আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শম্বুক বাস-গতি , সেদ্ধ বাস-মতি

আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে

"৬০ বছর বেঁচে থাকা কোন মানুষ ২০ বছর ঘুমিয়ে কাটায়" এহেন মামুলি তথ্যও যখন প্রথমবার মস্তিষ্কের নিউরণে যুতসইভাবে আঘাত করেছিল, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমেছিল শীতল স্রোত । দু'দিন বাদেই যখন মস্তিষ্ক জানবে ৬০ বছরের ১০ বছর বাসে কেটে গেছে , তখন আর অবাক হব না । ঢাকার ট্রাফিক জ্যামকে টেক্কা দিয়ে বাস-কারা-জীবনের দৈর্ঘ্য ১০ বছরের নীচে নামিয়ে আনা এখন রীতিমত সৌভাগ্যের ব্যাপার। শম্বুক-সম এই বাস-গতিতে আহাজারি না করে বাসকেই জীবনের অংশ ভেবে মানুষের মতিগতি পরখ নেয়ার অনন্য সুযোগ হিসেবে এই বাস-মতি রন্ধনের প্রয়াস। ১...... ফার্মগেটগামী ওয়ানলাইন আর তরঙ্গের গুলশানের লাইন বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় অটবির শো-রুম ছুঁই ছুঁই ।

বিকেলের শেষ আলো ঠিকরে পড়ছে অপেক্ষমান যাত্রীদের কপালে , আর তাতে মুক্তোদানার মত চকচক করে উঠছে যাত্রীর মুখমন্ডলের সহস্র ঘাম-বিন্দু। এমন বীভৎস লাইনে অপেক্ষমান যাত্রীরা যখন শেষমেশ বাসে চড়ার সুযোগ পায় , তখন কারও দিকে কারও ফিরবার জো থাকে না। অথচ সেদিন বিকেলে বাসে চড়েই সবার দৃষ্টি আটকে গেছে জনৈক ভদ্রলোকের দিকে । ভদ্রলোক তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছেন "আমার মোবাইল , মোবাইললললললল , নিয়ে গেল রে , নিয়ে গেল"। ঘটনার আকস্মিকতায় সম্বিত ফিরে পেতে যাত্রীদের কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল।

যারা সম্বি্ত ফিরে পেলেন তাদেরই একজন জিজ্ঞেস করলেন , "হাইজ্যাক ?? কে করসে ? কে কে ?" ঘটনা বুঝতে পেরে অন্য যাত্রীরা ততক্ষণে গণপিটুনি দেয়ার তীব্র স্পৃহায় হাত মুঠো করে ফেলেছেন । কিন্তু যুদ্ধংদেহী যাত্রীদের উত্তপ্ত বাসনায় শীতল জল ঢেলে দিয়ে মোবাইল-ওয়ালা জানালেন , তিনি কিছুই টের পাননি , কখন হয়েছে তাও টের পাননি । দু এক মুহূর্তের মাঝেই অনেকেই সম্ভবত আশা ছেড়ে দিয়েছে , লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় যদি নিয়ে গিয়ে থাকে , তাহলে তো এতক্ষণে বদমাইশটার টিকিও ছোঁয়া যাবে না । "আরে শিগগির কল দেন , দেখি হাইজ্যাকার বাসেই কিনা"... ড্রাইভার গলা ফাটিয়ে বলে । "নাম্বার বলেন ভাই , নাম্বার বলেন" ..........রিং করার জন্য মোবাইল হাতে হাঁক দেয় এক যাত্রী।

"০১৮১...." মোবাইলের লাউড স্পিকার অন , পুরো বাসে পিন পতন নীরবতা । "রিং হচ্ছে , রিং হচ্ছে , শালা এখনও ফোন অফ করার চান্স পায়নাই" সবাইকে অবাক করে দিয়ে বদমাইশ শালা ততক্ষণে ফোন রিসিভ করে ফেলেছে । কিন্তু একি ???????? এ যে শালা নয় , শালীর কন্ঠ । পরিস্কার করে শুদ্ধ সুরেলা কন্ঠ ভেসে আসে "হ্যালো , হ্যাঁ বলো" হতবুদ্ধি যাত্রীদের মাঝে তখন চলছে গণ মুখ চাওয়াচাওয়ি । "অ্যাঁ , মহিলা পকেটমার ???? এ কোন ঘোর কলিকালে এসে পড়লাম রে বাবা "---- সবার মনের কথাটা অবশ্য তখনও কেউ মুখ ফুটে বলে ওঠেনি ।

তার আগেই বিজ্ঞ কেউ খানিক বিরক্তির স্বরে হাঁক দেয় , "ভাইজান কি মোবাইল ঘরে রেখে এসেছেন , কথা শুনে তো ভাবী বলে মনে হয় " ভদ্রলোকের তখন ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছুটেছে , বউকে তিনি চিনতে পেরেছেন । তার বোকাটে মুখখানা অফিস ফেরত বাস বোঝাই ক্লান্ত যাত্রীদের রাম-ঝারির অপেক্ষা করে । নাহ , তেমন কিছু হয় না । ব্যস্ত এই শহরে মাগনা এই বিনোদনে বাসজুড়ে তখন কেবলই হাসির রোল । কেউ শুধু আস্তে করে বলল , "ভাইজান , নেক্সট টাইম থেকে একটু সাবধানে , নয়ত ক্রসপিটুনিতে একটা নিরীহ লাশ পড়ে যাওয়ার জোগার হইসিল" ২........................... বাসের আড্ডাগুলো এখন সেভাবে জমে ওঠে না ।

মাঝপথে লোকের নেমে যাওয়া যেমন একটা কারণ , তার চেয়ে বড় কারণ বাসের দু'সারির মাঝে ওয়াক-ওয়েতে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ । এই সারির মানুষগুলো চীনের প্রাচীর হয়ে দু'সারির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে আড্ডার শেষ সম্ভাবনাটুকোকে গলাটিপে হত্যা করে । গত মাঘের শেষদিনে অবশ্য তার ব্যাতিক্রম হল । একটু আগেই হয়ে যাওয়া তুমুল বৃষ্টির রেশ ধরে বাস সেদিন কাগজে কলমে হয়ে উঠেছে সিটিং বাস । আবারও সেই গুলশান টু ফার্মগেট , তবে বাস এবার ৬ নম্বর ।

মহাখালী যেতেই আড্ডাটা রীতিমত জমে উঠল । বিষয়বস্তু যথারীতি দেশ-জাতি । গেল গেল করে অনেকে হৈ হৈ করে উঠছে , অন্য পক্ষ তখন দেশ জাতিকে রক্ষার জন্য একের পর এক সু-পরামর্শ দিয়ে চলছে । হঠাৎ করেই কেউ গ্যাস সংকটের কথা তুলতেই অনেকে ক্ষেপে উঠল । বাসা-বাড়িতে চুলো জ্বলছে না একথা স্মরণ হতেই ক্ষোভ দাবানলে রুপ নিল ।

কিন্তু রাগ ঝাড়ার জায়গা কোথায় ? খানিকটা সময় সরকারকে তুলোধুনো করার চেষ্টা করে অনেকে সফল হল না । নিবেদিত কিছু সরকারপন্থী প্রাণপণে সমালোচনায় বাধা দিল । মহাখালী রেললাইন ছেড়ে এগুলেই হাতের বাঁয়ে সিএনজি স্টেশন , তাতে দাঁড়ানো সারি সারি প্রাইভেট কার। আর যায় কোথায় । বাস-জনতা একজোট হয়ে শুরু করল প্রাইভেট কারের মুন্ডুপাত।

[si...."দেখেন দেখেন , দেশে হচ্ছেটা কি দেখেন" ---"আমরা রান্নার গ্যাস পাইনা , আর এরা ...................." ----"প্রাইভেট কারের লাইন দেখসেননি ভাইসাব , মন বলে এই গুলিরে ..." ----"এইগুলিরে লাইসেন্স দিয়েই চলতেসে , কারও কোন মাথাব্যথা নাই , ক্যাম্নে কি ?" ---"আরে হ্যারা তো এইসবেই চড়ে , আমগো মত তো বাসের ঝুলানি টের পায় নাই " ------"যানজট সমস্যার পুরা দায় প্রাইভেট কারের" এ পর্যায়ে এসে সবাই একমত হল যে যানজটের দায় পুরোই প্রাইভেট কারের। বাসের গণ-আদালতে তখন পারলে প্রাইভেট কারের ফাঁসি তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু বিকল্প কি ? নানা জনের কাছ থেকে সলিউশন আসতে শুরু হল। "পাবলিক বাস চালু করতে হবে " "কিন্তু সেইটার জন্য বিশাল প্ল্যান কইরা নামতে হইবো, মহিলাদের কি দুর্ভোগ হয় দেখছেন না ? তারা যেন উঠতে পারে , সেইটা আগে নিশ্চিত করতে হইবো"। এতক্ষণে এককোণে চুপচাপ বসে থাকা শ্বেত শুভ্র শ্মশ্রুমন্ডিত এক বৃদ্ধ হঠাৎ মুখ খুললেন "আরে , খালি বাস চালু করলেই হইব ? বাতাসের অবস্থা দেখসেন ? এইখানে মানুষ নি্ঃশ্বাস নিতে পারে.????? প্রত্যেকটা মানুষের নিজের ব্যবস্থা নিজেরে করতে হবে।

" বাস জুড়ে তখন নীরবতা , সবাই তাকিয়ে বৃদ্ধের দিকে । দেশ জাতির এই ক্রান্তিকালে তার দেয়া সলিউশনের জন্য যেন সবার অপেক্ষা । মনে মনে আমিও ঝটপট ভাবছি , কিসের কথা বলবেন ?? পরিবেশ বান্ধব সাইকেল বুঝি ?? চীনের রাজধানীর ছবি ভাসিয়ে ফেললাম চোখের সামনে , সেখানে সারি সারি সাইকেল চলছে । বৃদ্ধ এবার বিজ্ঞচোখের শ্যেন দৃষ্টি হেনে অব্যর্থ ভাষায় ইশতেহার ঘোষণা করলেন "শায়েস্তা খাঁ , শাহ সুজার আমলে ঢাকায় ঘোড়া চলত । আমাদের সবারও ঘোড়া থাকতে হবে" বাসের নীরবতা কাটল না , দেশ জাতি ভুলে আমরা একে অন্যের মুখ চাওয়া- চাওয়ি শুরু করলাম..........


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।