আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এ্যানথ্রাক্সঃ সতর্ক হওয়ার এখনি সময়


বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লুর রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই নতুন আতংক হিসেবে হাজির হয়েছে এ্যানথ্রাক্স। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় আজ রবিবার (৫ সেপ্টেম্বর ২০১০) থেকে এ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে তাদের সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি রেড এলার্ট জারি করেছে। মন্ত্রণালয় থেকে সিভিল সার্জন সহ সকল জেলার সংশ্লিষ্ট সকলকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গত ২ দিনে নতুন ৪৪টি নতুন কেস সহ ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর) এ পর্যন্ত (রবিবার সকাল পর্যন্ত) সারাদেশে ২৯৮ জন এ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত রোগীর কথা নিশ্চিত করেছে। এ্যানথ্রাক্স প্রথম সনাক্ত করা হয় সিরাজগঞ্জ জেলায়, আগস্ট মাসের শেষের দিকে।

পরবর্তীতে এ রোগ দ্রুত পার্শ্ববর্তী জেলা পাবনা, টাঙ্গাইল এবং কুষ্টিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। আসুন এ রোগ সম্পর্কে জানি এবং সচেতন হইঃ এ্যানথ্রাক্স কি? এ্যানথ্রাক্স হল Bacillus anthracis নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংঘটিত মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি যা সাধারণত রুমিন্যান্ট (ruminant) বা জাবর-কাটা প্রাণীদের হয়ে থাকে (যেমনঃ গরু, ছাগল, ভেড়া, মেষ প্রভৃতি)। আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে আসলে কিংবা আক্রান্ত পশুর মাংস খেলে এ্যানথ্রাক্স রোগ মানবদেহে আসতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, এ্যানথ্রাক্স মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। এ্যানথ্রাক্স কয় প্রকার? এ্যানথ্রাক্স মুলতঃ ৩ প্রকার-- ১।

কিউটেনাস এ্যানথ্রাক্স (cutaneous anthrax)-- তিন ধরনের মধ্যে এই এ্যানথ্রাক্স এর প্রকোপ বেশি এবং আমাদের দেশে এটা নিয়েই এখন সবাই আতংকিত। এ্যানথ্রাক্স স্পোর ত্বকের সংস্পর্শে এলে কিউটেনাস এ্যানথ্রাক্স দেখা দেয়। প্রথমে চামড়ায় ছোট ছোট লালচে-বাদামী রঙের ফুসকুরি দিয়ে শুরু হয়। এ ফুসকুরির চারপাশে লালচে রঙ থাকে। সময়ের সাথে সাথে লালচে-বাদামী ফুসকুরির কেন্দ্রে আলসারের মত মুখ দেখা যায় যেখান দিয়ে রক্ত মিশ্রিত রস বের হতে থাকে যা পরে শুকিয়ে গিয়ে কালো শক্ত আবরণ বা ক্রাস্ট (crust) তৈরি করে।

এর সাথে মাংসপেশীতে ব্যথা, জ্বর, মাথাব্যাথা এবং বমি বমি ভাব থাকতে পারে। ২। গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল এ্যানথ্রাক্স (gastrointestinal anthrax)-- আক্রান্ত গবাদিপশুর কাঁচা এবং অসিদ্ধ মাংস খেলে গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল এ্যানথ্রাক্স হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রের প্রাচীর ভেঙ্গে রক্তে প্রবেশ করে এবং সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বমি বমি ভাব, ক্ষুধামান্দ্য, রক্ত-আমাশয় এবং পেটব্যাথা হতে পারে এমনকি দ্রুত মৃত্যুও হতে পারে।

৩। ইনহেলেশনাল এ্যানথ্রাক্স (Inhalation anthrax)--শুরুতে হালকা জ্বর থাকে পরে নিউমোনিয়া, শক, কোমা এবং মৃত্যু হতে পারে। এটা যদিও বিরল তবে এটাই সবচে মারাত্মক। চিকিৎসা? কিউটেনাস এ্যানথ্রাক্স হলে আক্রান্ত/ক্ষত স্থান থেকে সোয়াব (swabs) নিয়ে পরীক্ষা (কালচার) করে এ্যানথ্রাক্স ডায়াগনোসিস করা যায়। তাড়াতাড়ি অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা শুরু করলে কিউটেনাস এ্যানথ্রাক্স সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা যায়।

পেনিসিলিন রেজিস্ট্যান্স কিনা তা পরীক্ষার আগেই ট্যাব সিপ্রোফ্লক্সাসিন ৫০০ মিগ্রা দিনে একবার করে দেয়া যেতে পারে। পরীক্ষার পর বেনজাইল পেনিসিলন ৬ লাখ ইউনিট ৬ ঘন্টা পর পর মাংসে অথবা ফেনক্সিমিথাইল পেনিসিলিন ৫০০ মিগ্রা ৬ ঘন্টা পর পর দেয়া যেতে পারে। এর সাথে এমাইনোগ্লাইকোসাইড যোগ করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। রোগীকে তরল জাতীয় খাবার বেশি খাওয়াতে হবে। তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

যারা এ্যানথ্রাক্স প্রবণ এলাকায় আছেন তারা Prophylaxis হিসেবে ট্যাব সিপ্রোফ্লক্সাসিন ৫০০ মিগ্রা ১২ ঘন্টা পর পর খেতে পারেন। একটু সচেতন হলেই এ রোগের আক্রমণ হতে বাঁচা যায়। আর রোগ দেখা দিলেও ভয়ের বা আতংকিত হওয়ার কিছু নাই। কারন সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে এ রোগের হাত থেকে সম্পূর্ণ নিরাময় লাভ করা যায়। একনজরে এ্যানথ্রাক্সঃ ১।

এ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়া জনিত এক ধরনের সংক্রামক রোগ যা পশু থেকে মানবদেহে ছড়ায়। ২। এ্যানথ্রাক্স মুলতঃ শরীরের ৩টি অংশে হয় (ত্বক, ফুসফুস এবং অন্ত্রে) ৩। আক্রান্ত ত্বক থেকে সোয়াব নিয়ে পরীক্ষা করে সহজেই এ রোগ নিশ্চিত (ডায়াগনোসিস) করা যায়। ৪।

অ্যান্টিবায়েটিক খেলে এ রোগ সেরে যায়। ৫। এ্যানথ্রাক্স সম্পূর্নরূপে প্রতিরোধ করা যায়। সংযোজনঃ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ্যানথ্রাক্স (তড়কা রোগ) নিরাময় ও প্রতিরোধে করণীয় কি এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা দিয়েছে। নিচের লিংক থেকে ১৮২ কিলোবাইটের পিডিএফ ডকুমেন্টটি ডাউনলোড করে দেখতে পারেন।

ডাউনলোড করুন বিঃদ্রঃ কয়েকজনের সুপারিশমত ক্ষতের ছবি গুলো মুছে দিলাম। আপডেটঃ অনেক ব্লগার পোস্টে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন। প্রশ্নগুলোর উত্তর একত্রে পোস্টে সংযুক্ত করলাম। গরু কিংবা ছাগলের সংস্পর্শে গেলে কি এই রোগ হতে পারে? --হ্যাঁ সংস্পর্শে গেলে হতে পারে। আপনার যদি ক্ষত শরীর নিয়ে আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে যান তাহলে আপনার মাঝেও সংক্রামিত হতে পারে।

আবার, কসাই যারা মাংস কাটে তাদেরও হতে পারে। মুরগী কিংবা হাস এর মাংস খেলে কি এই রোগ হতে পারে? --না, এ রোগ সাধারনত রুমিন্যান্ট (ruminant) বা জাবর-কাটা প্রাণীদের হয়ে থাকে (যেমনঃ গরু, ছাগল, ভেড়া, মেষ প্রভৃতি) কি কি ভাবে এই রোগ ছড়ায় --মূলত ৩ উপায়েঃ ১) আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে (বিশেষ করে কসাই সম্প্রদায়, পশু চিকিৎসক, ল্যাব টেকনিশিয়ান) ২) আক্রান্ত পশুর মাংস খেলে ৩) এনথ্রাক্স এর স্পোর যদি নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করা হয় (খুব বিরল) আক্রান্ত হওয়ার কত সময় পরে রোগের লক্ষনগুলো দেখা দেয়? এ্যানথ্রাক্সের ইনকিউবেশন পিরিয়ড (জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার পর থেকে প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পাবার সময় পর্যন্ত) ১ থেকে ৫ দিন। তবে ক্ষেত্রে বিশেষে ৬০ দিন পর্যন্ত হতে পারে। আতংকিত হওয়ার মত কিছু আছে কি? যেমন, আজকে ইফতারে পরিবর্তন আনার জন্য গরুর চাপ কাবাব কিনে আনলাম। খাওয়ার পর মনে হল, কাজটা কি ঠিক হল? তো, এখন গরুর মাংস খাওয়া উচিত হবে কিনা, মাংস খেতে হলে কতক্ষণ বা কিভাবে সেদ্ধ/রান্না করার পর খাওয়া উচিত, কাবাব বা ঝলসানো মাংস খাওয়া উচিত কিনা এসব বিষয় জানাও জরুরী।

আতংকিত কথাটা বলার কারন হল--বার্ড ফ্লু আমাদের পোল্ট্রি শিল্পের জন্য একটা চরম আঘাত ছিল। সেসময় অসংখ্য মুরগী আমরা সন্দেহের কারনে মেরে ফেলেছি। আমাদের দেশের মত গরীব দেশের জন্য তা অবশ্যই আঘাত। অনেকে পোল্ট্রি ব্যবসাই ছেড়ে দিয়েছে। এখন এ্যানথ্রাক্সের কারনে যদি আমরা গরু-ছাগল মেরে ফেলি তা হবে আমাদের অর্থনীতির জন্য আরেকটা আঘাত।

এজন্যই আতংকের কথা এনেছি। ....শুধু গরুর চাপ না, এরচাইতে আমার কাছে বিপদজনক মনে হয়েছে গরুর হালিম কে। কারন হালিমে কোন ধরনের মাংস ব্যবহার করা হয় আমরা কেউ জানিনা। তবে এখনি গরুর মাংস খাওয়া বন্ধ করতে হবে কিনা সরকার এ ব্যাপারে কোন নির্দেশ দেয়নি; কারন দেশের অধিকাংশ এলাকায় এখনো এই রোগ দেখা যায়নি। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে আক্রান্ত এলাকার গরু-ছাগলের মাংস একেবারেই পরিহার করা উচিত (তা রান্না মাংসই হোক আর ঝলসানো কাবাবই হোক) আচ্ছা টিকা দেয়ার কোন সিস্টেম আছে নাকি মানুষের জন্য এ্যানথ্রাক্স এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা হয়েছে তবে এখনও তা বাজারে আসেনি।

আক্রান্ত হলে ঠিক কোথায় যেতে হবে? কোন বিশেষায়িত হাসপাতালে? আক্রান্ত হলে সর্বপ্রথম নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে (সেটা সদর হাসপাতাল হোক আর বেসরকারী ক্লিনিকই হোক)। এ্যানথ্রাক্স এর চিকিৎসা মোটামুটি সব হাসপাতালেই দেয়া সম্ভব; বিশেষায়িত হাসপাতালে যেতেই হবে--এমন নয়। মোটকথা হল রোগটা ডায়াগনোসিস হওয়া জরুরী। চিকিৎসা কঠিন নয়। ইনহেলেশনাল এ্যানথ্রাক্স এবং কিউটেনাস এ্যানথ্রাক্স কি বাজার থেকে আনা মাংসেও/বাসায় মাংস কাটার সময় থাকতে পারে? (যেহেতু মাংসের সংস্পর্শে এলে ছড়ায়) এতক্ষন কি মাংসে জীবানু বেচে থাকতে পারে ? এ্যনথ্রাক্স জীবানু পশুর দেহে/পশু জবাইয়ের পর মাংসে কতক্ষনে বেচে থাকে? ইনহেলেশনাল টা একেবারেই বিরল; যদি না আপনাকে কেউ পয়জনিং করে।

আর বেঁচে থাকার ব্যাপারে বইয়ে বলা আছে যে এ জীবানু স্পোর হিসেবে (স্পোর হল এ জীবানুর নিষ্ক্রিয় অবস্থা) ৪৮ বছর প্রতিকুল/অনুকুল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। কাজেই আক্রান্ত মাংস বাসায় আনার পরও এ জীবানু রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে। মাংস ভালভাবে সিদ্ধ করলে কি এনথ্রাক্স প্রতিরোধ করা সম্ভব? বইয়ে বলা আছে, এ্যানথ্রাক্স এর জীবানু (স্পোর) কে যদি ১২ মিনিট ধরে ১০০ ডিগ্রি সেঃ এ সিদ্ধ করা হয় তাহলে স্পোর ধ্বংস হয়। কিন্তু সমস্যাটা অন্যখানে-- আমাদের মা-বোন বা গৃহিনীদেরকে এই তথ্যটা ভালভাবে জানাতে হবে। কারন অনেকের কাছে "ভালভাবে সিদ্ধ" মানে হল চুলায় কষানো কিংবা প্রেশার কুকারে সিদ্ধ করা।

আবার অনেকের কাছে "আধা সিদ্ধ" মাংসই হল "ভালভাবে সিদ্ধ" মাংস। কাজেই এই সিদ্ধ করা নিয়ে সবসময় সন্দেহ থেকেই যায়। মানুষ থেকে না ছড়ালেও মানুষের ব্যবহার করা পোষাক/জুতা থেকে ছড়াতে পারে। হ্যাঁ যদি কিউটেনিয়াস এ্যানথ্রাক্স হয় তবে রোগীর ব্যবহৃত জুতা বা পোষাকে স্পোর থাকতে পারে এবং আক্রমণ করতে পারে। এজন্য আপনার শরীরে কোন ক্ষত থাকলে কিউটেনিয়াস এ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত মৃত কোন ব্যক্তি বা কোন পশুর সংস্পর্শে যাওয়া উচিত হবেনা।

গরু বা গরুর মাংস দেখে সাধারণ মানুষ কিভাবে বুঝবে যে ঐ গরুটি অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত? অসুস্থ/ঝিমানো গরু দেখে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করা যেতে পারে। তবে মাংস ল্যাবে পরীক্ষা না করে শুধু চোখে দেখে বোঝা যাবেনা। উপায় একটা হতে পারে--পরিচিত বা বিশ্বস্ত দোকানীর কাছ থেকে মাংস কেনা।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.