আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের মণিপুরি সমাজ: তাদের আদিধর্ম ও ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি

প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি

বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের থেকে মণিপুরিদের জাতিগত সংকট ও বিপর্যয়ের চেহারাটা কিছুটা ভিন্ন। মণিপুরিরা বাস করে সমতলে- বৃহত্তর সিলেট, মৌলবীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের নানান অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তারা এসেছে মণিপুর নামের একটি প্রাগৈতিহাসিক ভূখন্ড থেকে, যে ভূখন্ডটি ১৮৯১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বৃটিশরা দখল করে নেয় এবং পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। ঐ ঘটনার দু্‌ইশ বছর আগেই হাজার হাজার মণিপুরি নিজ মাতৃভুমি ছেড়ে তৎকালিন বৃটিশ ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং শ্রীহট্ট জেলার (বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট) নানান অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন মণিপুরি রাস্ট্রনায়কদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিবেশী বার্মার সাথে যুদ্ধজনিত কারণে। ধর্মান্তরকরন প্রক্রিয়া ও ধর্মপ্রচারকদের চাতূর্য্য মণিপুর রাষ্ট্রে একটি পূর্ণ বিকশিত জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছিল মণিপুরিরা।

দুই হাজার বছরেরও আগে থেকে নিজস্ব ভৌগলিক সীমানার মধ্যে রাজ্য, রাজধানী, মুদ্রাব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা, সৈন্য, আইন ও বিচারব্যবস্থা, সামাজিক ব্যবস্থা, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, বর্ণমালা, লিখিত ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে মণিপুরি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ষোড়শ শতকের দিকে ভারতীয় ধর্মপ্রচারকেরা মণিপুরে তাদের ধর্মমত প্রচার শুরু করে এবং তারা ঐ ভূখন্ডটিকে মহাভারতে বর্ণিত মণিপুর রাজ্য বলে দাবী করে। রাজনৈতিক সুবিধা, ক্ষমতার লোভ ও ব্যক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিস্ট কারণে তারা তৎকালীন শাসকগোষ্ঠির বিপুল সমর্থন লাভ করে। এরপর অস্টাদশ শতকের দিকে শাসকগোষ্ঠি নিজেদের আদিধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহন করে এবং গোটা রাজ্যকে বৈষ্ণবরাজ্য হিসাবে ঘোষনা করে। নতুন ধর্মের সংষ্পর্শে মণিপুরিদের চিন্তা-চেতনায়, সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও সামাজিক জীবনে বিপুল পরিবর্তন ঘটে।

সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মটির ভাবনা ও দর্শনের সাথে প্রাচীন বিশ্বাসের অনেকাংশে মিল থাকায় সাধারন মানুষের কাছে নতুন ধর্মটি গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠে। আদিধর্মের নিদর্শন নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা তবে মণিপুরি আদিধর্মের একান্ত অনুসারিদের জন্য সে সময়টি ছিল ক্রান্তিকাল। ঐ সময় রাস্ট্রের উদ্যোগে প্রাচীন ধর্মের যাবতীয় গ্রন্থ, পুরাণ ও ঐতিহাসিক দলিলপত্র সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। রাস্ট্রীয়ভাবে প্রাচীন ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেয়া হয়। প্রাচীন ধর্মের যাবতীয় চিন্তা, দর্শন ও দেবদেবীর ধারনাকে হিন্দুধর্মে আত্মীকরন করা হয় এবং প্রাচীন মণিপুরি সংস্কৃতি ও শিল্পকলার সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির সমন্বয় সাধন করা হয়।

বর্ণাশ্রমভিত্তিক হিন্দুধর্মে অন্যদের অনুপ্রবেশের কোন ব্যবস্থা না থাকায় বিকল্প ব্যবস্থা হলো গোটা একটি জাতিকে 'ট্রাইবকাস্ট' হিসাবে আত্মস্থ করে নেয়া। এ ব্যবস্থায় মণিপুরিদেরকে মহাভারতে বর্ণিত অর্জ্জুনের বংশধর অভিধা দিয়ে ক্ষত্রিয় বর্ণশ্রেনীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। জানা যায় ধর্মান্তর করনের সময় মণিপুরি রাজাদের মস্তকমুন্ডন করিয়ে ভারতীয় সাধুদের "খোমজুং" বা চরণামৃত (পা ধৌত করা পানি) সেবন করিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করানো হয়। শিক্ষিতশ্রেণীর বর্ণহিন্দু হয়ে উঠার মরিয়া প্রচেষ্টা বৈষ্ণব ধর্ম দর্শনের সাথে পরিচয়ের ঘটনাটি খুব বেশীদিন আগের না হলেও পরবর্তী সময়ে মণিপুরিদের, বিশেষ করে মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়াদের বর্ণহিন্দু শ্রেণীতে অন্তর্ভূক্ত হবার প্রানান্তক প্রচেস্টা লক্ষ করার মতো। এই এর মুল কারণটি বোধকরি একের পর এক রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে হিন্দুধর্মের নিকট এই আত্মসমর্পন।

বিংশ শতকের প্রথম দিকে মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়াদের মধ্যে যে শিক্ষিত শ্রেণীর উদ্ভব হয় তারা প্রধান লক্ষ্যই ছিল মহাভারতের অর্জ্জুন ও চিত্রাঙ্গদার সাথে নিজেদের যুক্ত করা এবং ক্ষত্রিয় বর্ণহিন্দু হিসাবে নিজেদের জাহির করা। তারা ঐ সময়কার বৃটিশ ভারতীয় সেন্সাসে মণিপুরিদের ট্রাইব কাস্টে অন্তর্ভূক্ত করার প্রতিবাদ করে এবং নিজেদেরকে হিন্দু ক্ষত্রিয় হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করার দাবী জানায়। কিন্তু এরপর দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়েছে, সেই চিন্তার তেমন হেরফের হয়নি। এখনো মহাভারতের সেই ঘোড়ার পেছনে ছুটাছুটি অব্যাহত রয়েছে। আমাদের ইতিহাসবিদ গবেষকেরা এখনো মরিয়া নিজেদের সমস্ত কিছু বৈদিক হিন্দুধর্ম এবং মহাভারতের আলোকে ব্যাখ্যা করতে।

ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি, বিপন্ন ভাষা ও অস্তিত্ব একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বৈষ্ণব ধর্ম তাদেরকে আধুনিক শিক্ষা ও সভ্যতার সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছে, নিজেদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ব্যাপক ভুমিকা রেখেছে। কিন্তু এর ফলে নিজেদের ঐতিহ্যময় এবং বিশেষ বৈশিস্ঠ্যপুর্ণ সংস্কৃতি কৃষ্টি হারানোর প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়েছে। নব্য হিন্দু পরিচিতির সাথে সাথে আমাদের চিন্তা-মনন, আচার আচরনে পরিবর্তন ঘটতে থাকে, আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব গড়ে উঠতে থাকে, মন ক্রমান্বয়ে সংকীর্ন থেকে সংকীর্ণতর হয়ে উঠতে থাকে। তরুনদের একটি বড় অংশের মধ্যে নিজ ঐতিহ্যের প্রতি বিপক্ষভাব তৈরী হতে থাকে। শিক্ষিতশ্রেনীর ঘরে ঠাঁই নিচ্ছে মাতৃভাষার বদলে বাংলা।

এমনিতেই সমতলের ভৌগোলিক ও সামাজিক বাস্তবতার সূত্রে আমাদের মাতৃভাষাও রয়েছে চরম সংকটের মুখে। সেইসব নৃত্য গীত কলা শিল্পে সঞ্চালক হওয়ার প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে না, সে প্রক্রিয়াটাই প্রায় অচল। শিক্ষিত শ্রেনীর মধ্যে আগের ক্ষত্রিয় বর্ণহিন্দু হবার যুক্তিহীন আত্মগর্বের সাথে এখন যুক্ত হয় 'বাঙালি বাবু' হবার ঐকান্তিক প্রচেস্টা। ফলে বিষূ, কাঙ, কার্ত্তিকা, রাসপূর্ণিমার মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় উৎসবগুলোর স্থান দখল করে নিয়েছে দুর্গাপূজাসহ নানান হিন্দুয়ানি পূজা-পার্বন। সেই সাম্যের ধর্ম-শিল্প-সংস্কৃতি-যূথ বৈচিত্র্যপূর্ণ সামাজিক কাঠামো অনেক আগেই ভেঙে গেছে।

তার বদলে স্থান করছে হিন্দুবাদী ধর্মীয় চেতনা। এর সাথে অবশ্যই জড়িত রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি ও সংকীর্ণতা। রাষ্ট্র এসব জাতিসত্তার ভেতরের এ সমস্যা ও সংকট নিয়ে কখনোই চিন্তিত নয়। বরং দেখা যায়, মণিপুরিদের মৈতৈ-বিষ্ণুপ্রিয়া দুটি অন্তর্বিভাগের মধ্যে অহেতুক বিবাদকে নানান কৌশলে উস্কে দিয়ে ফায়দা আদায় করে। আর রাস্ট্র নিজেই যখন ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদকে উৎসাহিত করে, তখন তার সাথে সবাইকেই পাল্লা দিতে হয় বৈকি।

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার দাঁতাল শুয়োরের আলিঙ্গনে কোন পুর্ণ বিকশিত জাতি কি করুণভাবে পরগাছার মতো নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি ধর্মসম্প্রদায়ে পরিণত হতে পারে, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিরা তার প্রকৃস্ট উদাহরন। একজন মণিপুরি হিসাবে 'খোংজুম' বা পা-ধুয়া পানি সেবনের ঘটনাটি যতো না মর্মযাতনাময়, এ ব্যাপারটি তার থেকেও বেশী পীড়াদায়ক। মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়াদের ধর্মাচরনে আদিধর্মের প্রভাব এবং সংস্কৃতির লৌকিক উপাদানগুলো নিয়ে বৃহৎ পরিসরে কোন গবেষণা হয়নি বললেই চলে। একমাত্র ভাষাবিদ ও গবেষক ড. কালিপ্রসাদ সিংহ তার কিছু লেখায় বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবী, প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র, রহস্যবিদ্যা , প্রাকৃতিক তত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু আলোচনা করেছেন। এর আগে প্রায় চল্লিশ বছর আগে শিলচর থেকে প্রকাশিত 'পাঞ্চজন্য অর্জ্জুনি' নামক পত্রিকায় আপোকপা ধর্ম সংক্রান্ত একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল।

গত দশ বছর ধরে নিজস্ব তাগিদ থেকে করা পঠনপাঠন, গবেষনা ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়াদের মধ্যে আদিধর্মের প্রভাব, মিথলজির বিভিন্ন দেবদেবী ও তাদের উপাসনাপদ্ধতি, মণিপুরি ধর্মদর্শনের বিভিন্ন দিক এবং অন্যান্য ভারতীয় ধর্মদর্শনের সাথে তুলনা, বিভিন্ন লৌকিক বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয় এই লেখায় আলোকপাত করার চেস্টা করেছি। পরবর্তী পর্ব: মণিপুরি ধর্মের উৎস ও বিবর্তন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.