আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই সময়ের ছবি 'রানওয়ে



বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে স্বীকৃতি ও দর্শকপ্রিয়তা দুই ধারাতেই সফল চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ। ‘মাটির ময়না’ এবং ‘অন্তর্যাত্রা’র পরে এবার তিনি তৈরি করেছেন পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র ‘রানওয়ে’। ছবিটিতে ধর্ম-ভিত্তিক উগ্রবাদী সমস্যার পারিপার্শিকতাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। ছবির মধ্য দিয়ে গল্প ভাঙ্গার চেষ্টা করেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করেন, ছবির কাজ শুধুই বিনোদন দেয়া নয়।

‘রানওয়ে’ ছবিটির মধ্য দিয়ে তিনি তরুণদের বলতে চেষ্টা করেছেন, কী রকম পরিবেশের মধ্য দিয়ে গেলে তাদের মধ্যে মানবতার বোধোদয় হবে। ‘মাটির ময়না’ ও ‘অর্ন্তযাত্রা’র পর ‘রানওয়ে’ তৃতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র। ‘নরসুন্দর’ স্বল্পদৈর্ঘ্যরে কাহিনীচিত্র। তারও আগে শামীম আখতারের সঙ্গে সাদাকালোতে ৩৫ মিলিমিটারে একটা ছোট্ট কাহিনীচিত্র ছবিটির নাম ‘সে’। ‘সোনার বেড়ি’ প্রথম সমাপ্ত ছবি।

‘আদম সুরত’ ছিলো প্রথম উদ্যোগ। এটা সম্পন্ন করতে সাত বছর লেগে যায়। এর মাঝামাঝি সময়ে ‘সোনার বেড়ি’র কাজ করি। এই চলচ্চিত্রটি ছিল নারী সমাজ বিষয়ক। বঞ্চিত শিশু ও মানবাধিকার নিয়েও কাজ ।

সেগুলোর নাম ছিল শিশু কন্ঠ, অন্যশৈশব, নিরাপত্তা ইত্যাদি। ‘রানওয়ে’ এর বিষয়টি প্রথম মাথায় আসে ২০০০ সালে। সে সময় রানওয়ের উত্তর পাশে যেখানে বিমান ল্যান্ড করে সেই পাশটা খুব কাছ থেকে দেখেছি। এটাকে এপ্রোচ রানওয়ে বলে। সেখানে এপ্রোচ রানওয়ের উপর সিগনাল লাইটগুলো আছে।

এর দুই ধারে অসংখ্য মানুষ বসবাস করেন। বহু জন্তু জানোয়ারও চড়ে বেড়ায় এখানে। এসবের মধ্যেই রানওয়েতে বিশাল বিশাল বিমানের উঠা নামা। কিছু কিছু মানুষ অবাক হয়ে প্লেনগুলোর ওঠা নামা দেখে। কেউ কেউ এতই অভ্যস্ত যে ভ্রুক্ষেপও করে না।

এইখানেই একদিন হঠাৎ আমার নজর কাড়লো একটি শিশু। সে একটি বাটুল নিয়ে আকাশের দিকে একটি বিমানকে লক্ষ্য করে গুটাল ছুঁড়ছে। দৃশ্যটি আমাকে খুব নাড়া দিলো। শিশুটির মনস্তত্ব বুঝতে চেষ্টা করলাম। তখন একটা ঘটনা চারদিকে সাড়া ফেলে দিয়েছিলো।

আমি নিজেও কাগজে ঘটনাটি পড়েছিলাম। এক যুবক বিমানের চাকার খোলের মধ্যে লুকিয়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো। ছেলেটা মারা যায়। মধ্যপ্রাচ্যে বিমানটি অবতরণের পর দেখা যায় তার লাশটা ঠান্ডায় জমে বরফে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিলো। ২০০৮ এর মাঝামাঝি সময়ে ছবিটার প্রাথমিক কাজ শুরু করি।

২০০৮ এর শেষের দিকে এর শুটিং শুরু হয়। তখন সেনা সমর্থিত সুশীল সরকারের শাসন চলছিল। ২০০৯ এর মাঝামাঝিতে ছবির শুটিংয়ের কাজ শেষ হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রানওয়েতেই টানা ১৩ দিন অবস্থান করেছিলাম আমরা। তখন দিনরাত কাজ চলেছে ছবিটির।

এই ছবিতে একজন মায়ের গল্প আছে। একজন বোনের গল্প আছে। ছবির প্রধান চরিত্রটি সংসারের বড় ছেলে। এছাড়া দাদা, নিরুদ্দেশ বাবা, একটি মেয়ে আছে যে বোনের সঙ্গে গার্মেন্টসে কাজ করে। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সহ ছোট ছোট চরিত্রও আছে।

এই গল্পগুলো আলাদা আলাদা। তবে আমি শুধু গল্পের মধ্যেই সন্তুষ্ট নই। আমি এই গল্পের মধ্য দিয়ে একটি সময়কে ধরার চেষ্টা করেছি, এই সময়টা হলো ২০০৫-২০০৬। তখন দেশ সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। পুরো দেশ বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল।

আমরা এখন এসবের কোন কিছু থেকেই মুক্ত হতে পারিনি। এখনও আমাদের আত্মতুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। ঐ সময়ের যে চ্যালেঞ্জগুলো তৈরি হয়েছিলো সেই চ্যালেঞ্জ এখনো আছে। ছবিটা দেখলেই মনে হবে ‘রানওয়ে’র সবই তো আমাদের দেখা। আমি ঐ সময়টাকে বেছে নেয়ার মাধ্যমে সমসাময়িক বাংলাদেশকে ধরার চেষ্টা করেছি।

‘মাটির ময়না’ যারা দেখেছেন তারা জানেন, সেখানেও আমি সময়ের বাস্তবতাকে সামনে আনতে চেয়েছি। অনেকে সিনেমা মানেই শুধু বিনোদন মনে করেন। আমি বিশ্বাস করি ছবির কাজ শুধু বিনোদন দেওয়া নয়। ছবি মানুষের মনে অস্বস্তি তৈরি করবে এটাও ছবির কাজ। কেননা আমার বাজে চেহারাটা আয়নায় আনা হলেই না আমি বিব্রতবোধ করবো।

‘মুক্তির গান’ দেখে সবাই উদ্বেলিত হয়। আবার ‘মুক্তির কথা’তে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরা অস্বস্তি বোধ করে। ছবিটিতে জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার কথা আছে। গণহত্যার কথা আছে। এখানে বিজয়ের শ্লাঘাবোধ নেই।

‘রানওয়ে’ ছবিটিতে যেমন অস্বস্তির দিক আছে তেমনি আশ্বাসের দিকও থাকবে। এই ছবিতে আমি নানা দিক তুলে আনার চেষ্টা করেছি। আগের চলচ্চিত্রগুলোর মতো এই ছবিতেও একটা সামাজিক পটভূমি আছে। তারকার চেহারা দেখানোটাই নির্মাতার কাজ নয়। তার পেছনে সফট ফোকাসে কী আছে তা অনেক সময় অনেক বেশি অর্থবহ।

সেই কারণে ল্যান্ডস্কেপ, লোকেশনও গুরুত্বপূর্ণ। আমি, আমার ছবির মধ্য দিয়ে গল্প ভাঙ্গার চেষ্টা করি। ‘মাটির ময়না’ একটি সাদামাটা একরৈখিক গল্প। তবে এর গল্পটা একটা জায়গায় জমে উঠলেই হঠাৎ দর্শককে একটা কনসার্টে নিয়ে যাচ্ছি, মেলায় নিয়ে যাচ্ছি, আবার মূল গল্পে ফিরে যাচ্ছি। আসলে আমি গল্পটাকে ভাঙছি।

আমার ছবির ভেতরেই সব সময় একটা বির্তক চলতে থাকে। এই যাতায়াতের মধ্য দিয়ে এক সময় পটভূমিতে যাচ্ছি আবার ফোরগ্রাউন্ডে ফিরে আসছি। আমাদের ছবিতে এই ভাবে সমাজকে নিয়ে আসি। ‘রানওয়ে’র কেন্দ্রবিন্দু নিম্মবিত্তের একটি পরিবার। পরিবারটির যে গ্রামে বসবাস তা নদী ভাঙ্গনে হুমকির মুখে।

এই অবস্থায় পরিবার প্রধান তার শেষ সম্বল বসত ভিটা বিক্রি করে। সেই টাকায় আদম ব্যবসায়ীর মাধ্যমে সে মধ্যপ্রাচ্যে গেছে। যাবার আগে সে পরিবারটাকে রেখে গেছে রানওয়ের পাশে, একচালা ঘরে। লোকটা হয়তো চাকরী জোগাড় করতে পারে না। এজন্য সে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে না।

দেশে মা ক্ষুদ্র্ঋণ দেওয়া সংস্থার কাছ থেকে টাকা লোন করে। সেই টাকায় একটি গাভী কেনে। গাভীর দেওয়া দুধ বিক্রির টাকায় পরিবারটি কোন রকমে খেয়ে পরে বেঁচে আছে। পরিবারের মেয়েটি একটি পোশাকতৈরি কারখানায় কাজ করে। পোশাক কারখানায় গন্ডগোলের কারণে সে দুই মাস ধরে বেতন পায়না।

এভাবেই সংসারটা চলতে থাকে না চলার মতো। শয্যাশায়ী শ্বশুর বিচিত্র কারণে এত কিছুর মধ্যেও আশাবাদী। আর মেয়েটির বড় ভাই মাদ্রাসায় পড়ুয়া হলেও, সে দাখিল পরীক্ষা দিতে পারেনি গ্রাম থেকে চলে আসার কারণে। এখন সে বেকার। চাকরি খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে মামার সাইবার ক্যাফেতে সাহায্য করে ছেলেটি।

আর কম্পিটারে কাজ শেখে। মামা নিজেকে আধুনিক ভাবেন। তার মতে প্রযুক্তিই সব। মামার সাইবার ক্যাফেতে এজন্য আইনেস্টাইনের ছবি দেখা যাবে। কথায় কথায় সে ইংরেজী বলে।

কিন্তু লোকটা সৎ এবং আদর্শবাদী। এরপরে কী হয়? সেটাই হচ্ছে আমার গল্প। আর এই গল্পটা জানার জন্য ছবিটা দেখতে হবে। যমুনার চরে শুটিং করেছি। ঢাকার আশেপাশে বহু জায়গায় করেছি।

মানিকগঞ্জে, জয়দেবপুরে, উত্তরায় বেশ কিছু জায়গায়, গাজীপুরে, ঢাকা শহরের মধ্যেও অনেক জায়গায় শুটিং করেছি। এই ছবিতে অনেকগুলো ছোট ছোট চরিত্র আছে। সব মিলিয়ে ত্রিশটির মতো হবে। একটি চরিত্রে অভিনয় করেছে তিশা। সে একটি দৃশ্যে অভিনয় করেছে অতিথি শিল্পী হিসেবে।

এ রকম একক দৃশ্য আছে। এই দৃশ্যগুলোতে পেশাদার শিল্পীদের দিয়ে কাজ করানো হয়েছে। আবার ছবিটির প্রধান যে চরিত্রগুলো তারা সবাই অপরিচিত। তাদের কোন তারকা খ্যাতি নাই। তারা সবাই পরিচিত মুখদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন।

আমাদের দেশে শব্দ উপেক্ষিত, ইমেজও। ছবিতে আমি অনেক কিছুই শব্দ-ইমেজের মধ্য দিয়ে বলতে চেয়েছি। সংলাপ ছাড়াই গল্পটা বলতে চেষ্টা করেছি। আমার ছোট বেলার শোনা গান গুলো থেকেই আবহ সঙ্গীত তৈরীর চেষ্টা করেছি। ছোটবেলায় পুঁথি পাঠ শুনেছি অনেক।

সেই শোনা সুরটাকে ইম্প্রভাইজেশন করে মিউজিক করেছি। আবার যেসব গীত শুনেছি সেইসব গীতগুলোকে ইম্প্রভাইজ করেছি। নানান রকমের ধর্মীয় রিসাইটেশনকেও ইম্প্রভাইজেশন করেছি। প্রায় সব মিউজিকের স্কোর করেছে তানভীর আলম সজীব। অসাধারণ কাজ করেছে।

সঙ্গীত পরিচালনা করেছি আমি আর ক্যাথেরিন। এই ছবির কিছু আবহ সঙ্গীত ক্যাথেরিনের করা। ছবিটা তরুণদের দেখাতে চাই। এই সময়ে তারা নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই ছবিতে আমি ধর্ম ভিত্তিক উগ্রবাদী সমস্যার পারিপার্শি¦কতাকে তুলে ধরতে চেয়েছি।

রাজনৈতিক, দেশীয় ও আন্তঃর্জাতিক আর্থসামাজিক আবহের কারণে আজকে তরুণরা বিপথে যাচ্ছে। কেননা তাদের সামনে কোন উদাহরণ নেই। কোন আদর্শ নাই। এজন্য তারা খেই হারিয়ে ফেলছে। আমি এই ছবিটির দিয়ে তাদের সাথে একধরনের সংলাপে অবতীর্ণ হতে চাচিছ।

অন্য দর্শকদের পাশাপাশি তরুণরাও যেন আমার এই ছবিটি দেখেএটাই আমার প্রত্যাশা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।