আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের তেল গ্যাস লুণ্ঠনের আইনী বৈধতা দানকারী পিএসসি ২০১২ (সংশোধিত) বাতিল করতে হবে

যদি ঠাঁই দিলে তবে কেন আজ হৃদয়ে দিলে না প্রেমের নৈবদ্য একটা দেশ যখন বৈশ্বিক পুঁজির প্রান্তিক বাজারে পরিণত হয় এবং সে দেশের সরকার ও বিরোধী দল সমেত শাসক শ্রেণি যখন এই বৈশ্বিক পুঁজিবাদের এজেন্সির দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই তাদের ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতি চালু রাখতে বাধ্য হয় তখন সে দেশের জাতীয় সম্পদ কী করে লুণ্ঠিত হয়, সে দেশের সমস্ত জাতীয় সম্পত্তিতে কী করে সাম্রাজ্যবাদীদের মালিকানাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয় নানান চুক্তি আর আইনের নিরিখে তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণে পরিণত হচ্ছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ! এদেশের তেল গ্যাস খনিজের উপর সাম্রাজ্যবাদীদের মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ এবং মালিকানা প্রতিষ্ঠার এজেন্সিতে পরিণত হয়েছে এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র, এই কথিত স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র এমন সব চুক্তি করে চলেছে যাতে করে দেশের সম্পদের অবাধ লুণ্ঠনকে রাষ্ট্রীয় ও আইনী বৈধতা দেয়া হচ্ছে! পিএসসি ২০১২ (সংশোধিত) এমনই এক রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন অংশীদারিত্ব চুক্তি যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তেল গ্যাস এর উপর বিদেশি কোম্পানির মালিকানা নিরঙ্কুশ করার বিধান রাখা হয়েছে! অভ্যন্তরীণ সহিংস রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব সংঘাতে যখন দেশের জনগণ ব্যতিব্যস্ত তখন দেশের সাগরের উত্তোলিত তেল গ্যাসের উপর বহুজাতিক তেল কোম্পানির মালিকানা বৃদ্ধির প্রস্তাব রেখে নতুন পিএসসি মডেল পাস করতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা (নিউ এজ, ৯ মে, ২০১৩)। জাতীয় সম্পদের উপর সরকার ও জনগণের ন্যায্য মালিকানা না রাখায় যেখানে পিএসসি মডেল ২০০৮ এবং পিএসসি মডেল ২০১২ এর বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বার বার প্রতিবাদ কর্মসূচী এসেছে সেখানে নতুন করে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির তেল গ্যাস সম্পদের উপর মালিকানা আরও বৃদ্ধি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। আইন মন্ত্রণালয় পেট্রোবাংলার প্রস্তাবিত সংশোধিত উন্নয়ন অংশীদারিত্ব চুক্তি পিএসসি মডেল ২০১২ অনুমোদন করেছে বলে খবরে প্রকাশ। এই প্রস্তাবনাটি এখন জ্বালানী মন্ত্রণালয় মন্ত্রীসভায় অনুমোদনের জন্য পাঠাবে বলে জানা যায়। পাশাপাশি গত মঙ্গলবার এনার্জি ডিভিশন সংশোধিত নতুন পিএসসির আওতায় পেট্রোবাংলাকে অগভীর সাগর বক্ষের ৬ টি ব্লকের (ব্লক নং ২,৩,৬,৭,৮ ও ১০) নতুন দরপত্র প্রদানের জন্য চিঠি ইস্যু করে।

এর আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০১৩ সালের এপ্রিলে সাগরের বিভিন্ন ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহবান করার পর ১৪ টি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি ১২ টি অফশোর ব্লকের দরপত্র কিনলেও তারা তা দাখিল করে নাই। ১ এপ্রিল শুধু মাত্র ভারতীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশন ভিদেশ অগভীর সমদ্রের ব্লক ৪ ও ৯ এবং মার্কিন তেল কোম্পানি কনকোফিলিপস অগভীর ব্লক ৭ এর জন্য দরপত্র দাখিল করে। পরবর্তীতে এসব বহুজাতিক কোম্পানি গভীর ও অগভীর সমুদ্রে উত্তোলিত গ্যাসে কোম্পানির শেয়ার বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠায় এনার্জি ডিভিশনের কাছে এবং মালিকানা বৃদ্ধির বিধান রেখে পিএসসি মডেল নতুন করে সংশোধন করলে দরপত্র দাখিল করবে বলে সরকারের কাছে দাবি জানায়। পেট্রোবাংলা বহুজাতিক কোম্পানির এই অন্যায্য সিন্ডিকেটেড দাবির কাছে নতি স্বীকার করে তা মেনে নেয় এবং পিএসসি মডেল ২০১২ সংশোধন করে। কষ্ট রিকভারি লিমিট ও তেল গ্যাসের ক্রয় মূল্য বৃদ্ধি এমনকি বিশাল অংশের ট্যাক্স মওকুফের বিধান রেখে এই মডেল সংশোধন সাগরের তেল গ্যাসে বহুজাতিক কোম্পানির নিরঙ্কুশ মালিকানা ও আধিপত্য সুনিশ্চিত করবে।

কস্ট রিকভারি লিমিট ৫৫% থেকে বৃদ্ধি করে ৭০% করা হয়েছে সংশোধিত পিএসসি মডেল-২০১২ এ কস্ট রিকভারি লিমিট ৫৫% থেকে বৃদ্ধি করে ৭০% করা হয়েছে, এর মানে বিদেশি তেল কোম্পানি কস্ট রিকভারির নামে দেশের ৭০% উত্তোলিত তেল ও গ্যাস পুরাটাই নিজের মালিকানায় নিয়ে যাবে, ফলে আগের তুলনায় তেল গ্যাস লুণ্ঠন আরও বৃদ্ধি পাবে! ২০০৮ ও ২০১২ সালের পিএসসি অনুসারে বিদেশি কোম্পানিগুলো তেল গ্যাস অনুসন্ধানে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে সেটা মোট গ্যাসের ৫৫ ভাগের বিনিময়ে 'কস্ট রিকভারি' হিসেবে সমন্বয়ের সুযোগ পেত। বাকি গ্যাস ভাগাভাগি হতো বাংলাদেশ ও বিদেশি কোম্পানির মধ্যে। বিদেশি কোম্পানি নানা টালবাহানায় প্রতি মাসেই পেট্রোবাংলাকে মোটা অঙ্কের উত্তোলন বিল ধরিয়ে দেয়। বিদেশি কোম্পানিগুলোর উত্তোলন ব্যয় বা কস্ট রিকভারি খনিতে গ্যাস থাকা পর্যন্ত কখনো শেষ হয় না ফলে কস্ট রিকভারির নামে তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পূর্বের মডেলে ৫৫% কস্ট রিকভারিই যেখানে অন্যায্য সেখানে সংশোধিত পিএসসিতে তা ৭০% করা মানে হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক দেশের তেল গ্যাসের অবাধ লুণ্ঠনকে আইনি বৈধতা দেয়া।

আমাদের নিজেদের গ্যাস আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিদেশি কোম্পানি থেকে কিনতে হবে শুধু তাই নয় সংশোধিত উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি)-২০১২ অনুসারে বহুজাতিক তেল কোম্পানি তার শেয়ারের ৫০% গ্যাস পেট্রোবাংলার কাছে প্রতি হাজার ঘনফুট ৬.৫ ডলার দামে বিক্রি করবে যা পিএসসি-২০১২ তে ছিল গভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ৪.৫৭ ডলার ও অগভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ৪.১৫৭ ডলার এবং পিএসসি-২০০৮ এ ছিল ২.৯ ডলার; আর বাকি গ্যাস তারা তৃতীয় পক্ষের কাছে নেগোশিয়েশনের ভিত্তিতে যে কোন দামে বিক্রি করতে পারবে। এই মূল্য বৃদ্ধি ২০১২ এর তুলনায় ৪২% এবং ২০০৮ এর তুলনায় ১২৪% বেশি। সংশোধিত মডেল বাস্তবায়ন করলে আমাদের নিজেদের গ্যাস আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিদেশি কোম্পানি থেকে কিনতে হবে পেট্রোবাংলাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি হলেও পিএসসি’র ধারায় অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ অযৌক্তিক। এতে নিজের দেশের গ্যাস কিনতে পেট্রোবাংলাকে বিপুল পরিমাণ লোকসান গুনতে হবে।

এমনিতেই ২০০৮ এর পিএসসি’র আওয়তায় বহুজাতিক কোম্পানি সরকারের কাছে উত্তোলিত গ্যাস চড়া মূল্যে বিক্রি করে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সরকারি প্রতিষ্ঠান বাপেক্স উত্তোলিত গ্যাস যে দামে সরবরাহ করে বহুজাতিক কোম্পানি একই পরিমাণ গ্যাস বিক্রি করে ৫-১০ গুণ বেশি দামে , অপরদিকে কস্ট রিকভারির নামে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যেভাবে কোটি কোটি টাকা তুলে নেয় তার হিসাব যোগ করলে দেখা যাবে সরকারকে কোম্পানির কাছ থেকে ৫০-১০০ গুন বেশি দামে গ্যাস ক্রয় করতে হয়। তাই মডেল পিএসসি ২০১২ ( সংশোধিত) এ গ্যাসের ক্রয়মূল্য বৃদ্ধির এই উল্লম্পন বহুজাতিকের ভয়াবহ গ্যাস লুণ্ঠনের দুয়ার খুলে দিবে বলেই মনে হচ্ছে! বিদেশি কোম্পানির কর্পোরেট ট্যাক্স এর ৩৭.৫% পেট্রোবাংলাকেই বহন করতে হবে! আবার নতুন মডেল অনুসারে বিদেশি কোম্পানির কর্পোরেট ট্যাক্স এর ৩৭.৫% পেট্রোবাংলাকেই বহন করতে হবে! এটা আর একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ সরকার এর মধ্য দিয়ে কোটি কোটি টাকা ট্যাক্স বাবদ গচ্চা দিতে হবে! গত মাসেই রামপালে সুন্দরবন বিধ্বংসী কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রির মুনাফার ওপর ভারতীয় কোম্পানি ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনকে (এনটিপিসি) ১০ বছরের করমুক্তি সুবিধা দিয়ে চুক্তি সই করেছে সরকার। একই রকম ভাবে নতুন পিএসসি’র মাধ্যমে বহুজাতিক তেল কোম্পানির ৩৭.৫% কর্পোরেট ট্যাক্স কোম্পানির পক্ষ থেকে পেট্রোবাংলা পরিশোধ করার মানে হচ্ছে এই ট্যাক্স মওকুফ করে দেয়া এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে।

বিদেশি কোম্পানির মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার নিশ্চয়তা বিধান করতে গিয়ে বিপুল ট্যাক্স মওকুফ করার কোন যুক্তি সঙ্গত কারণ আছে বলে মনে হয় না। প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক জনগণ হলেও শুধুমাত্র কারিগরি দক্ষতার জন্যই বহুজাতিক কোম্পানির নিরঙ্কুশ মালিকানা অযৌক্তিক এবং অন্যায়। ২০০৮ ও ২০১২ এর মডেলে প্রফিট গ্যাস ৪৫% হলেও এখন সংশোধিত মডেলে তা মাত্র ৩০%, ফলে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ অবলোপন (ধারা ১৫.৫.১, পি এস সি ২০১২) করলেও প্রফিট গ্যাস ব্যাপকহারে কমানো, গ্যাসের দ্বিগুণেরও অধিক মূল্য বৃদ্ধি ও ৩৭.৫% ট্যাক্স মওকুফ এই সব কিছু বিবেচনায় নিলে পেট্রোবাংলা বা সরকারের লাভের অংশ আগের চেয়ে অনেক কমে যাবে এবং এই বিধানগুলো বহুজাতিকের গ্যাস সম্পদ লুণ্ঠনকে আরও বৃদ্ধি করে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জনকে ত্বরান্বিত করবে। আগের পি এস সি তে ৮০% গ্যাস রপ্তানির সুযোগ রাখা নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ আসায় নতুন পিএসসি’তে গ্যাস রপ্তানির ধারা না রেখেই গ্যাসের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধি ও ৭০% কস্ট রিকভারির সুযোগ রেখে কোম্পানিকে তা পুষিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই নতুন মডেল অনুসারে বহুজতিক কোম্পানির সাথে সম্পাদিত চুক্তি কারনে উত্তোলিত গ্যাসের উপর সরকার ও জনগনের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রন থাকবে না।

দেশের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক জনগণ হলেও শুধুমাত্র কারিগরি দক্ষতার জন্যই বহুজাতিক কোম্পানির নিরঙ্কুশ মালিকানা অযৌক্তিক এবং অন্যায়। দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য পিএসসি’তে অসম ও অন্যায্য ধারা যুক্ত করা হতাশাজনক। পূর্বের পিএসসি’র মতই পেট্রোবাংলার এই পিএসসি ২০১২ (সংশোধিত) জাতীয় স্বার্থের চেয়ে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ দেখভালের বিষয়টি মাথায় রেখেই করা হয়েছে। আমরা মনে করি এই ধরণের অন্যায্য ও অসম চুক্তি অনুমোদন না করাই সার্বিক ভাবে দেশের জন্য কল্যাণকর। অবিলম্বে এই পিএসসি বাতিল করে জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি ধারাগুলো রিভিউ করে সংশোধন করতে হবে যাতে সমভাবে উভয়পক্ষই লাভবান হয়।

আমরা মনে করি বর্তমান পিএসসি মডেল বাতিল করে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর জনগনের মালিকানা অক্ষুন্ন রাখার ব্যবস্থা রেখেই নতুন জ্বালানী নীতি প্রনয়ন করতে হবে। দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য এর কোন বিকল্প নেই। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.