আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সময়ে দ্রোহে দ্বিধায়

পুরনো আমিটাই ভাল ছিলাম...

লেখার টেবিলে একজন যুবক। টেবিলের উপরে একটা মনিটর, একটা কর্ডলেস মাউস আর একটা প্রোজেক্টর। যুবকের হাত ট্রেতে রাখা কিবোর্ডে। পুরু চশমা, লম্বা চুল, অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়ি, শর্ট পাঞ্জাবীতে তাকে মাঝ-বয়সী মনে হয়। আরেকজন সোফায় বসে আপনমনে রুবিক-কিউব মেলাচ্ছে।

চুলগুলো এলোমেলো, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। বয়স মনে হচ্ছে লেখকের সমানই হবে। তবে আশপাশ সম্পর্কে অনেকটাই উদাসীন। আরেকজন অপ্রকৃতিস্থ। চুল-দাড়ির আড়ালে চেহারাটা ঢাকা পড়ে আছে।

বয়স বোঝার উপায় নাই। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে। হাসছে আবার ক্ষণে ক্ষণে ছুটোছুটি করছে। আর একটা ছেলে।

বয়স সাত কি আট হবে। একটা ক্রিকেট বল নেটে ঝুলিয়ে ব্যাটিং প্রাকটিস করে যাচ্ছে। বলটা ঝুলে ঝুলে ক্ষ্যাপা যুবকের সামনে আসে আবার ছেলেটার কাছে চলে যায়। ছেলেটা ব্যাট ঘুরিয়ে শট প্র্যাকটিস করতে থাকে। চোখে মুখে সরল আনন্দ।

নাকের ডগায় ঘাম চিকচিক করে। লেখক কোন একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছে। চোখে মুখে বিরক্তি। ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছে না। একপাশের দেয়ালে একটা বড় পর্দা।

টেবিলে রাখা প্রোজেক্টর থেকে তাতে আলো এসে পড়ছে। লেখকের গল্পের অগ্রগতির সাথে সাথে পর্দার দৃশ্যগুলো পরিবর্তন হচ্ছে। এক এক সময় এক এক ধরনের দৃশ্য ভেসে উঠছে। কর্ডলেস মাউসের হুইলটা আপনা থেকেই ঘুরে যাচ্ছে। সাথে সাথে পর্দার দৃশ্যগুলো ফাস্ট ফরয়ার্ড হচ্ছে রিভার্স হচ্ছে।

থেমে যাচ্ছে। আবার অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। উপাসনালয়। একটা যুবক, বয়স ছাব্বিশ কি সাতাশ। বসে আছে কিছু একটা শেষ হওয়ার অপেক্ষায়।

ভাইব্রেশান দেয়া মোবাইল ফোনটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। যুবক একটু ইতস্তত করে। ফোনটা বের করে। একটা মেইল এসেছে, ফেইসবুক নটিফিকেশান। সকাল বেলায় করা একটা মেসেজের রিপ্লাই।

বিশেষ দিনের শুভকামনা আর বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ। যুবক ফোনটা রেখে দেয়। মূল প্রার্থনা শেষ হয়। কোন ভুল হয় না। বসে থাকে নসিহত শোনার জন্য।

একসময় হাত তুলে শেষ প্রার্থনা শুরু হয়। বাবার সাথে আসা ছোট ছোট কিছু ছেলেও হাত তুলে বসে থাকে। এদিক ওদিক তাকায়। যুবক প্রার্থনায় মন দিতে পারে না। হুইলটা ঘুরে যায় পিছন দিকে।

পর্দায় একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে। বাবার আঙ্গুল ধরে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে যায় একটা ছ'সাত বছরের ছেলে। নতুন জুতো-জামা-টুপিতে ছেলেটাকে খুব খুশি মনে হয়। একবার বাবার মুখের দিকে তাকায়। আবার চারপাশে তাকায়।

একটা পুকুর দৃশ্যমান হয়। পুকুরপারে মসজিদ। মসজিদের সামনে হোগলা পাতার পাটি বিছিয়ে সারি সারি লোকজন বসে আছে। উপর থেকে চাম্বুল গাছের চিরিচিরি পাতা ঝরছে। হালকা বাতাসে সবুজ নারকেল পাতাগুলো এদিকওদিক নড়ছে।

ছেলেটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারপাশে চেয়ে থাকে। লেখকের গল্প আরেকটু এগোয়। উপসানলায় থেকে বেড়িয়ে আসে যুবক। নসিহতে বলা ক্ষমাপ্রাপ্তদের মতো মনে হয় না নিজেকে। সৃষ্টিকর্তার কাছে থেকেও কোন রিপ্লাই আসে না।

রাজপথে অনেক মানুষ, কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে। এক হাত নেই একটা ভিখারী শুয়ে আছে। আরেক হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে কোন এক সৃষ্টিকর্তার নাম ধরে ডাকছে। যুবক জানে না শব্দটা সৃষ্টিকর্তার কাছে আদৌ পৌঁছায় কিনা। সামনে আরেকটু হাঁটে সে।

গাড়ি অনেক কম তাই রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দুইজন ভিখারী রাস্তার মধ্যে বসে আছে সামনে ধর্মগ্রন্থ খুলে। পড়ছে অথবা পড়ার চেষ্টা করছে। পাশে থালায় কিছু খুচরা পয়সা পড়ে আছে। যুবক বুঝতে পারে না রাস্তায় বসে ধর্মগ্রন্থ পড়ার মানে।

অথবা ভিখারী জানে না সে কি পড়ছে। মানুষগুলোর ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। পশু অথবা পশুত্ব ত্যাগের প্রস্তুতি প্রায় গুছিয়ে এনেছে। দা-বটি-চাপাতিতে ধার তোলা শেষ। ক্ষ্যাপা: ঐ লেখু'র বাচ্চা তোর ত্যানাপ্যাঁচানী থামা।

কি হইবো কি এইসব ত্যানা প্যাঁচায়ে? লেখু: কি বল এইসব বন্ধু? ত্যানাপ্যাঁচানী মানে? যা সত্যি তাইতো বলছি। ক্ষ্যাপা: আরে রাখ্ তোর সত্যি। কয়টা সত্যি জানিস্ তুই? পারবি কিছু বদলাইতে? পাগলা চিৎকার দিয়ে ওঠে- "খামো...শ"। ক্ষ্যাপা কথা বলা থামায়, পাজল মিলাতে ব্যস্ত হয়। পাগলা: অই দ্যাখ্ জিহবা লকলক করে।

দ্যাখ্ দ্যাখ্ দ্যাখ্। অই দ্যাখ্ রস ঝইরা ঝইরা পড়তাছে। অহন সব আমারে দিবি। সবগুলা পশু আমারে দিবি। আমি পাহাড়ে ছড়াইয়্যা দিমু।

আমি আগুন ধরাইয়া দিমু। আগুন আগুন। আগুনে ঝলসাইয়া আমি লাল মাংস খামু। তোগরেও দিমু। আর যদি না ঝলসায় তাইলে তোগরেও জবাই দিমু।

হা হা হা জবাই জবাই জবাই। পাগলা থামে। বিড়বিড় করতে থাকে। বোঝা যায় না কি বলে। লেখক আবার কিবোর্ডে হাত রাখে।

যুবক ফুটপাতের দেয়াল ঘেষে হাঁটে। দেয়ালে নানান রঙ্গের পোস্টার। এক জায়গায় একটা সিনেমার অনেকগুলা পোস্টার। সিনেমার নাম "কাম কইরা খা"। পোস্টারের টানটান যৌবনের নায়িকারা যুবকের বুকে একটুও কাঁপন ধরায় না।

গা গুলিয়ে আসে। চারপাশে অনেক অনেক মানুষ। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। শুধু যুবকের কোন কাজ নাই। সিনেমার নাম শুনে পাগলা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে।

হলদেটে দাঁত বের হয়ে আসে দাড়ির ফাঁক দিয়ে। হাতের লাঠিটা এদিক সেদিক ঘুরাতে থাকে। কাজ করার চেষ্টা করে যেন। মাউসের হুইলটা ঘুরে যায়। পর্দায় দৃশ্যগুলো রিভার্স হয়, একটার পর একটা এসে আবার মিলিয়ে যায়।

একটা ছেলেকে দেখা যায়। ভোরবেলা উঠে পুকুরে ডুবিয়ে গোছল করে। মসজিদের পাশের ঈদগাহটা ঝাট দেয়। হোগলা পাতার পাটি বিছায়। বন্ধুদের সাথে কোলাকুলি করে।

নারকেলের চেড়ায় ফেলে দা-বটিতে ধার দেয় পোড়াবালিতে ঘষে। একহাতে বালতি আরেকহাতে দা নিয়ে ছোটে। ভিতর বাড়ি থেকে কুঁড়া নিয়ে আসে। কুকুর তাড়ায়। ঢোল বানাতে গরুর পেটের ভিতরের কোন একটা পর্দা তুলে দেবার আবদার করে বাবার কাছে।

বালতি নিয়ে অনেক কষ্টে বাড়ির পথ ধরে। নাকের ডগায় চিকচিক করে ঘাম। সন্ধ্যায় সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। বাবার কোলে চড়ে বিছানায় যায়। মায়ের গলা ধরে ঘুমায়।

ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে থাকে। ছোটু খেলা থামিয়ে দৃশ্যগুলো দেখে। অনেক মজা লাগে তার। হি হি করে হাসে একবার। আবার খেলায় মন দেয়।

সে খেয়াল করে না তার নাকের ডগায়ও পর্দার ছেলেটার মতো ঘাম চিকচিক করে। একটা বাসস্ট্যান্ড। যুবক এদিক সেদিক হাঁটে। একটা চা-স্টল দেখা যায়। এক কাপ চা খায়।

একটা গাড়ি আসে। গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। যুবক দৌড়ে গিয়ে ওঠে গাড়িতে। কন্টাক্টর বলে ভাই ভাঙ্গতি টাকা দিয়েন। ত্রিশ টাকা ভাড়া।

একজন সাদা দাড়ির মানুষ বসে আছে। যুবক তার পাশে বসে। সালাম দেয়। - এই গাড়ি কি গাজীপুর চৌরাস্তা যাইবে চাচা? - হ চৌরাস্তা যাইবো। - এহনকার হেল্পারগুলা কিছু কয় না।

- আগে কইয়া দিতো কহন কোন স্টান আইছে, কই যাইবো। - হগলে খালি মাইনষের দোষ ধরে। নিজেরডা কেউ দ্যাহে না। - আওয়ার সোম দ্যাখলাম কুমিল্লায় তিনজন রাস্তার মধ্যে শোয়াইয়া রাখছে। - গাড়ি এক্সিডেন্ট।

- আপনি কোন জায়গা থেকে আসছেন? - আমি আসছি লক্ষ্মীপুর থাইকা। - কই যাইবেন? - হাউজ বিল্ডিং। কিবোর্ডে আঙ্গুলের খেলা বাড়ে। যুবক ভাবে এই বয়সের মানুষগুলা মনে হয় এইরকমই। কথা বলতে ভালবাসে।

নিজের বাবার কথা মনে পড়ে যুবকের। জোর করে ভাবনাটা দূরে সরায়। হ্যান্ডসেটে ব্রাউজার খোলে। নিউজ হেডলাইন। গত দুই দিনে সারাদেশে কমপক্ষে ১৩ জন সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত।

যুবকের মনটা খারাপ হয়ে যায়। আর দেখতে ইচ্ছে করে না। গাজীপুর চৌরাস্তা গিয়ে নেমে যায়। ডানদিকে চলে যাওয়া রাস্তাটায় গিয়ে আরপি গেট যাবে নাকি জিজ্ঞেস করে। একজন বলে না রাস্তার ঐপাস থেকে যেতে হবে।

যুবক বুঝতে পারে একটা পয়েন্ট মিস করেছে সে। গাজীপুর চৌরাস্তাকে রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা ভেবেছে। একটা ম্যাক্সিতে ওঠে যুবক। দুইপাশে সারি সারি গজারি আর আকাশমণি গাছ। মাঝখানে এখানে ওখানে নতুন স্থাপনা।

জঙ্গল খেয়ে ফেলছে মানুষ। মাটি গিলে ফেলছে মানুষ। একটা মেয়ে কথা বলে ওঠে। - কিরে তরে না কইলাম ফ্যাক্টরির অইহানে নামাইয়া দিতি? - আগে কইবেন না? - আরে আমিতো পরথম থাইকাই কইতাছি। - অই থামান নামবো একজন।

- অহন আমি যামু ক্যামনে। আমারে তো জবাই করবো। হুইলটা ঘোরে। পর্দায় একটা দৃশ্য। চকচকে লোলুপ দৃষ্টি।

কিছু লকলকে জিহ্বা। লালা ঝরে ঝরে পড়ছে। একটা বইয়ের পাতা ওল্টাতে দেখা যায়। একটা পৃষ্ঠায় এসে থেমে থাকে। একটা আর্তচিৎকার।

কিছুক্ষণ গোঙ্গানি। শুকনো পাতার খসখস শব্দ। গজারি গাছের বন। বনের মাঝখানে কোথাও ঝোপঝাড়। চাঁদনী রাত।

জোৎস্নার বাড়াবাড়ি। চাঁদের আলোয় ঝোপের পাশে সাদা অস্তিত্ব। দৃশ্যটা কাছে আসে। একটা নারী দেহ। ঠোঁটের কোণা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ার দাগ।

অনাবৃত দেহ ফ্যাকাসে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। কাছেই ঝোপের নিচে পড়ে আছে সালোয়ার কামিজ ওড়না। আশেপাশে কোথাও কোন সাড়াশব্দ নাই। চাঁদের রূপালি আলো দেহটার চারপাশে। দূর থেকে অশরীরি মনে হয়।

গা ছমছম করে ওঠে। ক্ষ্যাপা বল'টা ধরে ফেলে। ছোটু থেমে যায়। কানে আঙ্গুল দেয়। একবার হি হি করে হাসে।

চোখ বুজে থাকে। ক্ষ্যাপা: কু.... বাচ্চারা। লেখু: আরে গালাগালি কর কেন? ক্ষ্যাপা: গালাগালি করমু নাকি কোলে তুইলা নাচমু তাগোরে? আমি খুন করমু একটা একটা কইরা। লেখু: তুমি শুধু অই পাজল মিলিয়েই যাবা সারাটা জীবন। আর কিছুই পারবা না কখনো।

ক্ষ্যাপা: তাইলে কি তর মতো নপুংসক কবি হমু নাকি। পারবি একটা ধর্ষণ ঠেকাইতে? পারবি কইলজা বরাবর বন্দুক চালাইতে? পারবি আরেকটা "বিদ্রোহী" লিখতে? পারবিতো শুধু কবিতার প্রসব বেদনায় কাতরাইতে। আর কিছু করার জো নাই। শালা ছাইয়া। খালি পাজলডা মিলাইয়া লই খাড়া।

প্রথম খুনডা আমি তরে দিয়াই শুরু করমু মনে রাখিস্। পাগলা: এ্যাটা....ক। এ্যাটা...ক। আক্রম.....ণ। বল'টা ছেড়ে দেয় ক্ষ্যাপা।

পাগলা সটান দাঁড়িয়ে লেফ্টরাইট করা শুরু করে। ছোটু মজা পায়। সে ব্যাটটা বন্দুকের মতো করে কাঁধে ঠেকিয়ে পাগলার সাথে লেফ্টরাইট করতে থাকে। একটু পরে পাগলা থেমে যায়। রাগে গজগজ করতে থাকে।

ছোটু খেলায় মন দেয় আবার। - অই মিয়া কানের মইধ্যে তো ঘন্টা হান্দাইয়া রাখছো। গাড়ি ঠিক মতো চালাও। - আমিতো ড্রাইভার না। য্যায় ড্রাইভার হ্যায় ঠিক অই আছে।

- আর এই রাস্তায় গাড়ি চালাইলে এক্সিডেন্ট অইবোই। পাগলা চিৎকার করে ওঠে: এক্সিডেন্ট অইবোই, এক্সিডেন্ট অইবোই। তিন জন, তের জন, ত্রিশ জন, একশ' জন, এক হাজার জন। এমনেই মারমু তোগরে এমনেই মারমু। বহুত বারছোস্ তোরা, বহুত।

পর্দার দৃশ্য পাল্টায়। কিছু বিভৎস বিকৃত লাশ। কিছু মানুষের আহাজারি। বাবা হারা অথবা মা। অথবা প্রিয় সন্তান হারা বাকরুদ্ধ জনক জননী।

খাটিয়া নিয়ে মেঠো পথ ধরে হেঁটে যায় টুপি পড়া মুসুল্লীরা। বাঁশঝাড়ের তলায় খোরা কবরে নামিয়ে রাখে প্রিয় মানুষটার দেহ। বায়বীয় কিছু একটা আশেপাশে ঘোরে। কেউ দেখে না। দেখতে পায় না।

গল্পটা এগুতে থাকে। বড় হয়ে যাচ্ছে। লেখকের ক্লান্ত লাগে। বর্ণনায় তাড়াহুড়া চলে আসে। পর্দার দৃশ্যগুলো দ্রুত বদলায়।

- আমার মামাতো ভাই। - অরে কইলাম টিভি ছাইড়া দিছি। তুই এইহানে বইয়া বইয়া দ্যাখ। - হ্যায় কয় হ আমি এইহানে বইয়া বইয়া টিভি চাইতাম, না? হুইলটা ঘোরে। একটা ছেলে।

অনেক চেনা। দুরন্তপনা, খেলাধুলা, ছুটোছুটি অবিরাম। বসে থাকাটাই অনেক বড় কষ্ট। মার্বেল, ডাঙ্গুলী, গোল্লাছুট, ক্রিকেট, ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্ধা। সন্ধ্যা নামে।

ধূলোবালি মাখা প্যান্ট। মায়ের বকুনি। হাত-পা-মুখ ধুইয়ে কোলে তুলে চুমু। জোৎস্নার আলোয় উঠোন। অবাক আলোর দীপ্তি জোনাকি তারা।

রূপকথার রাজ্য। সোনার কাঠি রূপোর কাঠি। ঘুমপাড়ানী পরী। ঠোঁটের কোণে হাসি। চোখের পাতায় স্বপ্ন।

ছোটু হি হি করে হাসে। একটু ক্লান্ত লাগে বুঝি। ব্যাট'টা সরিয়ে রাখে একপাশে। ক্ষ্যাপার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে চুপচাপ। ক্ষ্যাপা একবার নরম চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।

আবার পাজল মেলাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। ছোটু ঘুমিয়ে পড়ে। ঠোঁটে ঝুলে থাকে তৃপ্তির হাসি। - গরুর ঠ্যাং ঠুং আর আনা অইলো না রে। - এইসব তো বাড়িঅলার কাম।

- বাড়িঅলায় তো গ্যাছে গা। - হ বাড়িঅলায় ঘুমাইতে গ্যাছে। ক্ষ্যাপা: বাড়িঅলা কেডা-রে লেখু? লেখু: বাড়িঅলা যুবকের বন্ধুর বাবা। গত বছর এই সময়ে বেঁচে ছিল। পাগলা বিড়বিড় করতে থাকে একটু জোরে।

বোঝা যায় কিছু। কিছু বোঝা যায় না। পাগলা: আমি ঘুমামু। আমিও ঘুমামু। সবাই ঘুমাইবো সবাই।

তরাও ঘুমাবি। ঘুমাইতে তোগো অইবোই। কই পলাইবি? পলানের কুনো জায়গা রাহিনাই, রাহিনাই। পাগলার গলা নিচু হয়ে আসে আর তেমন কিছু বোঝা যায় না। বিড়বিড় করতে থাকে সে।

একটা গাড়ি। পাঁচ ছয় জন যাত্রী। যুবক বসে আছে বাম পাশের একটা সিটে। বাইরে জোৎস্নার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। জোৎস্নাধোয়া অদ্ভুত সবুজ দুইপাশে।

গাড়িটা চলতে থাকে। আকাশটা সাথে সাথে চলে। চাঁদটাও। আলোটাও। যুবকের মনে হয় অনন্তকাল ধরে সে চলছে এইভাবে।

অথবা চলার ইচ্ছেটা জেগে থাকে। কোন অনুভূতি নাই। লালসা নাই। ক্রোধ নাই। লাল মাংস নাই।

ত্যাগের তেলে জবজবে হাত নাই। আর্তনাদ নাই। সাদা অশরীরি অস্তিত্ব নাই। আহাজারি নাই। ভয় নাই।

ক্লান্তি নাই। ইট-কংক্রিটের বন্ধন নাই। কষ্ট নাই। অভিমান নাই। ভালবাসা তাও খুব বেশি নাই।

শুধু আছে শূন্যতা। অসীম শূন্যতা। মাউসের হুইলটা যদি আর না থামে কখনো। ঘুরতেই থাকে। ঘুরতেই থাকে।

- ইশ কি... সুন্দর চাঁদ...! কি যে সুন্দর আলো বাইরে, কি যে সুন্দর...! - এই ছোটু যাবি ঘুরতে বাইরে? - হ্যাঁ যাব আপুমণি। আজকে অনেক ঘুরবো। অনেক। - এই আম্মা চলো না বাইরে যাই। চলো চলো উমমম...! - আচ্ছা আমি হাতের কাজগুলা সব গুছিয়ে শেষ করি, তারপর যাব সবাই মিলে।

ছোটু আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। কি যে খুশি লাগে, কি যে খুশি লাগে...! ক্ষ্যাপার মাত্র কয়েকটা মুভ বাকি থাকে পাজল মিলাতে। আনমনে হাত থেমে যায়। আর ভাল লাগে না। সোফার গায়ে শরীর এলিয়ে দেয়।

ঘুমিয়ে পড়ে। লেখুর হাত থেমে থাকে কিবোর্ডে। আর লিখতে ইচ্ছে করে না। গল্পটা অসমাপ্ত থেকে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে টেবিলে মাথা রেখে।

পাগলা শুধু একা দাঁড়িয়ে থাকে একহাতে লাঠিটা ধরে রেখে টানটান। অনন্ত সময়ের প্রহরী।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।