আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তোমার মৃত্যু নেই যেমন মৃত্যু নেই বিপ্লবের

‘তুমি যাকে মৃত্যু বল, তুমি যাকে বল শেষ, সমূল পতন

এর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সের্না (স্পেনীয় ভাষায় Ernesto Guevara de la Serna) বা চে গুয়েভারা (Che Guevara) বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খ্যাতিমান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের অন্যতম। তার আসল নাম 'এর্নেস্তো গেভারা দে লা সেরনা'। জন্মসুত্রে তিনি আর্জেন্টিনার নাগরিক। আর্নেস্টো চে গুয়েভারা ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আর্নেস্টো গুয়েভারা লিঞ্চ এবং মায়ের নাম সিলিয়া দ্যা লা সেরনা।

চে’র বাবা ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চে ছিলেন সবার বড়। মাত্র দু’বছর বয়সে তিনি মারাত্মক এ্যাজমায় আক্রান্ত হন, যা তাকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভুগিয়েছে। চে গুয়েভারার পরিবার রোসারিও শহর থেকে বুয়েন্স আয়ার্সে চলে আসে। বুয়েন্স ওয়ার্স ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে তিনি ডাক্তারি পড়েন।

কিন্তু শিক্ষা শেষ করার আগেই ১৯৫২ সালে ২৯ ডিসেম্বর চব্বিশ বছর বয়সে চে তার বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদাসকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে বের হন। এ সময় তারা পেরু, চিলি, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। এসব দেশের মানুষের জীবন দেখে তিনি ব্যথিত হন। এভাবে সাত মাস ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরেন। ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে শল্যচিকিৎসা ও ত্বকবিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে চে গুয়েভারা ডাক্তারি পাস করেন।

যুবক বয়সে মেডিসিন বিষয়ে পড়ার সময় চে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। যা তাকে অসহায় মানুষের দুঃখ কষ্ট অনুধাবন করার সুযোগ এনে দেয়। চে বুঝতে পারেন ধনী গরিবের এই ব্যবধান ধ্বংস করে দেবার জন্য বিপ্লব ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তখন থেকেই তিনি মার্কসবাদ নিয়ে পড়ালেখা শুরু করেন এবং সচক্ষে এর বাস্তব প্রয়োগ দেখার জন্য গুয়াতেমালা ভ্রমন করেন। ১৯৫৩ সালে চে গুয়েভারা বলিভিয়ায় যান।

এরপর পেরু, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া, কোস্টারিকা হয়ে গুয়াতেমালায় পৌঁছেন ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। গুয়াতেমালায় তখন জাকাবো আরবেনজ সরকারকে উৎখাতের মার্কিন চক্রান্ত চলছিল। চে এ চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরবেনজ সরকারের পতন ঘটে। ফলে চে মেক্সিকোতে চলে যান।

গুয়াতেমালায় থাকার সময় তার সঙ্গে পেরুর বিপ্লবী হিল্দা গাদিয়ার বিয়ে হয়। ১৯৫৫ সালের মধ্যভাগে চে গুয়েভারার সঙ্গে পরিচয় হয় রাউল ক্যাস্ট্রোর। পরে ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে মারিয়া এন্টোনিয়ার বাড়িতে চে’র সঙ্গে পরিচয় হয় কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর। ফিদেল তখন ফুলজেনসিও বাতিস্তার স্বৈরশাসন থেকে কিউবাকে মুক্ত করার জন্য গেরিলা বাহিনী গঠনে ব্যস্ত। তিনি চে গুয়েভারাকে কিউবার বিপ্লবে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানান।

চে তার আহ্বানে সাড়া দেন। ১৯৫৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি চে গুয়েভারা ও হিল্দার কন্যা হিল্দিতা জন্মগ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালে মেক্সিকো থাকার সময় গুয়েভারা ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সগঠন ২৬শে জুলাই আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৫৭ সালের ২২ জানুয়ারি বিপ্লবীরা সরকারি সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটকে পরাজিত করে বিপ্লবের নবপর্যায়ের সূচনা করে। এরপর প্রতিনিয়ত যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করে।

১৯৫৮-এর আগস্ট মাসে বিপ্লবী বাহিনী চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি চে গুয়েভারার নেতৃত্বাধীন বাহিনী সরকারি বাহিনীকে পরাজিত করে সান্তক্লারা শহর দখল করে। ফলে স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটে। বাস্তিতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমেরিকা মহাদেশে প্রথম সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় কিউবায়।

১৯৫৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি চে’ গুয়েভারাকে কিউবার নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। ১৯৫৯ সালের ২ জুন চে আলেইদা মার্চকে বিয়ে করেন। চে কিউবায় রওনা হওয়ার পরই তার প্রথম স্ত্রী হিল্দা নিজ দেশ পেরুতে ফিরে যান। ১৯৫৯ সালে এই সগঠন কর্তৃক কিউবার ক্ষমতা দখলের পর তিনি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন নিবন্ধ ও বই রচনা করেন।

কিউবার বিপ্লবের সাফল্যের পর ৩১ বছর বয়স্ক চে গুয়েভারা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে চে যোগ দেন। ১১ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে চে বলেন, ‘আমরা চাই সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে। আমরা আমাদের নীতি হিসেবে ঘোষণা করেছি যে শান্তির লক্ষ্যে যারা কাজ করেছেন আমরা তাদের শরিক। আমরা নিজেদের মনে করি জোট নিরপেক্ষ গোষ্ঠীভুক্ত একটি দেশ হিসেবে।

যদিও আমরা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী, কিন্তু আমাদের মতোই জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে লড়াই করছে। আমরা শান্তি চাই। আমরা আমাদের জনগণের জন্য উন্নত জীবনমান গড়ে তুলতে চাই। আর চাই যতদূর সম্ভব ইয়াঙ্কিদের পরিকল্পিত প্ররোচনার উত্তর দেয়া এড়িয়ে যেতে। কিন্তু আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকদের মানসিকতাকে ভালভাবেই জানি।

তারা চায় এই শান্তির জন্য আমরা যাতে বড় ধরনের মূল্য দিতে বাধ্য হই। কিন্তু আমরা এর উত্তরে বলতে চাই, যে কোনো মূল্য কখনও সম্মানের চৌহদ্দির বাইরে যেতে পারে না। ’ । ১৯৬৫ সালের ১৪ মার্চ কঙ্গো, ঘানা, তানজানিয়া ও মিসর সফর শেষে কিউবায় ফেরেন চে গুয়েভারা। এরপর আর কোনদিন তাকে জনসম্মুখে দেখা যায়নি।

তিনি তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকা ও আফিন্সকায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করার। সম্মান, খ্যাতি, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি¬ সব ফেলে তিনি যাত্রা করলেন বিপ্লবের সুকঠিন পথে। তার লক্ষ্য ছিল বিশটি নতুন ভিয়েতনাম সৃষ্টি করা। ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর মার্কিন সমর্থনপুষ্ট বলিভীয় সেনাবাহিনীর হাতে আহত অবস্খায় বন্দি হন চে গুয়েভারা। পরদিন ৯ অক্টোবর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

মৃত্যুর আগ মুহূর্তে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পূর্বসময়ে আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি কি তার অমরত্বের কথা ভাবছেন? চে জবাব দেন ‘আমি ভাবছি, বিপ্লবের অমরত্বের কথা’। তার মৃতদেহ গুম করে ফেলা হয়। ১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর, বলিভিয়ার শহর লা হিগুয়েরাতে বলিভিয়ার সেনাবাহিনী তার মৃত্যদন্ড কার্যকর করে । চে গুয়েভারা এক অবিনাশী বিপ্লবীর নাম। বিশ্বের নিপীড়িত, শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেন।

মার্কসবাদী আদর্শের জন্য অপরিসীম আত্মত্যাগের কারণে চে নামটি ষাট ও সত্তরের দশকে ল্যাটিন আমেরিকা, আফিন্সকা ও এশিয়া তথা সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে বিপ্লবের সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল। তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন, বিপ্লবীর মৃত্যু আছে, কিন্তু বিপ্লবের মৃত্যু নেই। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদের মূর্ত প্রতীক। কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনের পাশে নিজের স্খান করে নিয়েছেন তিনি। সন্দেহ নেই, বিপ্লবের ব্যাপারে অবিচল পুরুষ ছিলেন আর্নেস্তো চে গুয়েভারা।

কিন্তু তার যে বিপ্লব, যে আদর্শ, যে চেতনা- একে লালন করার সামর্থ এবং অধিকার সমকালীন পৃথিবীবাসীর নেই। তার আদর্শের অবিচলতা ও গতিময়তা এতোটাই সুগভীর এবং সুউচ্চ যে, স্বপ্নের মতো করেই কেবল একে জিইয়ে রাখা যায়। চে বেঁচে আছেন ক্রেজ হয়ে, তারুণ্যের টি-শার্টে। যে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছন সেই সাম্রাজ্যবাদ ও তাকে পুঁজির উপকরন হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে এবং তাকে বিপ্লবী থেকে ব্রান্ডে এবং সেলিব্রেটিতে পরিণত করেছে। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার বারিয়েনতোস সরকার ভেবেছিল, চে গুয়েভারাকে হত্যা করলেই বিপ্লব শেষ হয়ে যাবে।

কিন্তু মৃত্যুর পরও তাঁর জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে জীবিত চে গুয়েভারার চেয়ে মৃত চে গুয়েভারা অনেক বেশি শক্তিশালী। তাঁর আদর্শের মৃত্যু নেই। তাই, আজও মানবমুক্তির প্রতিটি সংগ্রামে চে গুয়েভারা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এই প্রবাদপুরুষ চে গুয়েভারা ছবি তুলতে চাইতেন না। অথচ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ছাপা হওয়া ছবির অন্যতম চের প্রতিকৃতি, দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ হিসেবে বিবেচিত।

আজ লক্ষ প্রাণের আওয়াজ উঠেছে, চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়, তোমার মৃত্যু নেই যেমন মৃত্যু নেই বিপ্লবের । জীবন কে অমর করে নেয়া চে জেগে রবে চিরকাল অমর প্রাণ হয়ে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।