আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকা ডেথ্ সিটি নয় ঢাকা ডেথ্ পিপল সিটি



ইদানিং অনেকে ঢাকাকে ডেথ্ সিটি বলে অভিহিত করতে শুরু করেছে। অনেকে উৎসাহের সঙ্গে তা প্রচারও করছে। পত্রিকার পাতা, সভা-সমিতি, টক-শো সব কিছুতেই ‘ডেথ্ সিটি’ শব্দটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে আসলেই কি ঢাকা মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে? নাকি ঢাকাকে নিয়ে চলছে নতুন করে কোন ষড়যন্ত্র? দখলদার ও ক্ষমতাশালীদের দৌতাত্ম্যে ইতোমধ্যেই ঢাকার যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। তারপরও প্রতিনিয়তই গ্রহণ করা হচ্ছে এ শহরকে ব্যবচ্ছেদ করার নানা পদক্ষেপ।

অপরিপক্ক সব পরিকল্পনায় বিপর্যস্থ এ নগরী আজ সত্যিই বিপদের মুখোমুখি। তবে এজন্য এই তিলত্ত্বমা শহরকে মৃত বলে ঘোষণা করা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আদিতে কেমন ছিল এ শহরের পরিবেশ এ প্রশ্ন জাগাও অবান্তর নয়। আদিতে ঢাকায় আজকের মত এতো পথঘাট ছিল না। শহর জুড়ে ছিল জল আর জঙ্গল।

শহরের পরিধিও ছিল কম। শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের বেশকিছু উপাসনালয়। শহরের যোগাযোগের পথ ছিল প্রধানত জলপথ। নৌকাই ছিল অন্যতম বাহন। লোকসংখ্যাও ছিল না খুব বেশি।

প্রায় আড়াই শ বছরের স্বাধীন সুলতানী শাসনের অবসানের পর ১৬১০ সালে ঢাকা হয়ে উঠে মোগল বাংলার রাজধানী। এ সময় থেকে শহরের জলাশয়ের পাশে বিশেষ করে বুড়িগঙ্গা নদী ও ধোলাই খালের পাড়ে ধীরে ধীরে বসতি বাড়তে থাকে। ঢাকা পেতে শুরু করে নগরের চেহারা। জলপথের পাশাপাশি সড়ক পথ বাড়তে থাকে। ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথমার্থ পর্যন্ত ঢাকার পরিচিতি ছিল ‘বাগানের শহর’ নামে।

অল্প কিছু বসতি বাদে সারা শহরই ছিল গাছ-গাছালিতে ভরপুর। শহরের জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ি ছাড়াও মসজিদ, মাজার, মন্দিরসহ শহরের প্রায় প্রতিটি উপাসনালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ছিল বাগান। শহর জুড়ে এ সব বাগানের বেশিরভাগই গড়ে তোলা হয়েছিল পরিকল্পিত ভাবে। অবশ্য বেশ কিছু অপরিকল্পিত বাগানও ছিল। ঢাকার বেশ কিছু আদি মহল্লা-এলাকার নামের শেষে পাওয়া যায় বাগ বা বাগিচা শব্দটি।

যেমনÑ বাগে পাদশাহী, গোলাববাগ, পরীবাগ, শাহবাগ, হাজারীবাগ, স্বামীবাগ, গোপীবাগ, সোবহানবাগ, কাজীরবাগ, মীরেরবাগ, মীর্জাবাগ, মীরহাজীরবাগ, লালবাগ, করিমউল্লাহবাগ, আলমবাগ, তাহেরবাগ, তল্লাবাগ, ইসলামবাগ, মালিবাগ, সবুজবাগ, আহম্মদবাগ, রাজারবাগ, আরামবাগ, শহীদবাগ, মোমেনবাগ, গুলবাগ, শান্তিবাগ, চামেলীবাগ, আমিনবাগ, গুলিস্তান, মীরবাগ, শাহআলীবাগ, টোলারবাগ, বড়বাগ, পীরেরবাগ, বকশীবাগ, হাতেমবাগ, মধুবাগ, নজরুলবাগ, নবাবেরবাগ, বাগিচা, নবাব বাগিচা, মুসা খা কি বাগিচা, নীলক্ষেত বাগিচা ইত্যাদি। অনেকে ফুলবাড়িয়া নামটি ফুলের বাড়ি অর্থাৎ ফুলের বাগান থেকে এসেছে বলে ধারণা করে থাকেন। তবে সবগুলোতেই বাগান ছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। প্রাক মোগল আমলেই শহরের পশ্চিমে একটি এলাকা লাল ফুলের বাগানের কারণে নাম হয়েছিল লালবাগ। পুরনো হাইকোর্ট ভবন থেকে বর্তমান সড়ক ভবন পর্যন্ত মোগলরা গড়ে তুলেছিল ‘বাগ-ই-বাদশাহী’ বা ‘বাদশাহী বাগান’।

বাগানটি পরে পরিচিতি পায় ‘রমনা’ নামে। ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার নবাবরা ঘোড়দৌড়কে জনপ্রিয় করার জন্য রেসকোর্স এলাকায় শাহবাগ নামে একটি বাগান গড়ে তোলে। ১৮৬৪ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি প্রতিষ্ঠার পর শহরে করোনেশান পার্ক, লেডিস পার্ক, ভিক্টোরিয়া পার্ক, রাজার দেউরী পার্ক গড়ে তোলা হয়। এছাড়াও পরিকল্পিত বাগান বা পার্কের মধ্যে ছিল ফিনিক্স পার্ক, কোম্পানি বাগিচা, ভিক্টোরিয়া পার্ক, সিরাজদ্দৌলা পার্ক প্রভৃতি। মোটকথা শহরের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘনবসতির এলাকা ছাড়া বাকি প্রায় পুরো শহরটা জুড়েই ছিল গাছগাছালি।

অবশ্য ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার বড় বাড়িগুলোতেও ছিল বাগান ও বিভিন্ন প্রজাতির বহুবর্ষজীবী সব গাছ। জমিদার বাড়িগুলোতে বাগান ছিল প্রধান অঙ্গ। পূজার ফুল সংগ্রহের জন্যই সম্ভবত বাড়িতে বাগান করা হত। অবশ্য আদিতে ঢাকার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রত্যাহিক নানা কাজে ফুলের ব্যবহার ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে শহরের ধনাঢ্য, প্রভাবশালী, জমিদার, নবাব, বিদেশী বণিক, কোম্পানির কর্মকর্তাসহ অনেকেরই ছিল ব্যক্তিগত বাগানবাড়ি।

এসব বাগানবাড়িতে থাকত নানারকম বিনোদনের ব্যবস্থা। বিভিন্ন ধরনের সৌখিন পশু-পাখির বিচরণ ছিল বাগানবাড়ির আঙ্গিনা। অবসর সময় মালিকরা বাগানবাড়িতে পরিবার পরিজন বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে অবস্থান করত। ইংরেজ শাসনামলে ঢাকার নবাবদের বাগানবাড়ি ছিলÑ শাহবাগ, দিলকুশা, পরীবাগ ও বাইগুনবাড়িতে। ওলন্দাজ ও ফরাসিদের বাগানবাড়ি ছিল তেজগাঁ এলাকায়।

১৮৪০ সালের দিকে রমনার উত্তরাংশে অনেকে বাগানবাড়ি নির্মাণ করে। এরমধ্যে আরমানিয়ান জমিদার আরাতুনের বাগানবাড়ি ছিল বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আণবিক শক্তি কমিশনের স্থলে। জজ ফ্রানসিস গ্রিফিথ তার বাড়ি নির্মাণ করেন এর কিছুটা উত্তরে। অবশ্য অবসর গ্রহণের পর তিনি নবাব আবদুল গণির কাছে বাড়িটি বিক্রি করে দেন। আরমানিয় (মতান্তরে, আমেরিকান) কাচাতুরের বাড়ি ছিল বাবুবাজার পুলের উত্তর-পশ্চিমে আর কাজী আলাউদ্দিন রোডের মোড়ে পশু হাসপাতালের স্থলে ছিল তার বাগানবাড়ি।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে রজনীকান্ত চৌধুরী ও দীননাথ সেন গেণ্ডারিয়ায় এলাকায় জমি কিনে বাগানবাড়ি নির্মাণ করেন। জমিদার আকমল খান শ্যামপুরে নদী তীরে বাগানবাড়ি নির্মাণ করেন। ঋষিকেশ দাস গোলাপ ফুলের অপূর্ব বাগান সহ ১৯৩০ সালে গোপীবাগে নির্মাণ করেন রোজ গার্ডেন। তবে বলধার জমিদারের বাগান ছিল ঢাকার সবচেয়ে খ্যাতনামা। দেশ বিদেশের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি তার এই বিচিত্র গাছের সমাহারে গড়ে তোলা বাগান পরিদর্শন করেন।

গাছ-গাছালি মানেই মাটি-জলের সম্পর্ক। গাছের জন্য উপযুক্ত মাটি যেমন ছিল ঢাকায় তেমনি ছিল জলের সংস্থান। শহরের দক্ষিণে অনন্ত যৌবনা বুড়িগঙ্গা, একপাশে তুরাগ, অন্যপাশে বালু, কাপাসিয়া, পাণ্ডু, দুলাই নদী। আর শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা ধোলাই খাল। ধোলাই খাল ছাড়াও শহরে ছোট বড় খালের সংখ্যা ছিল প্রায় শতাধিক।

প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পুকুর। ঝিল-হৃদ-ডোবাও ছিল অসংখ্য। শহরের নদী-খালগুলোতে একসময় সাঁতার, নৌকাবাইচ প্রতিযোগীতা বেশ সারম্বরে আয়োজন করা হত। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে নদী-খালের তীরের নানাস্থানে বসত মেলা। হিন্দু সম্প্রদায়ের মূর্তি বিসর্জন, দাহন কার্য সম্পাদন, মুসলমানদের মৃতদেহ সমাহিত সবই হত জলাশয়ের আশেপাশে।

কয়েকটি সরকারি বাগান বা উদ্দ্যানে কিছু গাছ, সংরক্ষিত কিছু জলাশয় ছাড়া আজ শহরে নেই গাছ-পালা নেই জলাশয়। মড়ক লেগে এ শহরের গাছগুলো মরে যায় নি। খরায় জলাশয়ের পানি শুকিয়ে যায় নি। তাহলে কেন বার বার ঢাকাকে বলা হচ্ছে মৃত নগরী? আসলে কি সত্যই এই শহর মৃত হয়ে যাচ্ছে? নাকি এই শহরের মানুষগুলো মৃত? মানুষের বিবেক মৃত? প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়। আদিতে ঢাকায় কোন পরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল না।

শহরের সাধারণ মানুষ জলাশয়ের পাশে উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করত। উচ্চবিত্তের কাঁচা-আধাপাকা শৌচাগারগুলোও ছিল জলাশয়ের পাশে। উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ ও জলাশয়ে এই মল-মূত্র-আবর্জনা মিশে শহরের পানীয় জল ও বাতাসকে মারাত্মক দূষিত করত। ধোলাই খালের দু’তীরে ঘরবাড়িগুলোর বেশিরভাগ শৌচাগার ছিল এর দুই পাড় জুড়ে। ১৮৬০ সালের দিকে শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে শহরের সকল তরল আবর্জনা নদর্মা হয়ে ধোলাই খাল দিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলার পরিকল্পনা করা হয়।

এতে করে খালটি যেমন দূষিত হতে শুরু হয় ঠিক তেমনি শহরও হয়ে উঠে দূর্গন্ধময়। ১৯০৯ সালের দিকে প্রকৌশলীরা ধোলাই খাল ও এর শাখা প্রশাখাসহ বারো মাইল জলপথ বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করে। খালটি পরিবেশ দূষণ শুরু করলেও এর গুরুত্ব অর্শ্বীকার করতে পারেনি প্রশাসন। তাই এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হয়নি। পরে কাঁচা পায়খানার পরিবর্তে খাট্টা পায়খানার প্রচলন হলেও অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।

শহরের খাট্টা পায়খানাগুলো বড় বড় গর্তের সঙ্গে যুক্ত করা হত। নির্দিষ্ট গর্তে মলমূত্র জমে থাকায় পরিবেশ ও পানি আরো দূষিত হয়ে ওঠতে শুরু করে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে গর্তের ময়লা রাস্তায় উপচে পরে জনজীবন দূর্বিষহ হয়ে ওঠত। আগস্ট ১৮৫৯ সালে লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জেমস গ্রান্ট ঢাকায় আসেন। কিন্তু শৌচাগার ব্যবস্থার অপর্যাপ্তায় তিনি দ্রুত ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ঢাকার পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত বাগান-জলাশয়গুলো দখলদার, ক্ষমতাশালী, প্রতাপশালীদের দৃষ্টি থেকে বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারেনি। ব্রিটিশ শাসনামের শেষ দিক থেকে এই দখলদারিত্ব ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠে সমাজের সুবিধাভোগীরা। এসময় থেকে এখন পর্যন্ত শহরে যত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে তার প্রায় এই সবই হয়েছে শহরের বাগান বা জলাশয়ের উপর। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের সময় শহরের বহু গাছ কেটে ফেলা হয়। তবে এরপরের ইতিহাসটা বেশ করুণ।

অবকাঠামো উন্নয়ন... নাগরিক চাহিদা পূরণ... বাড়তি জনসংখ্যার আবাসন চাহিদা মেটাতে... যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের নামে সময়ের পাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে ঢাকার সৌন্দর্যের জ্যোতি চিহ্ন বাগান আর জলাশয়গুলোকে। দেশ ভাগের পর এই ধ্বংসলীলার মাত্রা আরো বাড়তে থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর এই ধারা কিছুটা স্লথ হলেও তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে আবার ঢাকার পরিবেশকে করা হয়েছে নগ্ন। আজ বয়োজ্যোষ্ঠরা কংক্রিটের কোন অবকাঠামো বা রাস্তা দেখিয়ে বলে এখানে একটা বাগান ছিল... ওখানে একটা খাল ছিল... ওপাশটায় একটা পুকুর ছিল... সবই ছিল! ভবিষ্যতে হয়ত বর্তমানে টিকে থাকা রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, ওসমানি উদ্যোন, বলধা গার্ডেন বা বুড়িগঙ্গার স্থানে কোন অবকাঠামো দেখিয়ে আমাদেরকেই বলতে হবে এখানে একসময় একটা পার্ক ছিল... একটা নদী ছিল... পাল তোলা নৌকা, গহনা নৌকা, বজরা নৌকা সবই এখন ইতিহাস। মোগল আমল থেকে শহরে স্থলপথের সুবিধা বাড়তে থাকে তবে ব্রিটিশ আমলেই ঢাকার রাস্তায় গোল চাকার বাহন চলতে শুরু করে।

কোম্পানি শাসনামলে ঢাকার রাস্তায় নামে ঘোড়াগাড়ি। প্রথমদিকে বাহনটি শাসকদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। পরে শহরের উচ্চবিত্তরা ব্যবহার করতে শুরু করে। আর ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে এই অভিজাত গাড়িটি পরিণত হয় গণগাড়িতে। ঢাকায় প্রথম কবে বা কে ঘোড়াগাড়ি আমদানি করে এ নিয়ে মতভেদ আছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় ঢাকার নায়েব নাজিম শামসুদ্দৌলার শাসনামলে (১৮২৮-৩২) আরমানিয় ব্যবসায়ী মি সিরকোর ঢাকায় একটি ঘোড়াগাড়ি আমদানি করেন। চার ঘোড়ার যানটি ছিল নবাব শামসুদ্দৌলার। সৈয়দ মুহম্মদ তৈফুরের মতে, বিশপ হেবার ঢাকায় এসে শামসুদ্দৌলাকে যে ল্যান্ডোটি গাড়িতে চড়তে দেখেন সম্ভবত সেটিই ঢাকার প্রথম চারচাকার বাহন। তবে ১৭৯০ সালে ঢাকার কালেক্টর ডগলাসের তথ্য সূত্রে, ঐ সময় ঢাকায় আগত জনৈক সৈনিক কয়েকদিন একটি ছ্যাকরা গাড়ি চালায়। তিনি ঢাকা ত্যাগের সময় গাড়িটি সঙ্গে করে নিয়ে যান।

কেদারনাথ মজুমদার ঢাকার বিবরণ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেনÑ “মি সিরকোর ‘হেকরী কেরেজ’ নামে অক্টোবর, ১৮৫৬ সালে প্রথম ঠিকা গাড়ি ঢাকায় আমদানি করে। চার বছরের মাথায় বহু ঠিকা গাড়ি দেখা যায়। ১০ বছরের মধ্যেই এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০টিতে। ১৮৬৭ সালে ঢাকায় ঘোড়াগাড়ির সংখ্যা ছিল ৬০টি, ১৮৭৪ সালে ৩০০টি এবং ১৮৯০ সালে এর সংখ্যা হয় ৬০০টি। ১৮৭৪ সালের পরে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি পথচারীদের রাস্তার একপাশ দিয়ে চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করে এবং এক্কা গাড়ি রাস্তার উপর দাঁড়ানর ব্যবস্থা হিসেবে রাস্তার বিশেষ স্থান চিহ্নিত করে দেয় ; এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় ১৪ বছরের নিচে কেউ এক্কা গাড়ি চালাতে পারবে না এবং রাতের বেলায় চাকাওয়ালা গাড়িতে বাতি ব্যবহারে বাধ্য করা হয়।

” শহরে ঘোড়াগাড়ির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ঘোড়ার আস্তাবল বা আড়গাড়া। বঙ্গবাজারের ফায়ার বিগ্রেটের স্থানে একসময় ছিল বিশাল আড়গাড়া। ঘোড়ার মল-মূত্রে পথঘাট নোংরা হতে শুরু হয়। দূষিত হতে থাকে শহরের বাতাস। তারপরও সড়কপথে শহরের অন্যতম পরিবহন ছিল এই ঘোড়াগাড়ি।

বিশ শতকের শুরুর দিকে জাপানে প্রথম রিকসার প্রচলন হয়। একই শতকের চতুর্থ দশকে ঢাকার রাস্তায় দেখা যেতে শুরু করে রিকসা। সম্ভবত ১৯৩৬/৩৭ সালে ঢাকার মৌলভীবাজারের দুই জন ব্যক্তি মিলে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ফরাসি উপনিবেশ কলকাতার চন্দননগর থেকে ১৮০ টাকায় দুটি সাইকেল রিকসা আমদানি করে। রিকসার বহুল প্রচলনে শহরে ঘোড়াগাড়ি কমতে শুরু করে। যত্রতত্র ঘোড়ার আস্তাবলের কারণে শহর ক্রমশ হয়ে ওঠছিল অপরিচ্ছন্ন।

এতে নাগরিক সমাজ থেকেও ঘোড়াগাড়ি অপসারণের একটি দাবি ছিল। ঘোড়াগাড়ি থেকে রিকসা আরামদায়ক হওয়ায় রিকশার প্রচলন বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে ঢাকায় রিকসা জনপ্রিয়তা না পেলেও কিছুদিনের মধ্যেই পরিবহনটি বেশ সাড়া ফেলে। কিন্তু শহরের অভিজাত ও ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যরা বহুদিন তাদের বনেদীয়ানা প্রকাশের জন্য ঘোড়াগাড়ি করেই যাতায়াত করত। পৌরসভার রেকর্ড মতে, ১৯৪১ এবং ১৯৪৭ সালে শহরে রিকসার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৭ এবং ১৮১টি।

অপরদিকে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় ঢাকায় প্রথম মোটর গাড়ি চালু করেন নবাব সলিমুল্লাহ। নবাব সলিমুল্লাহর বেশকিছু ছবিতে দেখা যায় কয়েকটি গাড়ি। এ গাড়িগুলো দিয়ে নবাব ও নবাব পরিবারের সদস্যরা শহর দাপিয়ে বেড়াত। পরে ঢাকার ইংরেজরা মোটরগাড়ি ব্যবহার করতে শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মাঝেও মোটর গাড়ি ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহরে প্রবেশ করে ইংরেজ সেনাদের গাড়ি। পাল তোলা নৌকা, ঘোড়াগাড়ি, রিকসা তারপরে মোটর গাড়ি। এভাবেই ঢাকার পরিবহণ ব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তন। তারপর আর থেকে থাকেনি ঢাকার জনসংখ্যা আর পরিবহনের সংখ্যা। সুবিধাভোগী ও ক্ষমতাশালীদের দৌরাত্ম্যে এই শহরের অন্যান্য খাতের মতো পরিবহন খাতও শহরের জনজীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ।

পরিবেশ ও মানুষের কথা চিন্তা না করে শহরের রাস্তায় নামানো হয়েছে পরিবেশ দূষণকারী যানবাহন। রাষ্ট্র পরিচালনায় সঠিক পরিকল্পনা, দুরদর্শিতার অভাব এবং সুষম বন্টনের অভাবে এ দেশে নগরমুখী ব্যবস্থার কারণে প্রতিদিন রাজধানী শহর ঢাকায় বাড়েছে লোকের সংখ্যা। আজ এ শহরে লোকসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। আর যানবাহনের সংখ্যা যে প্রকৃতপক্ষে কত তার হিসাব সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছেও নেই। মুনাফালোভীদের লোভাতুর দৃষ্টিতে হাজার বছরের প্রাচীন এই ঢাকা আজ এক সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে।

কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি শহর ঢাকার জলাশয়-বাগান-গাছপালা সবই অতীত হচ্ছে। এমনকি শহরের প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদীকে মেরে ফেলার সকল ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত হয়েছে। সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নামে ক্ষমতাশালীরা ততপর হয়ে উঠেছে। ঢাকার বুকে জেগে থাকা শত শত বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক-ঐতিহ্যময় ভবনগুলো ভেঙে ফেলতে মাঠে নেমেছে অনেকে। সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনাও করছে কেউ কেউ।

কিন্তু কেন? প্রতœতাত্ত্বি নিদর্শন এই সব ভবন ভাঙার জন্য এতো ব্যক্ত কেন কর্তৃপক্ষ? এই প্রশ্নগুলোও ক্ষতিয়ে দেখতে হবে। শত শত বছর ধরে যে ভবনগুলো টিকে আছে ঐ ভবনগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ নাকি নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মিত আধুনিক ভবনগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তার বিবেচনা করতে হবে। আবাসন ব্যসায়ীরা উঠে পড়ে লেগেছে ঢাকাকে মৃত নগরী প্রমাণ করতে। এতে করে ঢাকার বাইরে জলাশয় ভরাট করে-দখল করে যে পল্লীগুলো তারা নির্মাণ করেছে সেখানে হু হু করে বাড়ছে বাণিজ্য। আর শহরের ভেতরের ঝুঁকিপূর্ণ খেতাব দিয়ে ভেঙে ফেলা ভবনগুলোর স্থানে গড়ে তুলবে তাদের বাণিজ্যখানা।

মোটকথা আমাদের জীবন নিয়ে তারা আগ্রহ নেই। আগ্রহ হচ্ছে ব্যবসা বা মুনাফায়। এই মুনাফার স্বপ্নেই সবুজ ঢাকাকে পরিণত করা হয়েছে কংক্রিটের নগরীতে... সজীব বাতাসকে করে তোলা হয়েছে সীসাময়... টলটলে জলকে করা হয়ে আবর্জনাময়... বসতিকে করা হয়েছে মরণফাঁদ... তারপরও এই সব মুনাফাদারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মুক্তি নেই ঢাকার এবং ঢাকাবাসীদের। শহরটি মরে যায় নি, মরে গেছে এই শহরের মানুষগুলোর মনুষত্ব-মূল্যবোধ-নৈতিকতা-কৃতজ্ঞতা। উদ্দেশ্যহীন লক্ষ্যে ছুটে চলছে এ শহরের প্রতিটি মানুষ।

কেউ যানে না গন্তব্য কোথায়। মুক্ত বাজার অর্থনীতি আর বিশ্বায়নের জোয়াড়ে ভাসমান এ শহরের মানুষ ছুড়ছে আধুনিকায়ণের পেছনে। আধিুনিকায়ণ মানে কি? গাছ কেঁটে... জলাশয় ভরাট করে... ঐতিহ্যবাহি স্থাপনাগুলো ভেঙে পশ্চিমা ডিজাইন নকল করে বহুতল ভবন নির্মাণ? নাকি পরিবেশ বান্ধব যানগুলোকে বাতিল করে পরিবেশদূষণকারী গাড়ি আমদানি? সমাজের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞরা ক্ষমতাশালী-প্রশাবশালী-বিত্তবানদের পক্ষে যেয়ে এর যেরূপ বিশ্নেষণই করুক না কেন, এ শহরের সাধারণ বাসিন্দা হিসেবে আধুনিকায়ণের নামে এই ধ্বংসলীলা মেনে নেয়া সহজ নয়। মেনে নেয়া হবে এ শহরকে ‘ডেথ্ সিটি’ নামে প্রচার করার ক্যানভাসিং। যদি বলতেই হয় তবে বলতে হবে ঢাকা ‘ডেথ্ পিপল সিটি’ নট ‘ডেথ্ সিটি’।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.