আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বীরশ্রষ্ঠে মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধে যাননি কোন সরকার প্রধান এমনকি মন্ত্রীও

জসীমউদ্দীন,বালুখালী,রাঙ্গামাটি।

৭১’র মুক্তিযুদ্ধে ২০ এপ্রিল মুন্সী আবদুর রউফের মেশিন গানের গুলিতে পাক হানাদার বাহিনীর দুটি লঞ্চ, একটি ¯পীড বোট পানিতে ডুবে যায় এবং প্রায় পাকবাহিনীর দুই প্লাটুন শত্র“ ধ্বংস হয়। পাক হানাদার বাহিনীর মূল লক্ষ্যে ছিল বুড়িঘাটের চিংরিখালের সন্নিকটে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ দখল করা। তখন চিংরিখাল বরাবর উত্তর-দক্ষিণের হ্রদের ছোট এক টুকরো চরের উপর প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী করে শত্র“ পক্ষের গতিবিধি লক্ষ্যে রাখার জন্য মেশিনগানার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন তৎকালীন অষ্টম ইস্টবেঙ্গল ও ইপিআরের(ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সদস্য শহীদ ল্যান্স নায়ক মুন্সী আব্দুর রউফ। সেদিন তীব্র গতিতে এগিয়ে আসা পাক হানাদার বাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানীর অধিক সৈনিক, ৬টি তিন ইঞ্চি মর্টার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রসহকারে তিনটি লঞ্চ ও দুটি স্পিড বোট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এলাকায় ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানকে চতূর্দিকে ঘিরে ফেলে।

মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর মর্টার শেল ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র দিয়ে গোলাবষর্ণের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা সম্পূর্ন ভেঙ্গে পড়ে। কিন্ত প্রতিরক্ষা ব্যূহতে দায়িত্বরত ল্যান্স নায়ক মুন্সী আব্দুর রউফ শত্র“ পক্ষের প্রবল গোলা বর্ষণের মূখেও তিনি তাঁর অবস্থানে থেকে মেশিনগান দিয়ে নিজস্ব অবস্থানে স্থির ছিলেন। মুন্সী আব্দুর রউফ তাঁর নিজস্ব অবস্থান থেকে মেশিনগান দিয়ে শত্র“র উপর গোলা বর্ষণ আব্যাহত রেখে সহ-যোদ্ধাদের সকল সদস্যদের নিরাপদে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তখন মুন্সী আব্দুর রউফ বেরিয়ে এলেন তার পরিখা থেকে। মেশিনগান তুলে ধরে অনবরত গুলি ছুড়তে লাগলেন সরাসরি শত্র“র স্পিট বোটগুলোকে লক্ষ্যে করে।

তার অসীম সাহস ও দুর্দান্ত মেশিনগানের গুলির আঘাতে শত্র“ পক্ষের ২টি লঞ্চ ও একটি স্পিট বোট পানিতে ডুবে যায় এবং দুই প্ল¬াটুন শত্র“ সৈন্যেদের নিস্তব্দ করে দেয় । বাকী অক্ষত স্পিট বোটগুলো এ অবস্থা দেখে দ্রুত সরে গিয়ে মুন্সী আব্দরু রউফের মেশিনগানের রেঞ্জের বাইরে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান করে। শত্র“ সৈন্যে সমগ্র প্রতিরক্ষা ব্যুহ এলাকায় গুলি বর্ষণ শুরু করে। একদিকে বীর বাঙ্গালী মুন্সী আব্দুর রউফের মেশিনগানের গুলি অপরদিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মর্টারের গোলা । চলতে থাকে আক্রমন আর পাল্টা আক্রমন।

কিন্তু হঠাৎ পাকিস্তানী বাহিনীর একটি মর্টারের গোলার আঘাতে লুটিয়ে পড়েন মুন্সি আব্দুর রউফ। শাহাদাৎ বরণ করেন তিনি । শহীদ মুন্সি আব্দুর রউফের অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ন পদক্ষেপের ফলে শত্র“ বাহিনী মহালছড়িতে মুক্তিবাহিনীর মূল অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করে কর্তব্যপরায়নতা ও দেশ প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এজন্য তাঁকে দেয়া হয় বীরত্ব ও দেশ প্রেমের অমর স্কীকৃতি হিসেবে ‘বীর শ্রৈষ্ঠ’ উপাধী।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়,তৎকালিন ইপিআরের সদস্য ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ জন্ম গ্রহন করেন ফরিদপুর জেলার বোয়ালখালী থানার সালামপুর গ্রামে ১৯৪৩ সালের মে মাসে। মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালের ৮মে তৎকালীন ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেল্স (ইপিআর) বাহিনীতে সৈনিক পদে যোগদান করেন। যেভাবে সন্ধান মিলে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এর সমাধিস্থলঃ- স্বাধীনতার প্রায় ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে রাঙাামটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট এলাকায় খোঁজ পাওয়া যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানী এই মহান যোদ্ধার। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বীরশ্রেষ্ঠ দেশের জন্য নিজের জীবনকে আত্মহুতি দিলেও বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের সমাধি স্থল দীর্ঘ ২৫ বছর সবার কাছে অজানা থেকে যায়। ১৯৯৬ সালে বিডিআর নানিয়ারচরের বুড়িঘাট নিবাসী ২ ভাই জ্যোতিষ চন্দ্র চাকমা ও দয়াল কৃষ্ণ চাকমার সহায়তায় বীরশ্রেষ্ঠের কবরের স্থানটি সনাক্ত করতে সক্ষম হয়।

উপজাতীয় এই দুইভাই সেইসময় মুন্সী আব্দুর রউফকে কাপ্তাই হ্রদের বুকে জেগে থাকা একটি টিলায় সমাহিত করেছিলেন। এরপর বিডিআর উক্ত টিলায় প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের স্মৃতিসৌধ নির্মান করে। বাংলাদেশ রাইফেল্সের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান ১৯৯৭ সালের ১ মার্চ সেই স্মৃতিসৌধটির উদ্বোধন করেন। জাতীয় দিবস ছাড়া আর কোন দিন এই মহান বীরশ্রেষ্ঠের সমাধীর কেউ খোঁজ খবর না রাখলেও শহীদের জননী বৃদ্ধা বেগম মুকিদুন্নেছা প্রতি বছর স্বাধীনতা এবং বিজয় দিবসে ছুটে আসেন রাঙ্গামাটি জেলায় প্রিয় সন্তানের কবর জেয়ারত করতে। এ যেন এক নিবিঢ় নাড়ির টান।

সন্তানের প্রতি এক অকৃত্রিম ভালোবাসা। তার সহকর্মী হিসেবে উত্তরাধিকারের ধারক বাংলাদেশ রাইফেলস এর স্থানীয় ইউনিট তার সমাধীর সার্বিক তত্বাবধান করে থাকে। নির্মিত হয়েছে মুন্সী আব্দুর রউফ এর নতুন স্মৃতিসৌধ ঃ- মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৩৬ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এবং গণপূর্ত বিভাগের সার্বিক তত্বাবধানে রাঙ্গামাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সামনে ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে জাতীয় অহংকার এবং গর্বের প্রতীক সাত বীরশ্রেষ্ঠের অন্যতম বীর শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের স্মৃতিসৌধ। মুন্সী আব্দুর রউফ এর আসল সমাধী শহর থেকে প্রায় ২ঘন্টার দূরত্বে নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট নামক স্থানে অবস্থিত। দিনটি ছিলো ৭১ এর ২০ এপ্রিল।

দেশ মাতৃকার এই বীর সন্তানসহ সাত বীরশ্রেষ্ঠ’র স্মরণে প্রতিবছর সারাদেশে নানা অনুষ্ঠান হয়,নানাভাবে স্মরণ করা হয় তাদের। কিন্তু স্বাধীনতার পর অনেক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও আজ অবধি কোন সরকার প্রধান, এমনকি কোন মন্ত্রীও এই বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এর সমাধী পরিদর্শনের বা শ্রদ্ধা জানানোর সময় পাননি। এ লজ্জা কার??

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।