আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নদীরা ডাকছে, সাড়া দাও

সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য- জন কীট্স
বাংলাদেশের নদীরা ডাকছে। কণ্ঠজুড়ে আকুতি—সাড়া দাও, সাড়া দাও! জমিনে কান পাতলেই নদীর এই করুণ আর্তি শোনা যায়। কাঁদতে কাঁদতে একটি বা দুটি নদীই আমাদের ডাকছে না। এ দেশের ২৩০টি নদীর সবাই ডাকছে। এসব নদীর পাড়ে পাড়ে এক সময় ছলাত্ ছলাত্ ঢেউ আছড়ে পড়ত।

এপাড় ভেঙে, ওপাড় গড়ে ঢেউয়ের দল জানান দিত বাংলার বিপুল প্রাণশক্তির। এখন নদীরা সব প্রাণহীন কঙ্কাল। বাংলার বুক থেকে প্রাণের চাঞ্চল্য হারিয়ে গেছে। মুমূর্ষু দশার নিস্তব্ধতা ভিড় করেছে মানুষ, মাছ, ঘাস, ফসল, কীট-পতঙ্গ, পশু ও পাখির মুখশ্রী জুড়ে। তারপরও নদীরা ডাকছে।

ইচ্ছাশক্তিঅলা মানুষের কাছে প্রার্থনা জানানোর মধ্যে বেঁচে থাকার আশাবাদ পাওয়া যায় বলেই নদীরা ডাকছে। মরণের পথে যেতে যেতে জানিয়ে যাচ্ছে—হে মানুষ, হে সংবেদনশীল প্রাণ, আমাদের ব্যথার দোসর হও। তোমাদের ব্যথারও নিদান মিলবে আমাদের ঘোলা পানির বৈভবে। সেই ব্রিটিশ জমানা থেকেই বাংলার নদীরা মানুষের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে যাচ্ছে। প্রায় দু’শ বছরের শাসনামলে ব্রিটিশরা নদীশাসন ও রেলপথ নির্মাণের নাম করে নদীর গতিপথ নষ্ট করে দিয়েছে।

এ সময়ভাগে হিন্দু ও মুসলিম যুগের নদী ব্যবস্থাপনা ধ্বংস করে দিয়ে বাংলার কৃষি ও পানিবাহিত এলাকাসমূহ বিপর্যস্ত করে তোলা হয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরে ২৪ বছরের জন্য বাংলাদেশ শাসনকারী ঔপনিবেশিক পাকিস্তানিরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। ১৯৬৪ সালের ক্রুগ মিশনের প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা তামিল করে এ দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় ৫৮টি বড় বাঁধ তৈরি হয়। ইউএসএইডের দেয়া ২০০ কোটি ডলারের প্রকল্পে এসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়। নদী শাসনের ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি কর্মযজ্ঞ স্বাধীনতার পরে আরও জোরেশোরে শুরু হয়।

স্বাধীনতার মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই ৭ হাজার ৫৫৫ কিলোমিটার বাঁধ, শতাধিক পোল্ডার ও আট হাজারের মতো পানি নিয়ন্ত্রক কাঠামো রাতারাতি নির্মাণ করে নদীগুলোর গলায় ফাঁস-বন্ধন হিসেবে ঝুলিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি নদী দখল করে ঘর-বাড়ি-দোকান-মার্কেট-কল-কারখানা নির্মাণের মচ্ছব শুরু হয় দেশজুড়ে। এর ভয়াবহতা কত তীব্র তা বোঝা যায় বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চলের পরিস্থিতি দেখলে। এক সময় এখানে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বংশী, তুরাগ, টঙ্গিখাল, ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, গাজীখাল, বানার, বালু, লক্ষ্যা, লোহাজঙ্গ, ফুলদি, ভুবনেশ্বরী, কীর্তিনাশা, ইছামতী, মালিক বাদের খাল, গাজাহাটার খাল ও ইলশামারী নামে ১৯টি নদী ছিল। এসব নদীর মধ্যে বেশিরভাগই উধাও হয়ে গেছে।

যারা এখনও মুখ থুবড়ে টিকে আছে তাদের প্রাণবায়ুও উবে যাওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে গেছে গলায় খুনির কৃপাণ হিসেবে ঝুলে থাকা ভারতীয় বাঁধসমূহ। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর ৪৭টি নদীর ভারত অংশে দুই শতাধিক বাঁধ নির্মাণ করেছে সে দেশের শাসকগোষ্ঠী। যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বাঁধটি হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের অদূরে পদ্মার বুকে দেয়া ফারাক্কা বাঁধ। এই বাঁধের কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ভরা বর্ষায়ও পানিশূন্য থাকছে।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সব নদীই এই বাঁধের প্রভাবে একে একে মৃত্যুবরণ করছে। বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্যের স্বর্ণভাণ্ডার সুন্দরবন লবণাক্ততার শিকার হয়ে বিপন্ন হচ্ছে। ভারতীয় বাঁধগুলো শুধু বাংলাদেশকেই শুকিয়ে মারছে না। সে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকেও সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। তাই ভারতের জনগণের মধ্যে বাঁধ বিরোধী তীব্র আন্দোলন চলছে কয়েক দশকজুড়ে।

দুই দেশের গণমানুষের প্রতিবাদের তীব্রতায় ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী নদী খুনের উন্মত্ততা থেকে বিরত থাকার পরিবর্তে উল্টো নিত্যনতুন পরিকল্পনা নিয়ে দুর্বারগতিতে এগিয়ে চলছে। আন্তঃনদী প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে দুই দেশের সর্বনাশ করতে ভারত এখন আরও বেশি বেপরোয়া। এমন বাস্তবতায় সারা দেশের নদী পরিস্থিতি বিবেচনায় আনলে দৃৃশ্যমান হয় এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। যার আখ্যানভাগ থেকে জানা যায়, এরই মধ্যে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে চিরতরে ১৭টি নদী হারিয়ে গেছে। বিলীন হওয়ার পথে রয়েছে আরও ৮টি নদী।

হুমকির মুখে আছে উত্তরাঞ্চলের ৬৭টি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১২টি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৩২টি নদী। শুধু তাই নয় নদীর শরীরও ক্ষয়ে গেছে ভয়ঙ্করভাবে। স্বাধীনতার সময়ে সারা দেশে নদীর শরীরের আয়তন ছিল ২৪০০০ কি. মি. দীর্ঘ। বর্তমানে তা তা টিকে আছে মাত্র ৬০০০ কি. মি.। নদীর এই মৃত্যু ও ক্ষয়েই দুর্ভাগ্যের শেষ হয়নি।

মরুকরণে বাংলাদেশ যে দোজখে পরিণত হয়েছে তাতে জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধিও বলি হয়ে যাচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ে গেছে মিঠা পানির ২৬০ প্রজাতির মাছ, ১৫০ প্রজাতির শামুক ও ঝিনুক, ৫০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৫০০০-এরও বেশি সম্পূরক উদ্ভিদ, ২৬ প্রজাতির ঘাস, ৬৫০ প্রজাতির পাখি, ১৪৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৩০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৫ জাতের উভচর প্রাণী, ২২৪ প্রজাতির গাছ ও ১৩০টি প্রজাতির তন্তু উত্পাদনকারী উদ্ভিদ। মাছে-ভাতে বাঙালির দেশে মানুষের রসনায় তৃপ্তি যোগানো পুঁটি, টেংরা, মলা, মিহি, মাগুর, চাঁদা, ধুতরা, গুজা, বাগদা চিংড়ি, বোয়াল, শোল, বেলে, টেপা, ফলি, নারলি, গোটা নাইল্যা, পোগাল, খাঁটি পুঁটি, নেদাই, খাটা, পাবদা, আইড়, কালবাউশ, নৌয়ালি, শাল দাঁকা, শাঙ্কা, বইরগর রাজ, গুজা, চিতল, কৈ, শাতি, পোয়া, ভাঙনা, চিতল, ছোট পুতনি, খাটা চেং, কালজাটা, রূপচাঁদা, কোনা টেংরা, কাজলী, বোম, ছুরি, গাং, বাঁশ পাতারি, বাকল, চাঁদা, রাজ, কলই, সরপুঁটি, কালুন, দোয়চেলা, মলা, ইচা, খইলশা, চেলা, বাগ, ধুরয়া, নালাছাতা, বাজয়ি, নাড়ালি, পিঠকাটা, চেউয়া, বাইম ও বোটি মাছের বেশিরভাগ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নদী খুন করার তাণ্ডবলীলার মধ্যে আমরা শুধু প্রাণবৈচিত্র্য, কৃষি, নদীপথ ও গ্রামীণ জীবনের সমৃদ্ধিই হারিয়েছি তাই নয়, আমাদের জীবনের স্বস্তিও খুন হয়ে যাচ্ছে। আজ নদীমাতৃক বাংলাদেশের সর্বত্রই দেখা দিয়েছে মিঠা পানির প্রচণ্ড অভাব।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের প্রধান শহরগুলোর বাসিন্দারা পানির অভাবে মিছিল-স্লোগানে মুখর হয়ে জানান দিচ্ছেন জীবন কতটুকু বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, আমরা যদি নদীগুলোকে মৃত্যু ও ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে বাঁচিয়ে না তুলতে পারি তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলদেশ পরিণত হবে সাহারার মতো কোনো এক বিজন মরুভূমিতে। ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে ২৩০টি নদীর সব ক’টি বালুচরের শীর্ণ রেখার ছাপ হয়ে থাকবে মাত্র। রেখাই দেখা যাবে। যেখান থেকে পানির অভাবে মানুষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে।

এমন সঙ্কটাপন্ন নদী-বাস্তবতায় তাই বাংলাদেশের সব মানুষের এখনই সোচ্চার হওয়া দরকার। নদীর ডাকে জনে জনে সাড়া দিয়ে গণপ্রতিরোধের প্রবল ঢেউ নির্মাণ করতে হবে। বাংলাদেশে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রশ্ন ওঠলে দলান্ধতা যেভাবে আমাদের ভাগ করে ফেলে, একইভাবে নদীর ডাকে সাড়া দেয়ার কথা আসলেও আমরা ভাগ হয়ে যাই। একদল শুধু দেশের নদীনালা দখলের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী সভা-সমাবেশ-মানববন্ধন-সেমিনার করে দায় সারে। আরেক দল নদী আগ্রাসনের প্রশ্নে ফারাক্কা ও টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারত-বিরোধী রাজনীতির সলতের মধ্যে মাঝে-মধ্যে মিছিল-সমাবেশ-মানববন্ধন-লংমার্চ-সেমিনার-গোলটেবিল করে দু’এক ফোঁটা তেলের যোগান দিয়েই দায় সারছেন।

কিন্তু নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রেখে জনজীবন, প্রাণবৈচিত্র্য, কৃষি, অর্থনীতি ও প্রাণচাঞ্চল্য রক্ষার প্রার্থনা উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। মাঝখানে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা বাঁধ বিরোধী লংমার্চ করে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ও দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান চলতি বছর সেই দিনের স্মরণে পালিত ফারাক্কা দিবসে পদ্মার বালুচরে গিয়ে পত্রিকাটির পাঠক সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভায় যোগ দিয়ে নদীর ডাকে সত্যিকারে সাড়া দিয়েছেন। দু’জনের ডাকেই গণমানুষের বিষণ্ন চোখ ছল ছল করেছে। বজ্রমুষ্ঠী উচিয়ে তারা নদী মেরে ফেলার খুনেপনা প্রতিরোধে সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু বাংলার নদীর বুকে বছরের পর বছর জুড়ে চকচকে ছুরি বসানো সীমারদের ক্ষান্ত করা যায়নি।

তাই আজ ব্রিটিশ কলম্বিয়ার নদী সংরক্ষণবাদী মার্ক এঙ্গেলোর মতো নদীর ডাকে কার্যকর সাড়া দেয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষের জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এঙ্গেলো নদীর ডাকে সাড়া দিতে জনগণকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেন। যার ফলে ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় নদী দিবস পালন শুরু হয়। ২৫ বছর ধরে ব্যাপক গণজাগরণের সৃষ্টি করে তিনি নদী রক্ষার গুরুত্ব ও তাত্পর্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। ২০০৫ সাল থেকে প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববারকে জাতিসংঘ নদী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

এরপর থেকে বিশ্বের অনেক দেশেই নদী দিবস পালিত হচ্ছে। এই নদী দিবস বাংলাদেশে পালন করতে হবে বিদেশি নদী আগ্রাসন ও দেশীয় নদী দখলদারি প্রতিরোধের বিবেচনা থেকে। তাই আসুন নদীর ডাকে সাড়া দিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির পক্ষে সংহতি জানাই। লেখক : নদী বিষয়ক সেচ্ছ্বাসেবী উদ্যোগ রিভারাইন পিপল-এর তিন সদস্য: মরিয়ম জামিলা তামান্না, সাইয়্যেদ কুতুব ও খোমেনী ইহসান সূত্র: আমার দেশ
 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।