আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঈদগল্প : ফুলকলি, লাল জামা আর লাল পুতুল !

বন্ধ জানালা, খোলা কপাট !

এক সন্ধ্যার পশ্চিম আসমানে যখন কোমর সচেতন নায়িকাগো মতন, চিক্কন ঈদের চাঁদ হাসি দেয়, সেই চাঁদের হাসি দেইখা যখন আমগো বেতার বাংলাদেশের বেতারে বেতারে ইথারে ইথারে ছড়ায়া যায় মনের ভিতর আনন্দের নাচন তোলা দুঃখু মিয়ার সেই চিরযুবতী গান,- 'রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ..!' খুশীতে লাফাইতে লাফাইতে ফুলকলি তখন হাততালি দেয় আর কয়, - 'ঈদ হইবো ! ঈদ হইবো !' ফুলকলি তখন তাগো সাদা উঠান যেইটার কোণায় কোণায় সাদা গন্ধরাজ, হলুদ গেন্দা, আর লাল লাল ন'টা ফুল ফুইটা থাকে সবুজ লতার ভিতর ভিতর,-সেই উঠানের মধ্যখানে আইসা খাড়ায় । পিছন পিছন তার মাও আসে, ঈদের চাঁদ আর মাইয়ার খুশী দুইটাই তখন তার হাসির উপলক্ষ হয় । দ্বীনদার মুসল্লিরা তখন-'আল্লাহু আকবার আল্লাহুআকবার আল্লাহুআকবার..লা ইলাহা ইল্লাল লা হু আল্লাহুআকবার আল্লাহুআকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ--এই দোয়া পড়তে পড়তে সুন্নত পালনে সজাগ হইয়া যায়, তখন টিভি চ্যানেলওয়ালারা তাগো এক কোণায় দুইটা শিশুর কোলাকুলি কিম্বা কোন মসজিদের মিনার ধারণ কইরা 'ঈদ মোবারক' এই শুভেচ্ছাবাণী আমগো লাইগা লটকায়া দেয় ! 'মোবারক ! তুই শালা ঝুইলা পড়লি'--এই মর্মবাণীতে তখন মোবারক নামের বন্ধুরা কিঞ্চিত হেনস্থা অতঃপর বিব্রত হয় । তখন মমতাজ বানু নাম্নী জনৈকা মহিলা তার ১২ হাজার টাকা দামের শাড়ির একটা ভাঁজ খুইলা নিজের মুখের উপর হালকা কইরা চাইপা রাখে এবং সুঘ্রাণ লয় , তখন মমতাজ বানুর ১২ বছরের মাইয়া মিলিবানু তার ১২ গুণন ৪ = ৪৮ শ' টাকা দামের ঈদের জামা কোলে লইয়া টিভিতে ঈদ আনন্দ মেলার বিজ্ঞাপন দেখে ! এইদিকে ফুলকলির চাচা কলিমুল (যার সংসার ফুলকলিগো থেইকা আলাদা, দিনমজুরী কইরা যে দিনাতিপাত করে), তখন বাজারে গিয়া তার পোলা সলিমুলের লাইগা একটা ফুলওয়ালা গেঞ্জি কিনতে চায়লে, গেঞ্জির দাম ৪৮ টাকা দেইখা সেমাই চিনি কিনার পয়সার খামতি হওনের সম্ভাবনা তারে দ্বন্দ্বে ফালাইয়া দেয় ! তখন ফুলকলির মার যে একটা নোকিয়া ১১শ' মোবাইল আছে, সেই মোবাইলটা বাইজা উঠলে, সৌদী আরব থেইকা ফুলকলির বাপে ফোন করছে দেইখা সে খুশী হয় । -কি গো ; আমগোরে মনে পড়লো ? - তোমরাতো মনেই থাকো ! - মনের মইধ্যে থাকি, না বাইরে ? - কও কি তুমি এইসব ! - কয়দিন পর ফোন দিলা, আইজ ? - পাঁচদিন পর ।

- প্রত্যেকদিন ফোন দিলে কি অয় ? - প্রত্যেকদিন ফোন দিলে কি পয়সা বাচে ? - উঁম্...হইছে.. ! - ফুলকলি কই ? - আছেতো ! - হেরে ঈদের কাপড় কিছু কিইনা দিছো ? - দিছিতো ! - ভালৈছে ! হুনো..! - কি ? - কলিমুলরে দুই হাজারটা ট্যাকা দিও, ঈদ আইছে... ! - আইচ্ছা দিমু ! তুমি খাওতো ঠিকমতন ? - খাই । মাইয়ারে দেওনা এট্টু ! - দিতাছি ! নোকিয়া এগারশ' মোবাইল তখন ফুলকলির ছোট্ট হাতে বদল হইয়া গেলে নরম হাতে কানের লগে মোবাইল ধইরা ফুলকলি কয়, - বাজান, তুমি আয়বানা ? - আমুরে মা ! - কবে আয়বা ? - ঈদের পর ! - ঈদের কয়দিন পর ? - তাড়াতাড়িই আসুম ! - তোমার লাইগা মন পোড়ে , বাজান ! - আমার আম্মার লাইগাও আমার মন পোড়েতো ! - তুমি তাড়াতাড়ি চইলা আসো..! - চইলা আসুম । এখন কওতো, আমার আম্মাজানে কি জামা কিনছে ? - লাল জামা ! - আসার সময় আমার আম্মার লাইগা কি আনুম ? - কমু ? - অবশ্যই কয়বেন, আম্মা ! - একটা লাল পুতুল আনবা ! - আইচ্ছা, লাল পুতুল... ! তখন, বঙ্গদেশের বিস্তৃত জমিনে কর্পোরেট মোবাইল ব্যবসায়ীরা যেইখানে তাগো নিজ নিজ জাল বিস্তার কইরা রাখছে, আর যেহেতু তারা রাইত-দিন কথা কওনের লাইগা মাইনষেরে উৎসাহদান কর্মব্রত বিশেষ যত্নে পালন কইরা আসতেছে, সেহেতু অনেকের অনেক মোবাইলই ঠিক একই লগে বাইজা উইঠা থাকবো ! তবে, ঠিক সেই সময়ে নগরীর এক তরুণীর মোবাইল বাইজা উঠনের গল্পটা এইখানে প্রাসঙ্গিক হইবো, যেইখানে অন্যপ্রান্ত থেইকা তরুণীরে জিগায়, - আপনি কেমন আছেন ? - সহি সালামত আছি ! - জেনে প্রীত হলাম ! - এই মূল্যবান তথ্য জানার জন্যেই কি আপনি ফোন দিছেন ? - জ্বি, জ্বনাবা ! আমার আরো বলার ছিলো,- 'আপনাকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা, মোবারকের ঈদ'! - আপনাকেও ! এইবার তাহলে রাখি ? - রাখবেন..? তার আগে আর কিছুই কি বলবেন না ? - একটা কথা বলবো,- আপনার কি সমস্যা ? আপনি আমাকে কেন ফোন দেন ? আপনার সঙ্গে না আমার আড়ি ? - জ্বি মহিয়সী ; আমার কোন সমস্যা নেই ! আপনি আমার ফোন ধরেন কেন ? - তুই মানুষ না ! - কথা সত্য ! প্রেমিকরা কখনও কখনও মানুষ থাকেনা ! আপনাকে দেখার জন্য মন আথালিপাথালি করে ! - ঈদের নামাজ পড়ে সোজা আসতে পারবি ? - আপনি বললে আমি শরতেও কদমফুল জোগার করতে পারি ; বিলিভ মি ! - আঁতলামী অসহ্য লাগে ! শরতে কাশফুল পেলেই আমি ধন্য । সোজা চলে আসবি জায়গামতন ! - মহিয়সীর হুকুম শিরোধার্য ! দুই ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলির মেলা জইমা উঠলে যখন, আতর বিক্রেতার শিষি ভরতি সুগন্ধ বাতাসে উইড়া যায়তে থাকে, বেলুন বিক্রেতার বেলুন আর শিশু, শিশু আর খেলনা উড়ালজাহাজ, আর প্লাষ্টিকের পাখিরা যখন এক লগে উড়াল দিয়া উইড়া যায়তে থাকে, তরুণীর ফোনের অপর পার্শ্বের কন্ঠনা তখন সশরীরে বন্ধুগো ভিড় গলাইয়া বাইরইয়া আসে । সামনে যে রিক্সাওয়ালাটারে পায়, তার লগে কোলাকুলি কইরা এক লাফে রিক্সায় উইঠা বসলে রিক্সাও তখন উড়ালপঙ্ক্ষী হইয়া উড়াল দেয় ! তখন দোয়েল মার্কা , অথবা সংসদ ভবন, কিম্বা পাটচাষীগো ছবিওয়ালা তরতাজা রঙ্গিন কাগজগুলা জীবন্ত হইয়া ভাগ্যবান শিশুগো পকেটে পকেটে বড়ো বেশী আমোদে খিলখিল কইরা হাসে ; তখনও কিছু কিছু শিশু মসজিদগুলার সামনে, চৌরাস্তার মোড়ে মোড়ে থালা হাতে খাড়াইয়া থাকলে, মাঝে মাঝে তাগো ভাগ্য বাইজা উঠনের টুংটাং শব্দ পাওয়া যায় ! নগরীর তরুণীটিরে তখন সেইরকমই মলিন একঝাঁক কিশোর- কিশোরীগো ভিড়ে খাড়াইয়া থাকতে দেখা যায় ! তার হাতভরতি তখন লাল - সবুজের রং ! সবুজ জমিনে লাল গোলক আঁকা টি-শার্ট কিশোরগো হাতে ; আর সবুজ জামার লগে লাল হাফ প্যান্ট কিশোরীগো হাতে সে যখন তুইলা দেয়, তখন এক ঝলক ঈদের চাঁদ অকস্মাৎ কিশোর -কিশোরীগো চোখে মুখে খেইলা যায় ! তখন, ফোনের অপর পার্শ্বের কন্ঠটা সশরীরে এই জায়গায় হাজির হইলে, এই দৃশ্য দেইখা খানিক ষ্ট্যাচু অব এই নগরী হইয়া সে খাড়াইয়া থাকে ! তারপর যখন সে দুইটা লাল গোলাপ ধইরা তরুণীর সামনে যায়, তরুণী তারে দেখে, দেখে আর হাসে , - পাঞ্জাবি গায়ে তোরেতো বর এর মত লাগতেছে ! - সব পুরুষরেই একদিন বর এর মতো লাগে, মাগার সব নারীকেই মাদার তেরেসার মতো লাগেনা ! - মানে কি ! প্যাঁচায়া কথা বলা তুই কবে ছাড়বি ! - সম্ভবত আজকেই ! মানে হচ্ছে, আপনাকে মাদার তেরেসার মতো লাগছে ! - ও ! আমি বুঝি অতো বুড়িয়ে গেছি ! - আরে নাহ্ ! মাদার তেরেসাও একসময় যুবতী আছিলো গো.. ! তখন তাড়া সেই রিক্সাটায় উইঠা বসলে, তাগো দুইটা কাঁধ লাইগা থাকে ! তরুণীর চুলের ঘ্রাণে হঠাৎই পোলাটার একটা ইংরেজী ডায়ালগ মনে পইড়া যায়,- 'উইল ইউ মেরী মি ?' তখন, তার মুখ দিয়া বাইরইয়া আসে, - আমি কি আপনার হাতটা ধরতে পারি, জ্বনাবা ? - জ্বি..সানন্দে ! তখন রিক্সা আবারও উড়ালপঙ্ক্ষি হয় ! তখন, ফুলকলির বাপে সৌদী আরবে যেই দোকানে হোম ডেলিভারীর কাজ করে 'দাব্বাব' (বিশেষ প্রজাতির মোটর সাইকেল) চালাইয়া, যেইখানে তারে ৮০০রিয়াল বেতন দেয় আর সে এই পয়সায় কিছুই গোছায়া আনতে পারেনা বইলা, কিম্বা কিছু গোছায়া আরো গোছায়া আননের পয়সা অবশিষ্ট থাকেনা বইলা, যেমন, দেশ থেইকা আসার সময় যে নিজের ক্ষেতি জমিটা বন্ধক রাইখা আসছিলো, সেইটা ছাড়াইতে গিয়া, এবং দুই বছর আগে তার মা-বাপ হারা বোন কুলসুম, যারে সে বড়ো করছে, আর বিয়াও দিছে দুই লাখ টাকা খরচ কইরা, আবার বিয়া উপলক্ষে ঘরটাও তারে নতুন কইরা করতে হইছে, এইভাবে সব খরচ গিয়া গত ছয় বছরে যখন সে তার মাইয়াটারে একবারও দেখতে যায়তে পারেনাই, যেই মাইয়াটারে সে মাইয়ার মার পেটে রাইখা আসছিলো, যেই মাইয়াটার ছবি দেইখা সে একলা একলা বালিশে মুখ লুকাইয়া কান্দে, যেই মাইয়ার লাইগা তার মনটা বড়ো উদাস হয়, কাজে মন বসেনা, কাজে মন না বসলেও বাধ্য হইয়া তারে কাজ করতে হয়, সেই দোকানের তিনটা ডেলিভারী নিয়া সে রাস্তায় নামে ! সাঁ কইরা লাল একটা গাড়ি পাশ কাটায়া চইলা যায় ! লাল গাড়ির ভিতর লাল জামা পড়া একটা মাইয়ার মুখ তার মাইয়ার মতোই দেখতে , এক ঝলক দেখা যায় ।

তখন সে মাইয়ার ভাবনায় বিভোর হয় ! সে দেখে লাল জামা পইড়া মাইয়াটা কতো খুশীতে হাসে, তখন মেইন রাস্তা থেইকা ভিতরের রাস্তায় ঢুকনের মোড়ে সামনে থেইকা একটা জিএমসি গাড়ি আইসা তারে উড়ায়া দেয়, দাব্বাব আর সে উড়তে থাকে, উড়তে উড়তেই সে দেখে ফুলকলির হাসি মুখ আর নাই ! মাইয়াটা কানতে থাকে, তখন সব শক্তি দিয়া সে চিৎকার করে,- 'ফুলকলি ! কান্দেনা মা আমার...আমি লাল পুতুল কিনছি !'

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.