আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেড়াল-বন্দনা



বেড়াল-বন্দনায় মাতেনি কোন সভ্যতা? এখনও নাকি পৃথিবীতে ৩৩ প্রজাতির ৫০ কোটিরও বেশি পোষা বেড়াল রয়েছে। মিসরীয়রা তো বেড়ালেরও মমি বানাতো। তাদের দেখাদেখি গ্রিক আর রোমানরাও বেড়াল-ভক্ত হয়ে ওঠে। গ্রিক চন্দ্রদেবী ডায়ানা বেড়াল ভীষণ পছন্দ করতেন। অবশ্য কালো বেড়াল নিয়ে নানা কুসংস্কার এখনও সক্রিয়।

তবে বেড়ালরা কথা বলতে পারলে সর্বপ্রথম এটাই বলতো :'পুরো অষ্টাদশ শতক জুড়ে ইউরোপবাসী মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমাদেরকে কাতারে কাতারে হত্যা করলেও মানবতাবাদীরা মুখ খোলেনি। ' তখন ইউরোপ জুড়ে হঠাৎ প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। আর এটার সব দায় বেড়ালের ঘাড়ে চাপে। হিটলারি স্টাইলে বেড়াল নিধন-যজ্ঞ চলে। অত্যাচার এতোটাই চরমে ওঠে যে ইউরোপ বেড়াল-শূন্য হবার উপক্রম হয়ে যায়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, পরের শতাব্দীতে ইউরোপবাসীর বেড়াল প্রেম উথলে ওঠে। নিরীহ এ প্রাণিটি দিনে ১৬ ঘণ্টা ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়। শরীরে নাকি মানুষের চেয়ে ৪৪টি হাড় বেশি আছে। মানুষের ২০৬টি। অন্ধকারে এটা মানুষের চেয়ে ৬ গুণ বেশি পরিষ্কার দেখে।

আচ্ছা, তুলতুলে পশমের এ প্রাণিটি অহিংস বলেই কি খোকন সোনারা বেড়ালকে ছাড়া শ্বশুর বাড়ি যেতে চায় না? 'বিড়্' ধাতু থেকে বিড়াল শব্দটির উৎপত্তি দেখানো হলেও অধিকাংশ ভাষাবিদ বিড়াল শব্দটিকে অর্বাচীন সংস্কৃত বলেছেন। বিড় মানে আক্রোশ, বিষ্ঠা ও আঁচড়। অর্থ যাই হোক না কেন, হিন্দু দেবী ষষ্ঠীর বাহন হিসেবে পরিচিত বেড়াল মনে আক্রোশের কারণে মাটি আঁচড়ায়। আবার বিষ্ঠা ত্যাগ করে মাটি আঁচড়িয়ে তা ঢেকে দেয়। সংস্কৃতে বেড়ালের জনপ্রিয় প্রতিশব্দ হচ্ছে 'মার্জার'।

'মৃজ' ধাতু থেকে শব্দটি তৈরি। মৃজ মানে পরিষ্কার বা শোধন করা। আর বিড়াল পরিষ্কার থাকতে পছন্দ করে। পালি, বৈদিক ও প্রাচীন সংস্কৃতে বিড়াল শব্দটি নেই। কিন্তু বাংলায় মার্জারের চেয়ে বিড়াল শব্দটাই বেশি পরিচিত এবং আদরের।

বাংলায় একটি প্রতিষ্ঠিত প্রবাদ বাক্য হচ্ছে বিড়ালতপস্বী। বকধার্মিক বা ভণ্ড যোগী অর্থে বাংলায় বিড়াল-তপস্বী শব্দটি বাংলায় চালু রয়েছে (বাপ অসৎকর্মে রত হইয়া নীতি উপদেশ দিলে ছেলে তাহাকে বিড়ালতপস্বী জ্ঞান করিয়া উপহাস করিবে - আলালের ঘরের দুলাল)। বিড়ালের একটি বিশেষ ধ্যানমগ্ন অবস্থা অনুকরণে বিড়ালতপস্বী শব্দটি চালু হয়। বিড়াল ইঁদুরের অপেক্ষায় যখন ওঁৎ পেতে বসে থাকে তখন তার বাহ্যিক অবয়ব দেখে এটা মনে হয় যেন অহিংসাই তার পরম ধর্ম। এ প্রসঙ্গ থেকেই ভণ্ড অর্থে বিড়ালতপস্বী শব্দটি এসেছে।

পঞ্চতন্ত্র ও মহাভারতে বেড়ালের সাধুপনা নিয়ে গল্প রয়েছে। এক সময় বিড়ালতপস্বী অর্থে 'বিড়ালসন্ন্যাসী' শব্দটি চালু ছিল (তথা গিয়া উত্তরিল বিড়ালসন্ন্যাসী - কাশীদাসী মহাভারত)। কিন্তু শব্দটি এখন আর চোখে পড়ে না। এটা বাঘের মাসী নামেও পরিচিত। ফারসিতে একটি মশহুর প্রবাদ হচ্ছে : 'গুরবে কুশতন শবই আউয়াল'।

মানে শাদির প্রথম রাতেই বেড়াল মারতে হবে। প্রসঙ্গটি নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী 'মার্জার নিধন কাব্য' নামে একটি সরেস কোবতে লিখেছেন। জীবনানন্দ দাশ বেড়ালকে স্মরণ করেছেন বেশ গুরুত্বের সাথে : 'সারাদিন একটা বেড়ালের সঙ্গে আমার দেখা হয় গাছের ছায়ায় রোদের ভেতরে বাদামী পাতার ভিড়ে কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভেতর নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি'।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।