আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের দীন অবস্থা



হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের দীন অবস্থা ডিজিটাল দিনাজপুর : ১৯৯৯ সালে উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় বিজ্ঞান শিক্ষার প্রথম উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি)। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল সাড়ে ৩০০। অনুষদ ছিল মাত্র একটি। ১০ বছর পর এখন শিক্ষার্থী প্রায় দুই হাজার, অনুষদ ছয়টি। গত এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়েছে শিক্ষার্থী, বেড়েছে অনুষদ।

তবে সে অনুযায়ী শিক্ষক, অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। এক দশকের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক, আবাসনসহ নানা সংকট তীব্র হয়ে উঠছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে একটু আলাদা। এখানে শিক্ষার্থীরা বিভাগে নয়, ভর্তি হন বিভিন্ন অনুষদে। স্নাতক পর্যায়ে এ ধরনের ছয়টি অনুষদ আছে।

এগুলো হলো কৃষি, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যবসায় শিক্ষা, ফিশারিজ, এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফুড প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স। এসব অনুষদের অধীনে মোট শিক্ষা বিভাগ বা বিষয় আছে ৩৯টি। যেমন কৃষি অনুষদে আছে ১২টি শিক্ষা বিভাগ। যাঁরা কৃষি অনুষদে পড়ছেন, তাঁদের এ ১২টি বিভাগেই পড়তে হয়। জানা গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৯ সালে যাত্রা শুরু করেছিল সম্প্রসারিত কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট হিসেবে।

১৯৮৮ সালে ইনস্টিটিউটকে কৃষি কলেজে রূপান্তর করা হয়। এর এক দশক পর ১৯৯৯ সালে এ কলেজকে রূপান্তর করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বলরাম রায় বলেন, গত ১০ বছরে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। শুধু ছাত্রদের একটি হল, প্রশাসনিক ভবনের একতলা বাড়ানো হয়েছে আর উপাচার্যের বাংলো হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা না বাড়লেও প্রতিবছর শিক্ষার্থী বাড়ছে।

শিক্ষক-সংকট: বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদে অনুমোদিত শিক্ষক পদের সংখ্যা ৪০২টি। বাস্তবে শিক্ষক আছেন মাত্র ১৫৯ জন। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন ফাহিমা খানম বলেন, নতুন অনুষদগুলোতে শিক্ষক-সংকট খুব বেশি। তাঁর অনুষদের অবস্থাও খুব খারাপ। সেখানে মাত্র ১৪ জন শিক্ষক আছেন।

এতে কাজ চালানো যাচ্ছে না। আরও অন্তত ১০ জন শিক্ষক হলে কোনোভাবে কাজ চালানো যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদের ডিন মো. আবদুল হামিদ বলেন, তাঁর অনুষদে শিক্ষকের মোট অনুমোদিত পদ আছে ৫০টি, কিন্তু শিক্ষক আছেন মাত্র ২৫ জন। তিনি বলেন, এভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো যায় না। প্রতিটি বিষয়ে অন্তত পাঁচজন করে শিক্ষক দরকার, কিন্তু তা নেই।

কোনো কোনো বিভাগে মাত্র একজন করে শিক্ষক আছেন। এ প্রসঙ্গে রেজিস্ট্রার বলরাম রায় বলেন, একসময় এটি ছিল কৃষি কলেজ। তাই কৃষি অনুষদে শিক্ষকের স্বল্পতা কম। কিন্তু নতুন চালু হওয়া অনুষদগুলোতে শিক্ষক-সংকট আছে, বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। তিনি জানান, অনুমোদিত পদ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন শিক্ষক নিয়োগের অনুমোদন দিচ্ছে না।

এ কারণে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। আবাসন-সংকট: রাবা মোসাররাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যখন হলে ওঠেন, তখন তিনি থাকতেন হলের খাবার কক্ষে (ডাইনিং রুম)। ওই কক্ষে তিনি একা নন, একসঙ্গে থাকতেন ৭৫ জন। কোনো খাট নেই, সবাই থাকতেন মেঝেতে। এরপর লেভেল-২-এ এসে তাঁর জায়গা হয় ‘গণরুমে’।

১৬ সিটের ওই কক্ষে তাঁরা একসঙ্গে থাকতেন ৩২ জন। লেভেল-৩-এ ওঠে তাঁকে যেতে হয় অন্য একটি কক্ষে। সেখানে তাঁরা থাকতেন আটজন। এরপর কিছুটা স্বস্তি। এক বিছানায় একা থাকার স্বাধীনতা।

শুধু রাবা মোসাররাত নন, বিশ্ববিদ্যালয়টির সব ছাত্রীকেই হলে থাকতে হয় এমন কষ্ট করে। যত সময় যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আবাসন সমস্যা ততই প্রকট হচ্ছে। মোসাররাত ভর্তি হয়েই হলে উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু এখন যাঁরা ভর্তি হচ্ছেন, তাঁরা লেভেল-১-এ কোনোভাবেই হলে ওঠার সুযোগ পাচ্ছেন না। ছাত্রীদের আবাসন-সমস্যা সমাধানের দাবিতে ছাত্রীরা একাধিকবার আন্দোলনও করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মেয়েদের হল মাত্র একটি। রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ নাজিম উদ্দিন জানান, মেয়েদের একমাত্র হলের মূল ভবনে ১২০ জন ছাত্রী থাকার ব্যবস্থা আছে। ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় এখন মূল ভবন ছাড়া আরও তিনটি ভবনে (এক্সটেনশন) ছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ২৪৪ জন ছাত্রী থাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেখানে থাকছেন প্রায় ৪০০ ছাত্রী।

তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার। অনেকই হলে থাকতে পারছেন না। ছাত্রীদের আবাসন-সমস্যা আগামী ডিসেম্বর নাগাদ কিছুটা কমবে বলে তিনি আশা করছেন। ছাত্রদের আবাসন-সমস্যা ছাত্রীদের মতো প্রকট না হলেও পর্যাপ্ত নয়। ছেলেদের জন্য মোট তিনটি হল আছে।

তিনটি হল মিলে প্রায় ৯০০ ছাত্রের আবাসন-ব্যবস্থা আছে। তবে কর্তৃপক্ষ এখন আর প্রথম বর্ষের ছাত্রদের হলে ওঠার অনুমতি দিতে পারছে না। জিয়াউর রহমান হলের (ডরমিটরি-২) প্রাধ্যক্ষ বিকাশ চন্দ্র সরকার জানান, তাঁর হলে ৩৩০ জন ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা আছে। সেখানে এখন ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ ছাত্র থাকছেন। গত বছর থেকে তাঁরা আর প্রথম বর্ষের ছাত্রদের হলে ওঠার অনুমতি দিচ্ছেন না।

খাবারের ব্যবস্থা নেই: বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ক্যানটিন থাকলেও সেখানে কোনো খাবার পাওয়া যায় না। ক্যানটিনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা খাওয়া-দাওয়া করেন বাইরের হোটেলে অথবা নিজেরা রান্না করে। জানা যায়, ক্যানটিনগুলোতে যে খাবার দেওয়া হতো, তা খুব নিম্নমানের। ছাত্ররা সেখানে খাওয়া-দাওয়া করতেন না।

এ কারণে আস্তে আস্তে ক্যানটিনগুলো বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমবারের মতো সেশনজট: ১০ বছরের মাথায় প্রথমবারের মতো ছয় মাসের সেশনজটে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। লেভেল-৩-এর শিক্ষার্থীদের এত দিনে দ্বিতীয় সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার কথা। সেখানে এখন চলছে প্রথম সেমিস্টার। জানা যায়, লিচু পাড়াকে কেন্দ্র করে দুই দল শিক্ষার্থীর মধ্যে গত ১৬ মে সংঘর্ষ হয়।

এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে কর্তৃপক্ষ ১০ ছাত্রকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার ও জরিমানা করে। এ ছাড়া ২৯ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি উৎসব পণ্ড করার ষড়যন্ত্র, একাডেমিক ভবনে তালা দেওয়া ও শিক্ষক লাঞ্ছিত করার অভিযোগে আরও পাঁচ ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। ১৫ ছাত্রের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষকদের অবরোধ করে অবস্থান ধর্মঘটসহ আন্দোলন শুরু করলে ২৯ জুন কর্তৃপক্ষ ৮ জুলাই পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। পরদিন এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাঙচুর চালান। এ ঘটনার পর ৫ জুলাই কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে।

অনির্ধারিত এ বন্ধের কারণেই শিক্ষার্থীদের প্রায় ছয় মাসের জটে পড়তে হয়েছে। অন্যান্য সমস্যা: শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হলেও শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন না ইন্টারনেট-সুবিধা। কোনো কোনো বিভাগে আছে শ্রেণীকক্ষ-সংকট। ফিশারিজ বিভাগের অনেকে ক্লাস করেন দাঁড়িয়ে, কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষার্থীরা ক্লাস করেন গবেষণাগারে (ল্যাবরেটরি) আর কৃষি অনুষদের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা ক্লাস করেন মিলনায়তনে। গ্রন্থাগারে নেই উন্নতমানের জার্নাল, ফিশারিজ অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্য হ্যাচারি বা ভালো মানের পুকুর।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আফজাল হোসেন এসব সংকটের বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষক-সংকটটাই বেশি। এখন ৩৯টি শিক্ষা বিভাগে প্রায় ৫০০ শিক্ষক দরকার, অথচ মাত্র ১৫০ জন শিক্ষক আছেন। কোনো কোনো বিভাগে শিক্ষক মাত্র একজন। তিনি অসুস্থ হলে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আবাসন-সমস্যার ব্যাপারে তিনি বলেন, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়টি পুরোপুরি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়।

তার পরও ছাত্রছাত্রীদের আবাসনের কিছু ব্যবস্থা আছে। ছাত্রীদের আবাসন-সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ১০ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন অনেক বলে তিনি মন্তব্য করেন। সূত্র : রিয়াদুল করিম-এর প্রতিবেদন [দিনাজপুর থেকে ফিরে ] দৈনিক প্রথমআলো, তারিখ: ০৬-১১-২০১০,

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.