আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দাগ-১৫ (এই দাগ হৃদয়ের, এই দাগ সমাজের)



হাসপাতালের বেড এ অনেকক্ষণ মনে করার পর মায়ার ধীরে ধীরে কিছু কিছু কথা মনে পড়ছিল। তার জ্ঞান ফিরার কথা শুনে তার বাবা হাসপাতালের বারান্দা থেকে ছুটে এসেছিলেন, মা এখন ভাল লাগছে? মায়া কোন কথা বলেনি, তার বাবা’র দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। মোস্তাফিজ সাহেব বলেছিলেন, একটু কথা বল্ মা। মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে মনে করার চেষ্টা করেছিল। ধীরে ধীরে তার সব কথা মনে পড়েছিল।

সে চিৎকার করে বলেছিল, আমি বাঁচতে চাইনি, আমি মরতে চেয়েছিলাম, আমাকে হাসপাতালে এনেছে কে? আমি এনেছি মা। কেন? আমি বেঁচে থাকতে তো একবারও ভালভাবে বাঁচার সুযোগ দাওনি, মরে যাবার সময় আমাকে ফিরিয়ে আনলে কেন? আমি মরে গেলে তো তুমি বেঁচে যাও। তুমি মিথিলার কাছে চলে যাও। এভাবে পাগলামি করিস্ না মা, মানুষ খারাপ বলবে। সব ঠিক হয়ে যাবে, রাসেল, ওর বোন, ওর মা সবাই এখন জেল হাজতে।

কেন জেল হাজতে কেন? ওদের কি দোষ? কি দোষ মানে? ওরাই তো তোকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল। না ওরা আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চায়নি, আমি নিজে হ্যাঁ, হ্যাঁ নিজে আমার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। তবে তুমি, মিথিলা এবং ওরা আমাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছিলে। আমি? তুই কি বলছিস্ মা? আমি ঠিকই বলছি বাবা রাসেল আমাকে বিয়ে করেনি, তোমার টাকাকে বিয়ে করেছিল, তাই তুমি যখন আবার টাকা দিতে চাওনি তখন রাসেলের কাছে আমি অপ্রয়োজনীয় হয়ে গিয়েছিলাম। রাসেলের হৃদয়ে আমার ভালবাসা ছিল না।

সে আমাকে কোনদিন ভালবাসেনি। আমাকে ভালবেসেছিল মামুন যে আমার জন্য জীবন দিয়েছে। তার সঙ্গে তুমি আমাকে বিয়ে দাওনি। আমার আজকের এ অবস্থার জন্য সবার আগে দায়ি তুমি, তারপর রাসেল এবং তার মা-বোন। মোস্তাফিজ সাহেব কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেছিলেন, ওসব এখন থাক মা আগে তুই সুস্থ হয়ে ওঠ্ তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।

মায়া চোখ মুছে কান্নাজড়িতকন্ঠে বলেছিল, আমাকে তোমার সুস্থ করে তুলতে হবে না বাবা, আমি যদি এমনিতেই সুস্থ হয়ে উঠি তবে বেঁচে থাকব আর না হয় মরে যাব, আমি কাউকে চাই না, আমি একাই বেঁচে থাকব সিস্টার, আমি একাই-- একজন নার্স সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। মায়া বলেছিল, সিস্টার আমি একটু একা থাকতে চাই, প্লিজ আপনি আমাকে একা থাকতে দিন। সিস্টার মোস্তাফিজ সাহেবকে বেরিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করেছিল। মোস্তাফিজ সাহেব বেরিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি বেরিয়ে যাবার পর একজন অপরিচিত মহিলা তার কেবিনে ঢুকেছিল। মায়া জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি? আমার নাম আশা, আমি একজন ডাক্তার।

আপনি ডাক্তার কিন্তু আপনি তো ডাক্তারের পোশাক পরেননি? আমি ডাক্তার তবে এই হাসপাতালের না? আমি একটা এন.জি.ও’র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, আমরা নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করি। মায়া শ্রদ্ধার সুরে বলেছিল, আপনি বসুন আপা। মায়া তার জীবনের ঘটে যাওয়া কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল, প্লিজ আমাকে আর বাবা’র কাছে পাঠাবেন না আপা। তবে কোথায় যাবে? আমি জানি না, শুধু জানি যার একটা জিদের জন্য আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল তার কাছে আমি আর কোনদিন ফিরে যাব না, বাবার বাড়ীতেও না, স্বামীরবাড়ীতেও না বাকী জীবন আমি নিজের মতো করে বাঁচতে চাই আপা। মায়া তোমার স্বামী, শ্বাশুড়ী এবং ননদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, আমরা আইনগত সহায়তা দিচ্ছি।

সেখানে তোমার যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আর বাবার বাড়ীর কথা বলছ তুমি না যেতে চাইলে যাবে না। তাহলে আমি আমাদের লিগ্যাল এ্যাডভাইজার এর সঙ্গে কথা বলি আইনগত কোন বাধা না থাকলে আমরা তোমাকে সব রকমের সাপোর্ট দিব। তাই করুন আপা। মায়া যতদিন হাসপাতালে ছিল ততদিন প্রায় আশা তার সঙ্গে একবার করে দেখা করতো।

দীর্ঘদিন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন থাকার পর হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাওয়ার দিন মায়ার বাবা, লতাসহ আরো অনেক আত্মীয় এসেছিল। লতা মায়ার দগ্ধ, বিকৃত মুখ দেখে মায়ার গলা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। মায়া লতাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, লতা আমার জন্য চিন্তা করিস্ না, আশা আপা আছে আমার একটা ব্যবস্থা হবে, তুই ভাল থাকিস্, মা আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় করতে চেয়েছিল, আমি পারিনি তুই মায়ের আকাংখা পুরন করার চেষ্টা করিস্। মায়া আশাকে বলেছিল, আপা--। তুমি যা চাইবে তাই হবে মায়া, তোমার বাবা আছে, আমাদের অর্গানাইজেশনের লিগ্যাল এ্যাডভাইজার আছে, আমি আছি।

তোমার জন্য যেটা ভাল হয় সেটাই হবে। না আপা আমার জন্য যেটা ভাল সেটা আপনারা ভাবলেই হবে না, আমি আর কারো ওপর বিশ্বাস রাখতে চাই না। আমি নিজের ভালটা এবার নিজেই ভাববো। বেশ তো, বল তুমি কি চাও? আপা আমি আর কোনদিন গ্রামে ফিরে যাব না। মোস্তাফিজ সাহেব বলেছিলেন, যাবি না মা তুই ঢাকাতেই থাকবি, আমি তোকে ঢাকায় রেখে লেখাপড়া শিখাবো।

কিন্তু আমি যে তোমার কোন টাকা নিব না। তুই কি বলছিস্ মা? আপা আমি যদি নিজের মতো করে বাঁচতে চাই তবে কি আপনি আমাকে হেল্প করবেন? হ্যাঁ কিন্তু তোমার বাবা’র সম্মতি লাগবে। আমি আমার জীবন থেকে সবার নাম বাদ দিয়ে নতুন করে বাঁচতে চাই আপা। মোস্তাফিজ সাহেব বলেছিলেন, বাবা’র নাম কি কখনো জীবন থেকে মুছে ফেলা যায়? আমি একা বাঁচতে চাই আপা, আমি আমার সব পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে আলাদা থাকতে চাই। আশা বলেছিল, সরি মোস্তাফিজ সাহেব আপনারা নিজেরাই তো দেখছেন, ও কোনভাবেই আপনাদের কাছে যেতে চাচ্ছে না।

আপনারাই বলুন কি করলে ভাল হয় তবে আমরা ওর ওপর কোন চাপ দিব না। সেদিনই মায়া চলে এসেছিল আশার সঙ্গে নির্যাতিত নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। পুনর্বাসন কেন্দ্রে কেটে গিয়েছিল বেশ কিছুদিন। সেখানে আরো কয়েকজন ছিল, সবার সঙ্গে জীবনের সুখ-দুঃখের কথা বলতে বলতে সময় কেটে যেত। তারপরও মায়ার সব সময় মনে হতো এটা একটা জীবন হলো, বসে বসে খাওয়া? একদিন সে আশাকে বলেছিল, আপা আমাকে আর কতদিন এখানে থাকতে হবে? আশা বলেছিল, তুমি যতদিন থাকতে চাও? আপা আমি যদি লেখাপড়া করতে চাই? করবে, অবশ্যই করবে, তুমি নিজের পায়ে না দাঁড়ান পর্যন্ত আমাদের অর্গানাইজেশন তোমার সমস্ত খরচ বহন করবে।

তারপর আশার উদ্যোগেই মায়া একটা কলেজে অনার্স ভর্তি হয়ে একটা মহিলা হোস্টেলে সিট নিয়েছিল। উর্মীর মোবাইলের রিং বেজে উঠল। সে মোবাইল রিসিভ করে লতার সঙ্গে কথা বলল। তারপর মোবাইলটা হাতে নিয়ে কয়েকমুহূর্ত কি যেন ভেবে নিল, দেখি তো শুভ্র জেগে আছে নাকি? উর্মী শুভ্রর মোবাইলে একটা মিস্ কল দিল। সঙ্গে সঙ্গে শুভ্র কল ব্যাক করল, কি ব্যাপার উর্মী? এত রাতে? কোন সমস্যা? না সমস্যা না, সরি আমি আসলে দেখলাম তুমি জেগে আছ নাকি? তাও ভাল এত রাতে তুমি যে আমাকে স্মরণ করেছ? এভাবে বলছ কেন? আমি কি তোমাকে রিং করতে পারি না? পার তবে কর না তো।

আচ্ছা কি করছিলে এত রাতে? তুমি তো জানো না আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। কেন? কোনদিন বই পড়ি, কোনদিন ইন্টারনেট ব্রাউজ করি। ইন্টারনেটেও কোন মেয়ে খুঁজে পেলে না? ইন্টারনেটে কেন? মেয়ে তো সরাসরি খুঁজে পেয়েছি, শুধু বলতে সাহস পাচ্ছি না। বলে ফেল। হ্যাঁ খুব শীঘ্রই বলব।

চলবে...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।