যে কোন লড়াই শেষ পর্যন্ত লড়তে পছন্দ করি।
যে কথা জানা দরকার
শরীফ এ. কাফী
১০.০৮.২০১০
বাংলাদেশে মঙ্গোলীয় নৃ-প্রজাতির পাহাড়ী আদিবাসীদের আগমন, অবস্থান ও বিকাশ সমতলের আদিবাসীদের থেকে ভিন্ন। প্রকৃত অর্থে বাঙ্গালী জাতি ও ভাষার উদ্ভবে সমতলের আদিবাসীদের ভূমিকা প্রনিধানযোগ্য। এমন কি সমতলের আদিবাসী ও পাহাড়ীরা একে অন্যকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে। চট্টগ্রামের ভাষা ও চাকমাদের ভাষার যোগসূত্র তার বড় প্রমাণ।
যাক সে কথা, প্রথমে বুঝতে হবে বাংলাদেশের ভূগোল সম্পর্কে। বাংলা বলে পরিচিত যে ভূখন্ড বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত ও বার্মার মধ্যে বিভাজিত হয়েছে তার আকার ও গঠন অতীতে বর্তমানের মত ছিল না। সমূদ্রের তটরেখা, সুন্দরবন এসব আগে অনেক উত্তরে ছিল। বঙ্গোপসাগরের অনেক দ্বীপের তখন কোন অস্তিত্ব ছিল না।
সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতালদের সরেন, কিস্কু, টুডু, হেম্ব্রম, হাজদা, মারান্ডী, প্রভৃতি ১২টি উপগোত্র ছিল।
এর মধ্যে "বিদিয়া" নামে একটি গোত্র এখন সাঁওতালদের মধ্যে বিলুপ্ত। সাঁওতালদের বসবাস বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া এবং রাজশাহী থেকে শুরু করে পশ্চিম বাংলার বর্ধমান অতিক্রম করে বিহারের সাঁওতাল পরগণা, ধনবাদ পার হয়ে তার পরও উত্তর পশ্চিমে বিস্তৃত ছিল।
সাঁওতালদের কাছাকছি অন্যান্য গোত্রের মধ্যে ধাঙ্গড়, ওড়াঔ, মুন্ডা, কোচ, পাহাড়ী, বুনো, বাগ্দী, প্রভৃতি গোষ্ঠী ছিল। এদের বাইরে নদী ও জলাভূমি ভিত্তিক যারা ছিল তাদের মধ্যে রাজবংশী, কৈবর্ত, জলদাস, মালো, বর্মণ প্রভৃতি সমতলের আদিবাসী ছিল। বর্মণরা অবশ্য কৃষিতেও ছিল।
তবে কৃষিতে প্রাধান্য ছিল, শূদ্রদের। তাদের প্রতিচ্ছবি পাবেন এস এম সুলতানের চিত্রকর্মে।
বেদেরাও বাংলাদেশের সবতলের যাযাবর আদিবাসী। কেউ কেউ (যুক্তিযুক্ত ভাবে) দাবী করেন, বেদেরাই সাঁওতালদের হারিয়ে যাওয়া "বিদিয়া" উপগোত্র। তারা যাযাবর হবার কারনে ঘুরতে ঘুরতে ভাষা ও নৃতাত্বিক সংকরায়নের ফলে, তাদের ভাষা ও গোত্র পরিচয় অপভ্রুংশে বর্তমান "বেদে" জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া দক্ষিনে, পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুর অতিক্রম করে উড়িষ্যা পর্যন্ত সাঁওতালদের পূর্ব-সগোত্রীয় দ্রাবিড়দের বসবাস বিস্তৃত ছিল, যা এখনও আছে।
ভারতবর্ষের সকল আদি ভাষা, বিশেষ করে বৃহত্তর দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর বহুল প্রচলিত প্রধান ভাষা, আর্য, শক, হুণ, মোগল, আরব, তুর্কী, পার্শিক এবং ইংরেজদের দ্বারা দারুণ ভাবে পরিবৃত্ত হয়ে তার আদি রূপ বঞ্চিত হয়েছে। তারপরও সাহিত্যে ও কথ্য বংলায় প্রচুর শব্দ এখনও ব্যবহার হয় যা বহিরাগত কোন ভাষারই অংশ বা উপজাত নয়। এই মাটির আদি ভাষা, যা কোচ, সাঁওতালদেরও ভাষা। আমরা ভুলে যাচ্ছি কেন যে, এক সময় নেপাল ও বিহারে (দেহাত অঞ্চলে) শুধু বাংলায় কথা বলা হতো না, লেখালেখির কাজ বাংলা হরফে করা হত।
মধ্যবর্তী সংকরায়িত উপজাত ভাষা, যা এক সময় বৃহত্তর বাংলা ও আশপাশের অঞ্চলে প্রধান ভাষায় রূপ নিয়েছিল, সেই পালি ও প্রাকৃত ভাষা থেকেও তার প্রমাণ পাওয়া যায।
হিন্দু মাইথোলজী বা পূরাণের রেফারেন্স দিয়ে যারা বলতে চান যে, ভারতবর্ষ আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল, তাদের এই চিন্তার সাথে ধর্মীয় আবেগ থাকলেও, আর্যরা কখনো এই ভূখন্ডের আদিবাসী নয়। সাঁওতালদেরকে যারা বাঙ্গালীদের আদি গোত্র হিসেবে স্বীকার করতে চান না, তারা সচেতন বা অবচেতন ভাবে এখনো হিন্দু মাইথোলজীর বিভ্রান্তিতে আছেন।
এদশের আদিবাসীদের প্রায় সবাই দ্রাবিড়-- (পরে আগত মঙ্গলগণ ব্যাতীত), তারাই ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা। আর্যরা তাদের আগে নয়।
আর্যদের ইতিহাস টেনে এনে আগে বসিয়েছে হিন্দু পন্ডিতরা, আর ইতিহাস বিকৃতকারী শশাঙ্ক। আমরা বুঝি না কেন যে, পুরাণের ভাষ্য মতে, রামচন্দ্র আসার আগেই রাবন এখানে ছিল। আর রাবন যে অর্য বা আরিয়ান নয় সে কথা তো পুরাণেই বলেছে, সবাই জানে!
শ্রীলংকা থেকে হিমালয় পর্যন্ত, নদীর দুপাশ বরাবর মাছ-ভাত খাওয়া যে আদিবাসীদের পদচারণায় এই জনপদ একদিন মুখরিত ছিল, সাঁওতালরা যে তাদেরই একটি প্রধনি গোত্র, এ বিষয়ে কারো সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়। যদি কেউ বাঙ্গালী বলে দাবী করতে চান, তাকে মানতেই হবে যে, সাঁওতালরা তাদের পুর্ব পূরুষ, বাঙ্গালীরা সাঁওতালদের অধঃস্তন প্রজন্ম। যারা নিজেদের আর্য, শেখ, আরব, পাঠান---- ভাবতে চান, নৃতাত্ত্বিক ভাবে আদিবাসীদের বংশধর বলতে লজ্জা পান, ক্ষতি নেই, তবে দয়া করে তারা খাটিঁ বাঙ্গালী বলে দাবী না করাটাই ভাল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।