আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেশব রায়

শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই সাফল্যকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ কেশব রায়। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য সম্প্রতি জাতিসংঘের 'ইয়ুথ কারেজ অ্যাওয়ার্ড ফর এডুকেশন'-ভূষিত হয়েছেন নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বিন্যাকুড়ী গ্রামের কেশব রায়। প্রত্যন্ত গ্রামের অভাবী এই কিশোর নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এলাকার ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদেরও করেছেন স্কুলমুখী। জলঢাকার শিশু ফোরামের সভাপতি কেশব রায় এলাকায় সফল শিশু সংগঠক হিসেবে পরিচিত। ২০০৮ সাল থেকে তিনি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, সার্বিক স্যানিটেশন, গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছেন।

২০১২ সালে শ্রীলঙ্কা এবং চলতি বছর থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত শিশু সমাবেশে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এ ছাড়া তিনি অবদান রেখেছেন বাল্যবিবাহ বন্ধে।

মাত্র ১৮ বছর বয়সেই কলেজে লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক কাজ করে আসছেন। অভিনয়, গান ও নাটকের মাধ্যমে তিনি মানুষকে সচেতন করার কাজটি করে আসছেন কয়েক বছর ধরে। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন জাতিসংঘের 'ইয়ুথ কারেজ অ্যাওয়ার্ড ফর এডুকেশন'।

গত ১২ জুলাই নিউইয়র্কে জাতিসংঘ ভবনে মালালা দিবসে বিশেষ কর্মসূচিতে তার এ পুরস্কার জাতিসংঘের শিক্ষাবিষয়ক দূত ও সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন তুলে দেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ইউএসএ প্রতিনিধির হাতে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। ওইদিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দফতরে মালালার পাশাপাশি সম্মানিত করা হয় বিশ্বের নানা প্রান্তের আরও সাত শিশুকে। এই সাত শিশুর মধ্যে বাংলাদেশি কেশব রায় স্থান করে নিয়েছেন। সম্মাননা পাওয়া অন্য ছয় শিশুর মধ্যে ভারতের দুজন এবং নেপাল, পাকিস্তান, মরক্কো ও সিয়েরালিয়নের একজন করে রয়েছেন।

কেশবের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার কৈমারী ইউনিয়নের বিন্যাকুড়ী গ্রামে। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। তারা দুজনই এখন শিক্ষার্থী। ছোট ভাই রঞ্জিত চন্দ্র রায় জলঢাকা বিএম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। দিনমজুরি এবং নিজের ভিটেসহ এক বিঘার মতো যে জমি আছে সেটুকুই তিনি চাষাবাদ করেন।

সেখান থেকে জোগান দেন দুই সন্তানের পড়ার খরচ। মা গৃহিণী রঞ্জিতা রানী রায়। টাকা-পয়সার অভাবে দু-একবার কেশবের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য তিনি অন্যত্র কাজ নেন। সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার পর কেশবের বাবার পক্ষে লেখাপড়ার খরচ বহন করা অসম্ভব হয়ে ওঠে।

সে সময় কেশব লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে তার স্কুলের পাশে একটি ভাঙাড়ি দোকানে কাজ নেন। এতে তার মাসে আসে ৩০০ টাকা। কিন্তু কেশব পড়াশোনা ছেড়ে মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েন। তার মন পড়ে থাকে স্কুলে। তার দোকানের পাশ দিয়ে যখন অন্য শিক্ষার্থীরা স্কুলে যায় তখন তিনি আনমনা হয়ে পড়েন।

ওই দোকানের কাজে তিনি আর মন বসাতে পারেন না। কাজ ঠিকমতো না করায় একবার তার কিছু বেতনও কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আর লেখাপড়া ছেড়ে বেশি দিন থাকতে পারেননি। আবার টাকা জোগাড় করে স্কুলে ভর্তি হন। এ জন্য তিনি মাঝেমধ্যে প্রাইভেটও পড়াতেন।

আরও একবার স্বল্পসময়ের জন্য তার লেখাপড়ায় ছেদ পড়েছিল। এভাবেই অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর কেশব এখন স্কুল গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা দিয়েছেন। তার ইচ্ছা লেখাপড়া শিখে মানবসমাজ উন্নয়নে কাজ করবেন। তার মতে, একজন মানুষকে সচেতন করতে পারলে আর তার অভাব থাকবে না। তার মতো করে সে তার সমস্যা সমাধান করে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে।

কেশব একে একে বেশ কয়েকজনের বাসায় গিয়ে ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলে ভর্তি করেন। বাড়ির পাশে রিকশাভ্যান চালক বাগান চন্দ্রের ছেলে প্রদেশ চন্দ্র ও দিনমজুর সুরিশ চন্দ্র রায়ের ছেলে বিধান চন্দ্র রায়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ওই দুই ছাত্রের বাবা ও মাকে বুঝিয়ে পুনরায় স্কুলে ভর্তি করেন। তারা এখন একটি উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। প্রদেশ চন্দ্র এখন নবম ও বিধান চন্দ্র রায় ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র।

একইভাবে কেশব লেখাপড়ার ফাঁকে শিশু ফোরামের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ওই এলাকার এখন পর্যন্ত ২৫ শিশুর বাল্যবিবাহ বন্ধসহ অর্ধশত ঝরেপড়া শিশুকে স্কুলমুখী করে তুলেছেন।

স্থানীয় সমস্যাভিত্তিক নাটক লিখে তা মঞ্চায়ন করছেন তিনি। উদ্দেশ্য, মানুষকে সচেতন করা। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও ঝরেপড়া রোধের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার, জন্মনিবন্ধন, গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা, গর্ভকালীন চেকআপ ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসবকরণে।

সমাজ সচেতনতায় সাহসী ভূমিকা রাখা এবং নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করতে অভিজ্ঞতা আদান-প্রদানের উদ্দেশে এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন কেশব। তার গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে, নিজ এলাকায় বাল্যবিবাহ বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলগামী করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায়।

কেশবকে অনেকে উল্লেখ করেছেন 'বিশ্বের যুবসমাজের নেতা' ও 'রোল মডেল' হিসেবে। অথচ তার এগিয়ে আসার পথ সুগম ছিল না। প্রতিকূলতার মধ্যে লেখাপড়ার পাশাপাশি কেশব নিজেকে জড়িয়ে নেন সমাজসেবামূলক কাজে।

লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হয়ে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন নিজেকে। শিশু অধিকার, বাল্যবিবাহ, ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলে ফেরানো, স্যানিটেশন, যৌতুকসহ নানা বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির কাজে তিনি অনন্য। কেশবের এমন কর্মতৎপরতা নজর কাড়ে সবার। উপজেলার কৈমারী ইউনিয়নে কেশব চন্দ্র রায়ের গ্রামভিত্তিক ১০টি দল আছে। এলাকার শিশু-কিশোররাই এর সক্রিয় সদস্য।

বাল্যবিবাহের খবর পেলেই তারা ছুটে যান বিয়ে বন্ধ করতে। সামাজিক কাজ করতে গিয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। কাজ করতে গিয়ে কেশব বুঝতে পারেন, সামাজিক ব্যাধি দূর করতে হলে সবার আগে গ্রামের মানুষকে সচেতন করতে হবে। কাজটি করতে সমর্থ হয়েছেন তিনি।

যুবসমাজের নেতা ও রোল মডেল হিসেবে তার আন্তর্জাতিক সম্মাননা বাংলাদেশের জন্য বিরল গৌরব বয়ে এনেছে।

বহু তরুণ-তরুণীদের স্বপ্ন দেখানো শিখিয়ে চলা এই তরুণ নিজেকেই যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। তার পথচলায় এখন সঙ্গীদের বাড়ানো হাতে হাত রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মন্ত্রই যেন পড়ছেন সবাই। তার এগিয়ে যাওয়া অনুপ্রাণিত করছে অনেককে। বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে এগিয়ে যাওয়ার সব রকম পথেই হেঁটেছেন কেশব রায়। *আবদুল বারী, নীলফামারী

 

 



সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.