেরত ব্যারিস্টার হিসেবে মাসে এন্তার হাজার টাকাই বানাতেন--কিন্তু তা তিনি বানাচ্ছেন না যেহেতু আই. এ. পরীক্ষার পরই তাঁকে বেকাদায় ফেলে তাঁর বাবাকে মারা যেতে হয়েছিল।

অথবা আজ তিনি এক বিরাট শিল্পপতি হয়ে দেশের শ্রেষ্ঠতম আবাসিক এলাকায় থাকতেন--কিন্তু তা তিনি থাকছেন না শুধু এ-জন্যে যে আইয়ুবী আমলে কেউ তাঁকে প্রাথমিক মূলধনটুকু দিয়ে চালু করে দেননি। কিংবা আলম ভায়ের কনসাল্ট্যান্সিফার্ম আজ মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত--তবে সেটি জন্মগ্রহণই করেনি শুধু দশটি পয়সার রেটের তফাতে সেবার একশ দশ লাখ টাকার ওয়াপদা-টেন্ডারটি ফসকে গিয়েছিল বলে। নিদেনপক্ষে আলমভাই আজ তাঁর বনানী-গুলশান-বারিধারার বাড়িগুলি ভাড়া দিয়ে ধানমন্ডিতে ভাড়াবাড়ি নিয়ে জনৈক প্রাক্তন মন্ত্রীর শৌখিন জীবনটি যাপন করতেন--কিন্তু তা তিনি করছেন না যেহেতু তিনি একাত্তরের রাজনীতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যে বেকার বসে না-থেকে, রাবুভাবীর যৌবনজোয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংসারের কারাগারে বন্দী হয়ে গিয়েছিলেন। মোট কথা আলমভাই খ্রিস্টের মতোই ক্ষমাসুন্দর--যেমনি নিজের প্রতি, তেমনি জগতের প্রতি। যেহেতু ওঁর মতে--সৌরজগতের সকল অপরাধই মহাকাশের ওই গ্রহতারার, তাঁর নয়।

কার্যত কিন্তু যত মনে হয়, তত নিষ্কর্মা আলমভাই নন। বরং তাঁকে করিতকর্মা না বললেও, করিবকর্মা তো বলতেই হবে। কেননা কর্মটা তিনি বরাবরই করেন--তবে বর্তমানকালে নয়, ভবিষ্যৎকালে। বর্তমানে কেবল ভবিষ্যৎকর্মের ছক কাটেন, আর অতীতকর্মের দোষ ঘাঁটেন। ফলে, তখন অমন করলে এখন এমন হত আর এখন এমন করলে তখন অমন হবে--এবংবিধ বচনই শুধু শ্র“ত হয় তাঁর শ্রীমুখ থেকে।

এক কথায়, কর্তব্য সম্পর্কে সদা-সচেতন এবং সম্পাদন সম্বন্ধে আপাত-অচেতন আলমভাই আমাদের অনেক বিশেষণেই বিশ্র“ত ছিলেন--অতীতের স্বাপ্নিক, বর্তমানের দার্শনিক, ভবিষ্যতের নাগরিক এবং এমনি অবৈতনিক আরো-যে কতকি। এহেন আলম ভায়ের এমন ঘোরতর রূপান্তর। তাঁর ঊনচল্লিশ বছর বয়সের মোট তিন বছরের এই কর্মজীবনটা কে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.