আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দাগ-১৭ (এই দাগ হৃদয়ের, এই দাগ সমাজের)



শুভ্র বাসায় ফিরল মলিন মুখে। বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে প্রান্তিকের কাছে গেল। শুভ্র কোন কথা বলল না। সে তার রুমে চলে গেল। তার কম্পিউটারে একটা রবীন্দ্র সংগীত চালু করে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে নানান কথা ভাবতে লাগল, আসলে কি মায়া আর উর্মী এক না? আমি মায়াকে ভালবাসতাম, উর্মীকে আমি ভালবাসি না কিন্তু ক’দিন আগে জানলাম উর্মীর বড় বোন আছে।

সেদিন থেকে একটা দুশ্চিন্তা আমি মাথা থেকে সরাতে পারছি না। উর্মী যদি মায়া না হয় তবে আমি এতদিন সময় নষ্ট করলাম কি জন্য? আমি উর্মীর পরিচয় নিয়ে অনেকদিন কথা বলেছি কিন্তু সে কোনদিন ষ্পষ্ট করে বলেনি যে সে মায়া না। এত রহস্য কেন? আসলে উর্মী একটা রহস্যময়ী মেয়ে। প্রান্তিক মন খারাপ করে বলল, আম্মু আমি চাচ্চুর কাছে গেলাম চাচ্চু একটা কথাও বলল না। শুভ্র তো এমন করে না।

প্রান্তিক, প্রান্তিক বলে ডাকতে ডাকতে বাসায় ঢুকে সবাই একসঙ্গে বসে চা খাই। তারপর প্রান্তিককে নিয়ে তার রুমে গিয়ে কম্পিউটারে বসে। আজ আবার এমন আচরন করল কেন? সুরভী শুভ্র শুভ্র বলে ডাকতে ডাকতে তার রুমে গিয়ে তার কপালে হাত দিয়ে বলল, জ্বর টর হয়নি তো? না ভাবী। তবে এই অসময়ে শুয়ে আছিস্ কেন? শুভ্র কোন কথা বলল না। সুরভী বলল, চুপ করে শুয়ে আছিস্ কেন? এমন কি কথা যে আমাকে বলা যাবে না।

ভাবী আজ উর্মীকে তার এক আপার সঙ্গে কথা বলতে শুনলাম। হ্যাঁ তাতে কি হয়েছে? তাতে কি হয়েছে মানে? উর্মীর কথা শুনে বুঝলাম সে খুব অসহায়, আপা ছাড়া তার খোঁজ খবর নেবার আর কেউ নাই কিন্তু মায়ার কোন বড় বোন ছিল না, সে ছিল প্রতিষ্ঠিত পরিবারের মেয়ে, ঢাকা শহরে তার খবর নেওয়ার লোকের অভাব ছিল না। তুই এক কাজ কর, উর্মীর পার্সনাল ফাইল দেখ। ইমপসিবল, উর্মী এডিটরের খুব কাছের মানুষ, প্রায় এডিটর উর্মীকে ডেকে পাঠায়। কোন কারণে যদি তথ্য ফাঁস হয়ে যায় যে আমি উর্মীর পার্সনাল ফাইল দেখার চেষ্টা করেছি তবে আমার চাকরিটাই চলে যেতে পারে।

তাহলে উর্মীর কাছ থেকে জানতে চা সে আসলে মায়া কি না? ষ্পষ্ট করে জানতে চাবি কিংবা বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে তাকে দেখতে চাবি। জানি না এটা সম্ভব কি না? তবে কি সেই ছোটবেলার কোন্ মেয়েকে একবার দেখেছিস্ তাকেই বিয়ে করতে হবে। সে ছাড়া দুনিয়াতে আর কোন সুন্দর, শিক্ষিত মেয়ে নাই। আজকাল ছেলেমেয়েরা কতজনের সঙ্গে প্রেম করছে আবার হাসতে হাসতে বিদায়ও করে দিচ্ছে আর তুই একটা মেয়ে ছাড়া আর কাউকে চোখেই দেখিস্ না। আব্বা বলে গেছে দু’য়েক মাসের মধ্যে তোর ডিসিশন জানাতে।

এখন আয় চা খাবি। নকশী প্রথমে উর্মীর প্রতি শুভ্রর ভালবাসা পরীক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছিল। পরীক্ষা করতে গিয়ে উর্মীর কাছ থেকে শুভ্রর প্রশংসা শুনতে শুনতে আর শুভ্রর ব্যক্তিত্ব দেখে নকশী অনেকটা অবাক হয়েছে। নকশী কাউকে আগ বাড়িয়ে এস.এম.এস দেওয়া তো দূরের কথা কাউকে কোনদিন একটা মিস্ কলও দেয়নি। তারপরও কেমন করে যেন তার মোবাইল নাম্বারকিছুদিন পর পর অনেক ছেলের হাতে চলে যায়।

হয়ত রিচার্জ করার সময় কেউ নাম্বারটুকে নেয় কিংবা এমনিতেই কল দিয়ে মেয়ে কন্ঠের কথা শুনে সুযোগ পেলেই দিন-রাত উত্যক্ত করতে থাকে, ফ্রেন্ডশীপ কিংবা প্রেমের প্রস্তাবও দেয় আবার কোন বখাটে ছেলে আজবাজে এস.এম.এস পাঠিয়ে দেয়। নকশী শুভ্রর বেলায় ব্যতিক্রম পেল। নকশীর ইচ্ছা হলো একবার শুভ্রর সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু এটাও কি সম্ভব? শুভ্র তো তার সঙ্গে কথাই বলতে চায় না তার সঙ্গে দেখা করা কি কম কথা? আসলে শুভ্রকে এভাবে তার সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষা করা ঠিক হয়নি। শুভ্র যদি তার ডাকে সাড়া দিত তবে একটা ভদ্র ছেলে তার কলীগ-এর কাছে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেত, না নকশী আর শুভ্রকে পরীক্ষা করবে না।

আজ রাতে তো শুভ্রকে মোবাইল করার কথা, সেই সন্ধ্যা থেকেই নকশী শুভ্রকে মিস্ করছিল কিন্তু শুভ্র বিরক্ত বোধ করতে পারে তাই মোবাইল করেনি। আসলে শুভ্র কি নিজেকে খুব বড় ভাবে? নকশী শুভ্রকে মোবাইল করল, হ্যালো। অপর পাশ থেকে শুভ্রর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, বলুন। নকশী জিজ্ঞেস করল, আপনি কি বিরক্তবোধ করছেন? না বিরক্ত বোধ করব কেন? না সকালবেলা বলেছিলেন আমি রিং না করলেই আপনি খুশি হবেন তারপরও আমি রিং করেছি বলে। না বলুন আমি বিরক্ত হচ্ছি না।

কেমন আছেন আপনি? ভাল, আপনি? ভাল। কি করছিলেন? আপনার কথা ভাবছিলাম। আমার কথা ভাবছিলেন মানে? কেন আমি কি আপনার কথা ভাবতে পারিনা। আপনার কথা শুনে খুব খুশি হলাম, তা হঠাৎ করে আমার কথা ভাবতে শুরু করলেন কেন? আপনি আমার সঙ্গে ফ্রেন্ডশীপ করতে চাচ্ছেন, আমাকে সুন্দর সুন্দর ম্যাসেজ পাঠাচ্ছেন। তাতে আমিও ইন্সপায়ার্ড হচ্ছি।

রিয়্যালি? কিন্তু একটা কথা কি জানেন? কি কথা? আপনি আমাকে সুন্দর সুন্দর এস.এম.এস পাঠাচ্ছেন, মোবাইল করছেন আর আমি আপনাকে এভয়েড করছি, আমার মনে হয় এটা আমার ঠিক হচ্ছে না। আসলে তার আগে আমাদের ভালভাবে পরিচয়টা হওয়া উচিত। আমি নকশী, এবার হোম ইকনোমিক্স থেকে নিউট্রিশন এন্ড চাইল্ড হেল্থ-এ অনার্স পাস করে এখন একটা এন.জি.ও’তে কাজ করছি। আমাদের গ্রামের বাড়ী রাজশাহী, রাজশাহী শহরে বাবার ব্যবসা আছে, উপশহরে আমাদের বাড়ী। আমরা এক ভাই-এক বোন।

আমি বড়। শুভ্র বলল, আপনি তো বোধ হয় আমাকে চিনেন? চিনি না তা না আবার যে ভালভাবে চিনি তাও না। কেন? আপনি আমার মোবাইল নাম্বারযার কাছে পেয়েছেন তার কাছে নিশ্চয়ই আমার পরিচয়ও পেয়েছেন,ও ভাল কথা আপনি আমার মোবাইল নাম্বার কার কাছ থেকে পেয়েছেন বলুন তো? সেকথা না হয় সাক্ষাতে বলব, এখন আপনার পরিচয়টা একবার আপনার মুখ থেকে শুনি। আমি শুভ্র, ঢাকা ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছি কিন্তু সে বিষয়ে চাকরি পাইনি তারপর কম্পিউটার কোর্স করে এখন একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করছি। বাবা রিটায়ার্ড সরকারী কর্মচারী।

আমাদের গ্রামের বাড়ী পাবনা জেলার আতাইকুলা উপজেলায়। আমরা দু’ভাই আমি ছোট। বড় ভাইও এম.বি.এ করে এখন একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। ভাই, ভাবী আমার ভাতিজা প্রান্তিক আর আমি, এই চারজনকে নিয়ে আমাদের সংসার। আরেকজন শীঘ্রই আসবে।

মানে? মানে আমি বিয়ে করব না? আমার জন্য ভাই-ভাবী এবং আমার অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরামেয়ে দেখছেন। আপনার কোন পছন্দ নাই? সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। কি রকম? শুভ্র মায়ার সঙ্গে তার লেখাপড়া থেকে শুরু করে চাকরি জীবনে আবার পরিচয় হওয়ার কথা বলল। আপনি চিনতে পারছেন না? আরে চিনতে পারব কি করে? সে তো সব সময় বোরকা পরে থাকে। যেন তেন বোরকা না একেবারে নাক ঢাকা বোরকা তারপর আবার চোখে চশমা।

চেনার কোন উপায় নাই। স্ট্রেইঞ্জ! আপনি মেয়েটাকে বলেননি যে আপনি মায়া কি না? অনেকবার কৌশলে বুঝাতে চেয়েছি কিন্তু সে একথা বললেই এড়িয়ে যায়। মেয়েটা খুব মিস্ট্রিয়াস। আসলে মানুষের জীবনে বিয়ে একবারই হয় এটা খুব দেখেশুনে, ভেবেচিন্তে করতে হয় কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি এখনো সেই আবেগ ধরে রেখেছেন এটা ভাল তবে আবেগের বশে বিয়ে করা ঠিক না। অবশ্য বিষয়টা আপনার একান্ত ব্যক্তিগত।

না আমি তার জন্য আর সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না। খুব আনন্দের কথা। তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলুন, আমাকে দাওয়াত দিতে ভুল করবেন না কিন্তু। কনেটা তো আপনিও হতে পারেন? আপনি তো আমাকে দেখলেনই না, তাতেই আমাকে বিয়ে করবেন? দেখিনি কিন্তু দেখব, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন না? নকশী একটু হাসল, তারপর মনে মনে বলল, মেঘ না চইতেই জল। নকশীর কোন সাড়া না পেয়ে শুভ্র বলল, কি কথা বলছেন না যে? হ্যাঁ অবশ্যই কিন্তু কবে কোথায়? যে কোন দিন, কোন রেস্টুরেন্টে? ওকে।

নকশী মোবাইল রেখে দিল। নকশীর দরজায় নক করার শব্দে সে দরজা খুলে দিল, হেমা আপা। হ্যাঁ তুই ঘুমাস্নি? না। নকশী তাড়াতাড়ি তার মোবাইলের কল রেকর্ড থেকে শুভ্রর নাম ডিলিট করে দিল। কার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বললি? আমার এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে।

কোন্ ফ্রেন্ডের সঙ্গে? নকশী আপা বলে মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝালো এটা তার জিজ্ঞেস করা ঠিক হয়নি। হেমা বলল, সরি নকশী তোর ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলা আমার ঠিক হয়নি, তুই ঘুমা। হেমা নকশীর রুম থেকে বের হয়ে তার নিজের রুমে গেল। উর্মী তখন মলিন মুখে বিছানায় শুয়ে ছিল। হেমা উর্মীর বিছানার কোণায় গিয়ে বসল।

উর্মী জিজ্ঞেস করল, কি রে কার সঙ্গে কথা বলছিল? হেমা কিছু বলল না, তবে তার মুখ দেখে বোঝা গেল সে শুভ্রর সঙ্গেই কথা বলছিল। হেমা বলল, উর্মী আমাদের নকশীকে দিয়ে শুভ্রর ভালবাসা পরীক্ষা করতে দেয়া ঠিক হয়নি। আমাদের বয়স হয়েছে কিন্তু কাজটা হয়েছে অত্যন্ত ইমমেচূর্ড-এর মতো। আসলে ভালবাসায় তৃতীয় পক্ষ থাকা ঠিক নয়। বেশিরভাগ সময় তৃতীয় পক্ষ নিজেই কোন পক্ষের স্থান দখল করে।

উর্মীর চোখ থেকে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সে চোখ মুছে রুদ্ধ কন্ঠে বলল, শুভ্ররই বা দোষ কিসের? ওতো অনেকদিন আমার জন্য অপেক্ষা করেছে, ওরা যদি পরষ্পরকে ভালবাসে, বিয়ে করে তবে তো ভাল শুভ্রকে বিয়ে করতে না পারি ইন্ডাইরেক্টলি ওর তো উপকারে আসলাম। চলবে...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।