আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাশুল না নিলে ট্রানজিটে লাভ নেই বাংলাদেশের

অস্থির

ভারতে ট্রানজিট দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে নির্ধারিত হারে মাশুল আদায় করতে হবে। মাশুল আদায় ছাড়াই ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে কোনো সুফল পাবে না বাংলাদেশ। ভেস্তে যাবে নিকট প্রতিবেশী দেশকে ট্রানজিট দিয়ে অসম বাণিজ্যবৈষম্য দূর করার প্রয়াস। বিশেষজ্ঞ ও কূটনীতিকেরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে অসম বাণিজ্যবৈষম্য দূর করতে হলে ট্রানজিট মাশুল আদায়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই। পাশাপাশি মাশুল ঠিক করার আগে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ, এর অর্থায়ন এবং বিনিয়োগকারী কারা হবেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ছাড়া ট্রানজিটের সুবিধা পেলে পণ্য পরিবহনে ভারতের যে সাশ্রয় হবে, তারও একটি অংশ বাংলাদেশের পাওয়া উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বণিক সমিতিগুলোর শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের ডব্লিউটিও-বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধান অনুযায়ী ট্রানজিটের জন্য মাশুল আদায়ের সুস্পষ্ট বিধান আছে। এতে বলা হয়েছে, রাজস্ব আদায় নয়, এক দেশের পণ্য অন্য দেশে প্রবেশের জন্য শুল্কসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে সেবা দেয়, তার জন্য ওই মাশুল আদায় করা হবে। তা ছাড়া বিশ্ব শুল্ক কর্তৃপক্ষের বিধানে ট্রানজিট মাশুল আদায়ের কথা বলা হয়েছে। ওই বিধান মেনেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো ট্রানজিট পরিচালনা করছে।

কাজেই ভারতের কাছে ট্রানজিট মাশুল আদায়ে বাংলাদেশের কোনো বাধা নেই। যোগাযোগ মন্ত্র্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আলাউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, দ্বিপক্ষীয় নৌ প্রটোকলের পাশাপাশি ডব্লিউটিওর বিধান মেনে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট মাশুল নির্ধারণের জন্য বিধিমালা তৈরি হচ্ছে। বিধিমালা তৈরির পর বিষয়টির সুরাহা হবে। ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ট্রানশিপমেন্ট ও ট্রানজিট মাশুল আদায়ের বিষয়ে একটি বিধিমালা জারি করলেও তা এখন স্থগিত রয়েছে। বিধিমালাটি জারির পর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভিন্নমতের কারণে ট্রানজিট ফি বা মাশুল আদায় নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

ভারত ট্রানজিট মাশুল প্রত্যাহার করতে সরকারকে চিঠি লেখে। ওই অনুরোধে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের নির্দেশে আপাতত মাশুলের পরিবর্তে ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে ভারতকে পণ্য ছাড় করতে হবে বলে এনবিআর সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল মঙ্গলবার বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য পরিবহনে ভারতের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে মাশুল নেওয়া হবে। এই মাশুল নির্ধারণের জন্য একটি বিধিমালা তৈরির কাজ চলছে। তিনি আরও বলেছেন, ট্রানজিটের ওপর কখনোই শুল্ক হতে পারে না।

ট্রানজিটের জন্য বরং মাশুলজাতীয় একটা অঙ্ক নেওয়া হয় এবং ভারতের কাছ থেকে সেটাই নেওয়া হবে। ট্রানজিট বনাম ট্রানশিপমেন্ট: ট্রানজিট হচ্ছে, ভারত কোনো পণ্য নিজেদের পরিবহনে এনে সেই একই পরিবহনের মাধ্যমে অন্য কোনো শুল্কবন্দর দিয়ে তাদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে নিয়ে যাওয়া। আর ট্রানশিপমেন্ট হচ্ছে, বাংলাদেশে পণ্য আনার পর তা খালাস করে বাংলাদেশের পরিবহনের মাধ্যমে অন্য কোনো শুল্কবন্দর দিয়ে তাদের রাজ্যে পাঠানো। অর্থমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, ট্রানশিপমেন্টে মাশুল নেওয়া হবে, ট্রানজিটে নেওয়া হবে না। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ট্রানজিটেই ভারতের লাভ বেশি।

কারণ এতে অন্য রাজ্যে পণ্য নিয়ে যেতে সাশ্রয় বেশি হবে। অন্যদিকে ট্রানশিপমেন্ট হলে বাংলাদেশকে পণ্য পরিবহনে মাশুল দিতে হবে। সুতরাং ট্রানজিট হলে ভারতের যে সাশ্রয় হবে, তার একটি অংশ বাংলাদেশকে দেওয়া উচিত। ফি আদায় স্থগিত: সম্প্রতি ভারতীয় দুটি জাহাজ নৌপথে ট্রানজিট নিতে চাইলে ফি আদায় নিয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিপত্তি বাধে। গত ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলের শেখবাড়িয়ায় গৌরীগঙ্গা ও কাবেরী নামে দুটি ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ আসে।

জাহাজ দুটিতে ৭৫০ মেট্রিক টন করে ফ্লাই অ্যাশ রয়েছে। বাংলাদেশের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্কায়নের প্রক্রিয়া শুরু করতে গেলেই ট্রানজিট ফি আদায় নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন গত ১০ অক্টোবর ট্রানজিট ফি ছাড়াই শুল্কায়নের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য এনবিআরের কাছে চিঠি দেয়। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টার বরাত দিয়ে ভারতীয় হাইকমিশন বলেছে, ট্রানজিট ফি প্রত্যাহারের বিষয়টি যেহেতু বিবেচনাধীন, তাই অন্তর্বর্তীকালে যেন ট্রানজিট ফি আদায় না করা হয়। ভারতের যুক্তি হচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে ১৯৭২ সালে সম্পাদিত নৌ ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রটোকল অনুযায়ী ট্রানজিট মাশুল আদায়ের বিধান নেই।

ওই প্রটোকল মেনেই তারা বাংলাদেশকে নদীর নাব্যতা রক্ষায় প্রতিবছর নির্ধারিত হারে টাকা দেয়। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলছেন, ১৯৭২ সালে যে প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও ভারত নৌ ট্রানজিট-বিষয়ক চুক্তিটি সই করেছে, এখনকার পরিস্থিতি একেবারে আলাদা। ওই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের শুধু নৌপথ ব্যবহার করবে ভারত। আর এখন বলা হচ্ছে, নৌপথে ভারতীয় পণ্য আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে সড়কপথে ত্রিপুরা নেওয়া হবে। এর মাধ্যমে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের প্রসঙ্গটি চলে আসে।

তা ছাড়া এর ফলে ভারত স্বল্পতম সময়ে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। তাই ট্রানজিট মাশুল আদায়ের ক্ষেত্রে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তা ছাড়া মাশুল আদায় না হলে বাণিজ্যবৈষম্য কমিয়ে আনার সুযোগটি বাংলাদেশ হারাবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে, ট্রানজিট মাশুল আদায় হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অসম বাণিজ্যবৈষম্য দূর হবে। সেই মাশুল আদায়ে ছাড় দেওয়া হলে ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশের সুফল পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

তা ছাড়া ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি অনুযায়ী, অন্যান্য মাশুলের পাশাপাশি নেপালের ট্রানজিট মাশুল দেওয়ার বিধান রয়েছে। অন্য এক কূটনীতিক বলেন, ট্রানজিট মাশুল আদায়ের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বের অন্য দেশের উদাহরণকেও বিবেচনায় আনা উচিত। এমন নজির আছে, দুই দেশের মধ্যে ট্রানজিট চুক্তি সইয়ের পর এক দেশ অন্য দেশকে ট্রানজিট মাশুল আদায়ে ছাড় দেয়। বিষয়টি বিবেচনায় আনলে ভারতকে ছাড় দেওয়ার আগে বাংলাদেশকে ভেবে দেখতে হবে, নেপাল ও ভুটানে ট্রানজিটের জন্য মাশুল আদায়ে ভারত ছাড় দিচ্ছে কি না। বিনিয়োগ সমন্বয়: ট্রানজিট-সুবিধা চালুর জন্য বাংলাদেশের স্থলবন্দরগুলোসহ যোগাযোগ খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সম্প্রতি সমীক্ষা করে বলেছে, ট্রানজিট থেকে লাভবান হতে হলে বাংলাদেশকে ১১৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশকে এই অর্থ বিনিয়োগ করতে হলে তা তুলেও আনতে হবে। আর এই বিনিয়োগের সঙ্গে সমন্বয় করে মাশুলের হার নির্ধারণ না করলে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারবে না। বিধিমালা তৈরি হচ্ছে: অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের আরও বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশের নদী ও রেলপথ ব্যবহারের জন্য মাশুল দেওয়ার বিধি থাকলেও সড়কপথের জন্য কোনো বিধি নেই। সড়কপথ ব্যবহার করতে হলে কী হারে মাশুল দিতে হবে, তার জন্য বিধিমালা তৈরি করা হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ একটি ট্রানজিট দেশ এবং আমরা ট্রানজিট দেব। আর যদি কেউ বাংলাদেশের অবকাঠামো ব্যবহার করে, তাহলে ব্যবহারকারী দেশকে অবশ্যই বাংলাদেশকে একটা কিছু দিতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের নৌপথ ব্যবহারের কারণে বছরে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার মতো ভারতের কাছ থেকে পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী। ট্রানজিটের বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, তারা আসলে বোকা। কারণ বাংলাদেশ ঐতিহাসিক ও ভৌগলিকভাবেই ট্রানজিট দেশ।

গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। লাভের হিসাব: ট্রানজিটের সুফল নিয়ে এডিবির সমীক্ষা অনুযায়ী, ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট চালুর প্রথম বছরেই আয় হবে না। শুরুতে প্রতিবছর ফি থেকে আয় হবে পাঁচ কোটি ডলার বা ৩৫০ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের মধ্যে যদি পণ্য পরিবহনের উপযুক্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়, তাহলে পরবর্তী বছরগুলোতে আয় হবে ৫০ কোটি ডলার বা তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদে এই আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১০০ কোটি ডলার বা প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা।

View this link Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.