আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকা আমার ঢাকা, তোমাকে এভাবে মৃত্যুর দিকে হাঁটতে দেখতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে (১ম কিস্তি)

"বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় সংস্কৃতির জন্য অপমানজনক কোনকিছু এই ব্লগে লেখা যাবে না। "শিহরণে সত্তায় তুমি, হে আমার জন্মভূমি"

যে দেশের মানুষ সব খায়, মানুষের মাংস ছাড়া এখন পর্যন্ত স্বাধীন দেশের নাগরিক – এ নিয়ে আমার গর্বের শেষ ছিল না। আমার দেশকে কেউ ছোট করবে তা আমি কোনদিন কোন পরিস্থিতিতেই মেনে নেইনি। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। বাবা-মা যতটুকু পেরেছেন সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন।

ছোট বয়সে সেসব অপ্রাপ্তি নিয়ে আক্ষেপ থাকলে ও পরিণত বয়সে সেসব আর তেমন মনে নেই। আমি ঢাকা শহরের জন্মসূত্রে একজন নাগরিক। যে এলাকায় আমার জন্ম সে এলাকায় সেই সময় ৭৮ এবং তার পরবর্তী বহুবছর মানুষ যেতে চাইতো না, মানুষ বলতো ওরেব্বাপস, মীরপুর! সে তো অনেকদূর! আমরা ছিলাম ঢাকার উপশহরের বাসিন্দা। আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজন ঐ দূরত্বের কারণে আসতে চাইতো না। বাবা ৬৫ সালে ঢাকায় এসেছিলেন কর্মের সন্ধানে।

আর মা পড়া লেখার কারণে। আব্বু স্বায়ত্তশাসিত এক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী পেলেন। আম্মু ৭০ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে এম.এ শেষ করলেন, তার আগেই অনার্স করেছেন সেই একই প্রতিষ্ঠান থেকে। সম্বন্ধ করে তাদের বিয়ে হলো ৭৩ এ। ৭৪ এ আব্বু মীরপুরে বাড়ি কিনে এলেন।

সেই থেকে আমরা মীরপুরের অধিবাসী। মীরপুর ১২ নং সেকশনের সি ব্লকে তখন রাস্তা ছিল না। বৃষ্টি হলে সে কি দুরবস্থা! পানির সাপ্লাই ও ছির সেরকম। পুরো ১নম্বর লাইনে শুধু আমাদের বাসায় টেলিফোন ছিল। সেই নাম্বার আমার আজো মনে পড়ে ৩৮২৪৮১. আব্বা কল্যাণ সমিতি করলেন।

রাস্তা হলো। পানির লাইন এলো বাসায় বাসায়, এলো গ্যাস। এমন এক এলাকা যেখানে মুরগী পাললে সেটা পর্যন্ত চুরি হয়ে যায়। গাছের ফল তো হয় ই। তখন রোকেয়া সরণী ছিল না।

কল্যাণপুর ঘুরে আমাদের যাতায়াত করতে হতো। আম্মুর অফিসের বাস আসতো, পাবলিক বাসেও বেচারীকে আসতে হতো। সেই ৬নম্বর বাস। ফুলবাড়ীয়া পর্যন্ত গিয়ে তারপর। আব্বুর অফিসের মাইক্রো আসতো।

আব্বুর একটা ৫০সিসি হোন্ডা ছিল্। তা দিয়ে আমাদের সব রকমের সফর চলতো। আমাদের বাসা ভর্তি, লাইন ভর্তি, এলাকা ভর্তি ছিল গাছে। এক লাইনে ৪৮বাসা। কেউ ভাড়াটিয়া রাখতো না, নিজেরাই ঐ ছোট ছোট বাড়ি গুলোতে থাকতো।

আমরাও তাই। বৃষ্টি এলে ঘরে সাপ ও ঢুকেছে কখনো সখনো। আমাদের হুতাশ ছিল না। সারাদিন এখানে সেখানে খেলতাম। স্কুলে যেতাম।

পড়তাম। ফল খেতাম। আম, পেয়ারা, আমড়া, জাম, বরই, সফেদা, শরীফা, তেঁতুল, কামরাঙ্গা,জামরুল। সকালে ফুল কুড়াতাম। আমাদের লাল মাঠ ছিল সবার আকর্ষণ।

লাল মাঠে যাওয়া মানে অনেক দূরে যাওয়া। ঐ পর্যন্ত সাইকেল চালানো মানে আজ অনেকখানি সাইকেল চালিয়েছি। সব স্কুলের ছেলে মেয়েদের (এমডিসি স্কুল ছাড়া) বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা লাল মাঠেই হতো। আমাদের ঐ এলাকায় হয়তো কিছু ছিল না, তবে অবারিত জায়গা ছিল। এভিনিউ লাইন ছিল।

ছিল সিরামিক ইটের কারখানা। আমরা দেয়ালের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে ঢুকতাম ঐ কারখানায়। কালাপানি-কত মিথ্ ছিল কালাপানি নিয়ে, শিকল টেনে নিয়ে যাবে, পানিতে ডুবিয়ে মারবে। ভয় পেতাম, আবার শুনতাম। আলোকদি গ্রাম ছিল।

মোল্লারা সেখানকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। ভাইয়ার অনেক বন্ধুরা সেইসব গ্রাম থেকে নৌকা করে আসতো। তাদের গ্রামে আমরা পূজো দেখতে যেতাম। এরকম বস্তি ছিল না। হঠাৎ শুরু হলো বস্তি হওয়া।

তারপর গার্মেন্টস। মানুষ বাসা ভাড়া দেয়া শুরু করলো। রাস্তায় বের হলে অন্যরকম দৃষ্টি মাঝে মাঝেই দেখা শুরু করলাম আমরা। আমাদের শান্ত, অল্প মানুষের বসবাসের জায়গা গুলো কেমন হয়ে যেতে লাগলো। অনেক মানুষকেই চিনি না।

যারা অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলাম তাদের মধ্যে যোগাযোগ কমতে থাকলো। বিকেলে হাঁটতে বের হওয়া একরকম বন্ধ হয়ে গেল। কারণ লাইনে মানুষ আর মানুষ। এভাবে করতে করতে ২০০৩ সালে আমরা চলেই এলাম প্রাণের মীরপুর ছেড়ে। আমার লাইনে গেলে আমি আর কিছুই চিনি না।

৮৮ এর বন্যাতেও আমাদের যে লাইনে পানি উঠেনি সে লাইনে এখন একটু বৃষ্টি হলেই খোলা ড্রেনের নোংরা পানি। অনেক উঁচু উঁচু বিল্ডিং কিন্তু এমন কেউ নেই যে রাস্তা সংস্কার করবে, ড্রেন খোলা অবস্থা থেকে ঢাকার ব্যবস্থা করবে। আব্বু বারো নম্বরের মসজিদ করে আসছে। ঐ পর্যন্তই। তারপর আর কেউ কিছু করেনি।

লাল মাঠ, আমাদের ঈদগাহ, আমাদের মীরপুর ১২ এবং পল্লবী এলাকার একমাত্র খেলার মাঠে কমিউনিটি সেন্টার হয়েছে, বিডিআর শপ হয়েছে। একটা নতুন খেলার জায়গা কেউ দেয়নি। আমাদের ছেলে মেয়েরা এখন আর খেলে না। মীরপুর গেলে দোকান আর দোকান দেখি। আমাদের ৪নম্বর লাইনের মাথায় একটা জেনারেল স্টোর ছিল “সম্ভার”; সাইকেল নিয়ে ঐ দোকানে যেতাম পাউরুটি আর মাখন আনার জন্য।

এত দোকান এত দোকান কিন্তু কোন রাস্তা নেই। একাকী কোন মেয়ে সাইকেল চালাবে সে তো মনে হয় এখন রূপকথার গল্প। চোখের সামনে কত ফাস্টফুড কাবাব কাপড় এসবের দোকান হলো। মানুষ বাড়লো। গার্মেন্টস হলো।

কর্মসংস্থান হলো। আমার শিয়াল ডাকা মীরপুর, আমার প্রথম প্রেমের মীরপুর, আমার ভয় জাগানিয়া মীরপুর, আমার মণিপুর স্কুলের মীরপুর,আমার বিআইবিএমের মীরপুর তার খোলামেলা ডানপিটে তরুণ, নির্ভিক তরুণীর চিকচিকে চেহারা হারিয়ে ইটের স্তূপ হয়ে গেল ২০০০ সাল পেরোতে পেরোতে। ইনডোর স্টেডিয়াম, মীরপুর স্টেডিয়ামের কাছে এখন কি আর কোন মেয়ে আড্ডা দেয়? কেউ আছে যে এই যান সংকুল রাস্তায় ঘণ্টা ভাড়া করে রিকশা ঘোরে? আমি মৃত মীরপুরের দিকে তাকাই। হায় আমার ২৪ বছরের দেখা মীরপুর, তোমাকে আমি এখন আর ভয়েও দেখতে যাই না। খেতাম হয়তো কুয়ার পানি, লাইন দিয়ে টিউবওয়েলের পানিও এনেছি, হাউজ থেকে মগ কেটে গোসল করেছি, বৃষ্টিতে ঘরের ভেতর পানি পড়েছে ফুটো চাল চুঁইয়ে…কিন্তু আমার মীরপুর এমন মৃত্যুপথযাত্রী ছিল না তো! (চলবে)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.