আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিস্যু যখন ইস্যু

বউটুবান

বাংলা একাডেমিতে আমার এক আত্নীয় চাকরি করেন। বহুদিন যাবত যাওয়ার জন্যে টেলিফোনে পীড়াপীড়ি করছেন। ক’দিন আগে তার উদ্দেশে রওনা হলাম। কিন্তু প্রখর রোদে বার বার তেষ্টা মিটাব কই? তাই অফিস থেকে তিন গ্লাস পানি পান করে মিরপুর থেকে গুলিস্তানগামী কোষ্টার চড়ে বসলাম। তখন বাজে সাড়ে তিনটা।

সাহবাগ মোড়ে নেমে অপেক্ষাকৃত কম ব্যস্ত ও ছিমছাম পথটা বেয়ে হেঁটে যাচ্ছি। পেটে অতিরিক্ত পানি গাড়ির ঝাঁকুনিতে প্রকৃতি ২ নম্বর সংকেত দিয়ে বসলো। একটু পথ যেতেই আর পা চলছে না। তলপেটটা শক্ত হয়ে আসছে। অনেকটা অস্থির হয়ে উঠলাম।

শরীর ঘেমে সয়লাব। লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। ডানে বামে কোন পাবলিক টয়লেট পাওয়া গেল না। কোন মতে হাঁটছি। দু’পা একত্র করে উর্দ্ধমুখী হয়ে দম আটকিয়ে চাপ কমাবার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি।

বরং দম আটকানোর ফলে হিস্যুর চাপ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। এমনি এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে রাস্তার বাম পাশের দেয়ালে আনাড়ি হাতের অস্পষ্ট লেখা চোখে পড়ল, "এই খানে পেশাব করিবেন না, করিলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা। " এটা দেখে অস্থির অবস্থায় সহসাই স্বস্তি ফিরে পেলাম। মনে মনে বল্লাম, যা করবে আল্লায়। পঞ্চাশ টাকা গেলে যাবে! আমি বুক পকেটে হাত চেপে রাস্তার ডান পাশ থেকে একটা দৌড়ে বাম পাশে দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে এপাশ-ওপাশ দেখে নিলাম।

তারপর অসম্ভব দ্রুততায় প্যান্টের বেল্ট ও চেইনটা কোনমতে খুলে সটান দাঁড়াতেই শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্রচন্ড বেগে হিস্যু করতেই পেছন থেকে কে যেন আচমকা হ্যাঁচকা টানে আমাকে রাস্তায় ফেলে দিল। কে-রে! -বলে পেছনে তাকিয়েই দেখি-পুলিশ ! হাতে তেল চিক চিকে মসৃন লাঠি। লাল টকটকে চোখ। তীর্যক ভাবে আমার দিকে ফণা তুলে তাকিয়ে আছে। কী যেন বলতে চাইছে পুলিশটি, প্রচন্ড রাগে তার চোয়ালে ঢেউ খেলছে; বলতে পারছে না কিছুই।

’শালা। নিষিদ্ধ জাগায় মূত্র ত্যাগ করস’ -বলেই পুলিশ আমার পেছন দিকে প্যান্টের বেল্টটা ধরে উল্টো দিকে টেনে উর্দ্ধশ্বাসে হাঁটা শুরু করল। হিংস্র বাঘের মুখে অসহায় হরিণের মত আমার অবস্থা! কুল রাখি না শ্যাম রাখি! কোন মতে ইন করা শার্ট বের করে সামনের উদোম অংশটা ঢাকার চেষ্টা করছিলাম বটে কিন্তু মাগার পুলিশের টানাটানিতে মূত্রথলির সমস্ত মূত্র চঞ্চল হয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করল। পুলিশের অসম্ভব টানা-হ্যাঁচড়ায় আমার প্যান্ট, মোজা ও জুতার অনেকটা অংশ ভিজে গেছে। এরই ফাঁকে তার জবা ফুলের মত লাল দু’টো চোখে আমার চোখ পড়তেই রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার যো হয়েছে।

বেরসিক পুলিশটি আমাকে বার বার হ্যাঁচকা টান মারছে আর বলছে, ’ক, এই আকামডা করলি ক্যান?’ আমি করজোড়ে বল্লাম, ’ভাই পুলিশ, আমার বিপদের কথাটা একটিবার মন দিয়ে শুনুন। কী অসহ্য যন্ত্রণায় অনেকটা নিরুপায় হয়ে আমি এখানে দাঁড়িয়ে.....। ’ ’চুপ। চুপ কর, বেটা খট্টাস। ’-বলতেই লক্ষ্মী ছেলের মত চুপ মেরে গেলাম।

পুলিশ বলছে, তুই কত খারাপ কামডা করলি তা কি বুঝতে পারছস? বল্লাম জ্বী বুঝতে পারছি ভাই। পুলিশ বল্ল, বুঝতে পারলে ’হ্যাবলার মত ভাই, ভাই করতাছস ক্যান?’ বিনয়ের সাথে বল্লাম, ’কী করব এখন আমি!’ পুলিশ একটু এগিয়ে এসে বলছে, ’অই হালায় কয় কিরে। ভোদাই তো দেখেছি, এতো রাম ভোদাই তো আর দেহি নাই। ’ কষ্টে বল্লাম, ’ভাই, এগুলা কী বলছেন আপনি আমাকে?’ পুলিশ হাতের লাঠিটা ঘুরিয়ে বল্ল, ’কতা কই, হারামজাদা। তুই পেচ্ছাব কইরা সারা শহর ভিজাইয়া ফালাইছস, আর এহন ন্যাকামি করতাছস্, নাহ্।

’ আমি বল্লাম, ’আমাকে ধরে এমন করতেছেন ক্যান? জরুরি কাজে এক জায়গায় যাচ্ছি। আমাকে ছেড়ে দেন। ’ ’কী? ছাইরা দিমু তরে? অই শালায় মনে অয় আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নাই। তাই আমাগো ছাইজটা বুঝতে পারতাছে না। ’-বল্লাম, ’কী করতে হবে ভাই, টানা-হ্যাঁচড়া না করে বলেন।

পুলিশ বলছে, আব্বে হালা টেহা ল বেডা। ’ ’কীশের টাকা চান আপনি?’ বলতেই হাতের বেন্দা দিয়ে আমার তল পেটে সজোরে গূতো মেরে বলল, ’তুই বুজসনা কীশের টেহা? জরিমানা ল বেডা, জরিমানা। পেচ্ছাবের জরিমানা। ’ পুলিশের এসব মারফতি জেরায় আমার হাত-পা ও বুক অনেকণ ধরেই কাঁপাকাঁপি করছিল। কম্পিত হাতে পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোটটা বের করতেই পুলিশ সিংহের মত গর্জে ওঠে বলছে ’এই, এইডা কি বার করতাছস? আমার সাথে মসকরা করস্? আমারে পঞ্চাশ টাহার পুলিশ মনে করছস।

’ বল্লাম, ’এই যে দেয়ালেই ত লেখা আছে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা!’ ’আরে হালায় আমারে আইন দেহায় দেহি। আরে বেডা কোন আবাইল্যা হালায় পঞ্চাশ টেহা লেকছে, হেইডারেই তুই আইন মনে করছস। আস্তা গর্ধভ। আমি আইনের লোক বোজছস? যেইডা কই হেইডা হোন। নাইলে কিন্তু ভেরা-ছেরা কইরা ফালামু তরে।

’ ভয়ে ভয়ে বল্লাম, ’আমি তাহলে কী করব এখন?’ ডানে বামে বারকয়েক তাকিয়ে আমার কানের কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে পুলিশ ফিস ফিস করে বলছে, ’যেই আকামডা তুই করছস মেলা ঝামেলায় পইরা যাবি কিন্তু। আর শুরু থাইককাই কিন্তু মেলা বেয়াদবি করতাছস। এইগুলানের কিন্তু ক্ষমা-ক্ষেমন্তি নাই। যানে বাঁচবার চাইলে তাড়াতাড়ি পাঁশসো টেহা আমার বাম পকেডে গুইঞ্জা দে। ’ পুলিশের এই কথায় আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।

অবাক হয়ে বল্লাম, ’ভাই এটা কী কন! পাঁচশ টাকা! ঠিকমত পেশাবটাও করতে পারি নাই। যা-ও একটু করলাম, সব তো আমার জাইঙ্গা, প্যান্টে আর মোজার মধ্যেই। শহরের তো কোন ক্ষতি হয়নি!’ একথা শুনে পুলিশের হাতের লাঠিটা ঘুরাতে ঘুরাতে মাথাটা ঝাকিয়ে বলছে, ’তুই কি জানস যে তোর এক ফোটা মুতের মাইধ্যে কয় শ রোগ আছে? তুই ত আমার কাপড়ও নষ্ট কইরা ফালাইছস। ল, টেহাডা ল। ’ আমি হতবিহ্বল হয়ে আবার পঞ্চাশ টাকার নোটটা বের করতেই পুলিশ হিংস্র দানবের মত আমার কন্ঠ চেপে ধরে বলতে লাগল, ’বেডা তুই আমারে দুলাভাই পাইছস’-বলেই হাতের লাঠিটা দিয়ে অন্ধভাবে পেটাতে লাগল।

আমি মার খেয়ে যতটা পর্যুদস্ত, বেচারা পুলিশ আমাকে মেরে তারচে বেশি কাহিল। আমাকে এলোমেলো পিটিয়ে হাপাতে হাপাতে পুলিশটি বলছে, ’তরে আইজকা আমি জীবনের শিক্ষা দিয়া ছারমু, হারামজাদা। ’ এ কথা বলেই পুলিশ আমাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বল্ল, ’এহানে চুপ কইরা খাঁড়া, আমি মুইত্তা লই। ’ মূহুর্ত বিলম্ব না করে পুলিশ প্যান্টের চেইনটা খুলেই আমি যেখানে পিশাব করতে দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক সেখানে তিনি নির্বিঘ্নে পিশাব করে দিলেন। আমি ডান-বাঁও তাকিয়ে দিলাম ভোঁ দৌড়।

এক দৌড়ে শাহবাগের মোড়ে মিরপুরগামী চলন্ত কোষ্টারের রড ধরে ওঠে পড়লাম। স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে পেছনে তাকিয়ে দেখি, বেচারা পুলিশ প্যান্টের চেইনটা লাগাতে লাগাতে ব্যাঙ্গের মত লাফিয়ে আমার দিকে দৌড়ে আসছে আর বলছে, ’এই যে ভাই যাইয়েন না, আমারে পঞ্চাশ টেহাই দিয়া যান। ’ কোষ্টার মোড় ঘুরে এগিয়ে চলছে। পুলিশের ক্লান্ত অথচ বিনম্র আবেদন অষ্পষ্টভাবে আমার কানে ভেসে আসছে। শত অত্যাচারিত হয়েও তার করুণ আর্তিতে আমার মনে করুণার উদ্রেক হলো।

এতক্ষণের কোস্তাকোস্তিতে সেও আমার মত ক্লান্ত-শ্রান্ত। সামান্য টাকার জন্য গলদঘর্ম পুলিশ অসামান্য পরিশ্রম করতে বিন্দু পরিমান অবহেলা করেনি। তাকে একেবারে বঞ্চিত করতে বিবেক বাধা দিল। অচল অবশ কম্পমান হাতে পকেট থেকে কোনমতে ২ টাকার একটা মলিন নোট বের করে প্যাঁচিয়ে গাড়ির জানলার ফাঁক দিয়ে নিচে ফেল্লাম। দেখি, বেচারা পুলিশ এক খাবলে টাকাটা হাতে তুলে নিয়েই আমার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে টাকাটা পকেটে ঢুকালো।

তার অষ্পষ্ট কথায় আর চাহনিতে কী ছিল তা আর বোঝা গেল না!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।