আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপকর্মে মহাজোট এমপিদের মহাজট

কবি হওয়ার ভান করি, উদাস হই; ভালোবাসার মাহাত্ব খূঁজি

রাশেদুল হাসান মহাজোট সরকার যে আশা ও আকাঙ্খা নিয়ে সরকার গঠন করেছে তা ভেস্তে যাওয়ার পথে। সরকার গঠনের পর থেকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের লাগামহীন কর্মকান্ডে সরকার এবং সরকার দলের নীতিনির্ধারকরা বেশ বিব্রত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে অতিষ্ট হয়ে উপদেষ্টার পথ থেকে সরে যান। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ তো বলেই ফেললেন- ‘ছাত্রলীগের কর্মকান্ডের দায়ভার আ’লীগ নেবে না’। প্রেসিডিয়াম সদস্যরাও একাধিকবার এমন উক্তি নির্গত করেছেন অঙ্গসংগঠনের অপকর্মের কারণে।

কিন্তু এ দায়ভার নেবে কে? ছাত্রলীগ-যুবলীগ বা অন্য অঙ্গসংগঠনের বেপরোয়া কর্মকান্ড, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অনিয়ম, দুর্নীতি, দখল, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে মারধর, ভূমি দখল, প্রশাসনের লোকদের উপর অত্যাচারের দায়ভার তাহলে কে নেবে? আর অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত না করে, তাদের আইনের হাতে সোপর্দ না করে দায়ভার নেয়া না নেয়ার কীত্তনইবা কেন শুরু হলো? আপনি ছেলে হিসেবে স্বীকার করবেন। ছেলের কামাই রোজগার ও দু’হাতে নেবেন। ভালো কামাই রোজগারের আশাও করবেন। কিন্তু ছেলের দুর্নীতির দায়ভার নেবেন না! সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দায়ভার নেবেন না! কেমন পিতা আপনি। পিতার দায়ভার না নেয়াটা ভনিতা।

ছেলে বা নিজেকে বাঁচানোর একটা কৌশল। আশরাফুলদের দায়ভার না নেওয়াটাও কি ভনিতা নয়? এটাও যে কুল ও শ্যাম রাখার কৌশল বুঝতে বাকি থাকে না। শেষমেষ এ দায়ভারটাই কুল ও শ্যাম রাখার শব্দগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে নানা সহিংস কর্মকান্ডে জনগণের সেন্টিমেন্ট উল্টিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। জনগণ মনে করে সরকার এসব সমর্থন করে না অর্থাৎ কুল রক্ষা হল।

এবার শ্যাম। এ শব্দটি সমস্ত ঘটনা চাপা দেয়। মেনে নেয়া না নেয়ার তর্কের তলানীতে প্রকৃত ঘটনা অদৃশ্য, অবোধ্য ঠেকে। সরকার কোন ব্যবস্থা নেয় না। অপরাধীরা থেকে গেল ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

আর এ শ্যামরাই নব উদ্যোমে কুল রক্ষায় উন্মাদ হয়ে যায়। সরকারের ভেতরে বাইরে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। উপদেষ্টাদের অসংলগ্ন কথা-বার্তা, মন্ত্রীদের সমন্বয়হীনতা ও বিতর্কিত কর্মকান্ড, দলীয় নেতা-কর্মীদের উশৃঙ্খল আচরণ সেই অশান্তির আগুনকে বাডিয়ে তুললেও এমপিদের কর্মকান্ডের স্ব-আগুনে পুড়ে কয়লার পথে সরকার। স¤প্রতি অপকর্মে অভিযুক্ত ১’শ এমপির তালিকা প্রধানমন্ত্রীর হস্তগত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে অভিযুক্তদের সতর্ক করে দিয়েছেন।

অপকর্মে জড়িতদের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘এরপর আর কোন অভিযোগ এলে সাথে সাথে তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে না পারলে সে যত শক্তিশালী হোক তাকে ছেড়ে দেয়া হবে না। ’ কিন্তু যারা অভিযুক্ত হলো তাদের ব্যপারে সুনির্দিষ্ট কোন কথা নেই। যারা খুন করল, চাঁদাবাজি করল, টেন্ডারবাজী করল, সন্ত্রাসবাজীতে সহায়তা করল, ভূমি দখলের মহোৎসবে যারা উন্মত্ত হলো, নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজন-প্রীতিতে তীব্র প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হলো তাদের সাত খুনই মাফ হয়ে গেল আদুরে নেত্রীর কাছে! ভাবখানা এমন যেন মা অন্যায় করার পর অতি আদরের সন্তানকে ধমকের সুরে বলছে, খোকা আর দুষ্টুমি করো না, এবার কিন্তু পিটাব। খোকার এ দুষ্টুমিতে কত মায়ের বুক খালি হলো, কত মেয়ের সম্ভ্রম লাগে খোকার এ দুষ্টুমিতে, কত রক্ত, কত লাশ, কত অর্থ-সম্পদ লাগে কেউ দেখার প্রয়োজনবোধ করে না।

এমপিদের কু-কীর্তির যে তালিকা প্রধানমন্ত্রীর হাতে পৌঁছেছে সে তালিকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন নতুন নাম সংযুক্ত হচ্ছে এ তালিকায়। বিগত আঠার মাসের বিতর্কিত কর্মকান্ড ও সহযোগী সংবাদ মাধ্যমের সহযোগিতায় এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট মতে আ’লীগের যে সব সাংসদদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের একটু পরিচয় করিয়ে দিইÑ কক্সবাজারের আবদুর রহমান বদি, মাগুরার ডা. এসএম আকবর, নেত্রকোনার রেবেকা মমিন, মঞ্জুর কাদের কোরাইশী, নারায়নগঞ্জের সারাহ বেগম কবরী, পটুয়াখালীর গোলাম মাওলা রনি, ভোলার নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, বরগুনার ধীরেন্দ্রনাথ শম্ভু, চট্টগ্রামের এমএ লতিফ, গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল, গাইবান্ধার মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, মাহবুবা আক্তার গিনি, রংপুরের আবুল কালাম আজাদ, মুন্সিগঞ্জের ইদ্রিছ আলী, ঢাকার সানজিদা খানম, কামাল আহমেদ মজুমদার, মিজানুর রহমান খান, হাবিবুর রহমান মোল া, আসলামুল হক আসলাম, ইলিযাছ মোল া, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, মানিকগঞ্জের জাহিদ মালেক স্বপন, ময়মনসিংহের গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, যশোরের শেখ আফিল উদ্দিন, মোস্তফা মোহাম্মদ ফারুক, আবদুল ওহাব, খান টিপু সুলতান, কিশোরগঞ্জের আফজাল হোসেন, টাঙ্গাইলের আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, পাবনার অ্যাডভোকেট শামছুল হক টুকু, গোলাম ফারুক প্রিন্স, শামসুর রহমান শরিফ ভিলু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লুৎফুল হাই সাচ্চু, পিরোজপুরের অধ্যক্ষ শাহ আলম, চুয়াডাঙ্গার সোলেয়মান জোয়াদ্দার, নাটোরের জুনায়েদ আহমেদ পলক, নওগাঁর ইস্রাফিল আলম, আকরাম হোসেন চৌধুরী, রাজশাহীর রহমত আলী, নরসিংদীর রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, মহাজোট শরিক পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের হাসানুল হক ইনু’র বিরুদ্ধে প্রশাসনের লোক ও শিক্ষক লাঞ্ছিত করা, উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে দ্বন্ধ, হত্যাকান্ড, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে লাঞ্ছিত করা, মজুতদারী, দখল, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, সাংবাদিক নির্যাতনসহ নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। এ ছাড়াও সাংসদরা নিয়োগ-বদলী-পদোন্নতি, টিআর, কাবিখা, কাবিটা বন্টনে দুর্নীতি, স্পেশাল ক্যাডার বাহিনী গঠন, ভূমি দখল, বালু মহাল নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। মিথ্যা হলফনামায় রাজউকের প ট নিয়েছে ডজন খানেক সাংসদ।

গাজীপুরের অ্যাডভোকেট রহমত আলী, মিরপুরের ইলিয়াছ মোল া, নরসিংদির জহিরুল হক মোহন, বরিশালের পারভীন তালুকদার, টাঙ্গাইলের একাব্বর হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জিকরুল আহমেদ, ভোলার আবদুল াহ আল জ্যাকব, জামালপুরের মুরাদ হোসেন, ঢাকার আসলামুল হক আসলাম, নেত্রকোনার মঞ্জুর কাদের কোরাইশী, রাজশাহীর আবদুল ওয়াদুদ, নীলফামারীর কাজী ফারুক কাদের ও তহুরা আলী এছাড়াও সংরক্ষিত আসনের অধ্যাপিকা অপু উকিল ও নাজমা আক্তার শীর্ষ তদবীরবাজ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সরকার দলীয় সাংসদদের অধিকাংশই যেখানে অপরাধের সাথে জড়িত তাদের অপরাধের জন্য যেখানে সরকার বিব্রত ও বিপদের মুখে পড়তে হচ্ছে। জনগণ অস্থির ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সর্বক্ষেত্রে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে সেখানে সরকার এমপিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে সতর্কবাণী দিচ্ছেন! আশরাফুল ইসলামের দায়ভার এবং প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ একই সূত্রে গাঁথা। এবার কয়েকটা মৌলিক প্রশ্নে আসা যাক।

প্রথমত ঃ ছাত্রলীগ-যুবলীগের বেপরোয়া কর্মকান্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কে? দ্বিতীয়ত ঃ ক্ষমা প্রদর্শন বা দেখেও না দেখার ভান করে অপরাধ বাড়ল না কমল ? এসব দেখার কি আ’লীগ নীতি নির্ধারকদের মাঝে কেউ নেই? আ’লীগ সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের দায়ভার এড়ানো ও প্রধানমন্ত্রীর আদুরে ধমক কেমন কার্যকর হলো তার নজির পেশ করলাম এমআরটি’র প্রতিবেদনের মাধ্যমে। সংগঠনটি গত জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের সামগ্রীক চিত্র তুলে ধরেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয় এ ৯ মাসে মোট খুন হয় ২ হাজার ৩’শ ১১ জন। এর মধ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষে ১’শ ৬৭ জন, আহত ১১ হাজার ৯’শ ২৮ জন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মৃত্যু ১’শ ২৩ জন, ধর্ষণের শিকার ৪’শ ১২ জন, সাংবাদিক নিহত ৩ জন, আহত ১’শ ৩৩ জন।

চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ১ হাজার ৩’শ ৯৩ টি, নিহত ১’শ ২৯ জন। আর এসব ঘটনায় আহত হয়েছে ১ হাজার ৩’শ ৫৯ জন। এমআরটি’র সূত্র মতে প্রতিদিন গড়ে ৯ জন নিহত ও ৪৪ জন আহত হয়েছে। শুধুমাত্র বিগত পাঁচ মাসের আত্মহত্যা করে ২’শ ৩৮ জন। এদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্ট বখাটেদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে এ পথ বেছে নেয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

তাহলে এ ছাড় কাদের জন্য? আর নিজ দলীয় নেতা-কর্মীদের-সাংসদদের অন্যায়ের ছাড়ের মাধ্যমে আরেকটি মানুষ, পরিবার যে নিঃস্ব হলো এ খবর কি সরকারের নীতি নির্ধারকরা রাখেন? এখানে কি নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হয় না? হয় না মানবাধিকার লঙ্ঘণ ? আ’লীগের নেতা-কর্মীদের এবং নির্বাচিত সাংসদদের কর্মকান্ডে বাংলার আনাচে-কানাচে প্রচলিত কথাটাকে আরো সত্য প্রমাণিত করেÑ‘ঘিয়ে ভেজে নিমের পাত; যায়কি তবু নিমের জাত’ অথবা, ‘কুকুরের লেজ বার বছর চুঙ্গায় পুরে রাখলেও সোজা হয় না’। কারণ মহাজোট মনোনীত প্রথমবারের মত সাংসদ নির্বাচিত হন ১’শ ২৮ জন নেতার অধিকাংশই এমপি হওয়ার আগে এবং ছাত্র অবস্থায়ও নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল। হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী এরা অতীতেও রেকর্ড ছাড়িয়েছিল এখনো করছে। এখনি লাগাম টেনে না ধরলে অপরাধ প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রকৃত অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরী হয়ে পড়েছে।

কারণ, আমরা জানি যেমন, একটি মিথ্যা সহস্র মিথ্যার জন্ম দেয়, ঠিক তেমনি একটি অপরাধও সহস্র অপরাধের জন্ম দেয়। রাশেদুল হাসান কবি ও প্রাবন্ধিক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।