আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রা [পর্ব-১]

নিরপেক্ষ আমি

যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগের নারী হলেও বিশ্বজুড়ে আজো তাকে নিয়ে কৌতূহলের কোনো কমতি নেই। রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রার প্রসঙ্গ আসলেই প্রাচীন মিসর আর রোম সভ্যতার কথা অনিবার্যভাবে ওঠে আসবে। মরুভূমির দেশ মিসরের চারদিকে শুধু বালি আর বালি। এ যেন বালির পাহাড় আর বালির সমুদ্র। কিন্তু নীলনদ, চারদিকের রুক্ষতার মধ্যে সৃষ্টি করেছে সবুজ-শ্যামল প্রান্তর।

নীলনদে প্রতিবছর বন্যা হতো। সেই বন্যা ছিল ভয়ঙ্কর। কিন্তু এতে উপকার হয়েছিল অনেক। বন্যার জল নেমে গেলেও যে পলিমাটি পড়ে থাকত, তাতে জমি হতো উর্বর। চাষাবাদ করে মানুষ জীবনযাপন করত।

প্রায় ৪০০ মাইল এভাবেই হয়ে উঠেছিল সুজলা-সুফলা। এভাবেই সূত্রপাত মিসরীয় সভ্যতার। আর সেখানকারই ইতিহাসখ্যাত এক দেশ আলেকজান্দ্রিয়া। ক্লিওপেট্রা ছিলেন সেই দেশের রানী। এই রূপসী ও তরুণীকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে অনেক কল্পকাহিনী আর কিংবদন্তি।

লেখা হয়েছে অনেক গল্প-কবিতা-উপন্যাস। নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও। এমনকি মহান সাহিত্যিক শেঙ্পিয়রও তার নাটকে অমর করে রেখেছেন রানী ক্লিওপেট্রার প্রেমকাহিনীকে। ক্লিওপেট্রার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ সালে প্রাচীন মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। তার পুৃরা নাম ঈষবড়ঢ়ধঃৎধ ঠওও ঞযবধ চযরষড়ঢ়ধঃড়ৎ. ক্লিওপেট্রার বড় আরো দু'বোন ছিল।

ক্লিওপেট্রা-৬ আর বেরেনিস; আর ছোট বোনের নাম ছিল আরসিনো-৪। তার ছোট আরো দু'ভাইও ছিল টলেমি-১৩ ও টলেমি-১৪ নামে। ধারণা করা হয়, ক্লিওপেট্রা-৬ ছোটবেলায় মারা যান, আর বেরেনিস কোনো কারণে অযোগ্য ছিলেন। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দে রোম সম্রাট টলেমি অলেতিস মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগে তার বিশাল সাম্রাজ্য ১৮ বছর বয়সী কন্যা ক্লিওপেট্রা (ক্লিওপেট্রা-৭) ও ১৮ বছর বয়সী পুত্র টলেমি-১৩-কে উইল করে দিয়ে যান।

সেইসঙ্গে মৃত্যুর সময় রোমান নেতা পম্পে-কে রাজ্য ও তার সন্তানদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখনকার মিসরীয় আইন অনুসারে দ্বৈত শাসনের নিয়মে রানী ক্লিওপেট্রার একজন নিজস্ব সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কাজেই ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করতে হয় তারই ছোটভাই টলেমি-১৩কে, যখন তার বয়স ১২ বছর। কিন্তু, ক্লিওপেট্রা ক্ষমতায় বসার কিছুদিনের মধ্যেই প্রচলিত মুদ্রার ওপর থেকে টলেমি-১৩'র ছবি তুলে দিলেন, সব অফিসিয়াল কাগজপত্র থেকেও তার নাম বাদ দিয়ে দিলেন অবজ্ঞা করে। কিন্তু এর সবই ছিল আইনবিরোধী কার্যকলাপ।

আইন অনুসারে দ্বৈতশাসনে পুরুষের নাম থাকবেই এবং সেটা অবশ্যই নারীর ওপর থাকবে। ফলে এ ধরনের কাজের মাধ্যমে ক্লিওপেট্রা বিস্তর সমালোচনার মুখোমুখি হলেন। এরই মধ্যে রাজ্যের একাধিক অংশ চলে গেল বহিঃশক্তির দখলে। অরাজকতার পাশাপাশি দেশজুড়ে দেখা দিল চরম খাদ্যাভাব। যদিও ক্লিওপেট্রা ছিলেন মানসিকভাবে অত্যন্ত ধীশক্তিসম্পন্ন মেসিডোনিয়ার রানী যার সুন্দর স্বপ্ন ছিল যে, নিজ দেশকে তিনি আরো ভালো করে গড়ে তুলবেন, আরো বৃহত্তর পরিসরে তিনি রানী হবেন।

ধীরে ধীরে তিনি সে রকমটিই হতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিগত দিনের ন্যায় অন্যান্য হেলেনিয় রানীদের মতোই তিনি ছিলেন একটু নরম মেজাজের যে কিনা ভালোবাসার পাত্রী, দুর্বল চরিত্রের নারী। তবে তিনি যেকোনো মূল্যে নিজের জন্মস্থান আলেকজান্দ্রিয়া রক্ষা করার ব্যাপারে ছিলেন দঢ়প্রতিজ্ঞ। ক্ষমতায় আরোহণের পর নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও ক্লিওপেট্রা তার শাসন চালিয়ে গেলেন। এরই মধ্যে ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ফারসালুসের যুদ্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাপতি পম্পে পরাজিত হলেন।

সে বছরই আলেকজান্দ্রিয়ায় ফেরার পথে ফারসালুসের হাতে নিহত হন। যুদ্ধ থেকে পালাতে গিয়ে ক্লিওপেট্রার স্বামী ও ভাই টলেমি-১৩'র মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা হয়ে ওঠেন মিসরের একচ্ছত্র রানী। মার্ক অ্যান্টনিও ছিলেন রোমের পরাক্রমশালী বীর। লোকমুখে তিনি শুনেছিলেন ক্লিওপেট্রার রূপ-লাবণ্যের কথা।

কিন্তু কিভাবে সেই রূপ-লাবণ্য চাক্ষুষ করবেন? একদিন তিনি রোম থেকে এসে হাজির হলেন ক্লিওপেট্রার কারুকার্যশোভিত প্রাসাদের সামনে। রানী ক্লিওপেট্রার কাছে খবর গেল অন্দর মহলে। মার্ক অ্যান্টনিওকে দেখে তিনিও মুগ্ধ হলেন। পরিচারিকাকে ডেকে বলেন, 'নিয়ে এসো তাকে যোগ্য সম্মান জানিয়ে। ' কথামতো কাজ।

অ্যান্টনিও প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হলেন ক্লিওপেট্রাকে দেখে। যত দেখেন, ততই যেন দেখার আকর্ষণ বেড়ে যায়। নয়নের তৃপ্তি হয় না যেন কিছুতেই। এভাবে সূচনা। কিন্তু তারপর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে অ্যান্টনিওর জীবন।

পত্নী ফুলভিয়ার মৃত্যু এবং পম্পির বিদ্রোহ ঘোষণা। গৃহযুদ্ধে রীতিমতো বিপর্যস্ত রোম। শেষ পর্যন্ত অ্যান্টনিওর আত্দহত্যা, সিজারের সঙ্গে ক্লিওপেট্রার যোগাযোগ এবং সবকিছুর পরিণামে ক্লিওপেট্রার মৃত্যুবরণ। এসব কাহিনী যেন মিসরের আকাশে-বাতাসে আজো ঝঙ্কার তোলে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে ক্লিওপেট্রার জীবন নিয়ে নানা বিস্ময়কর কাহিনী।

মিসর ছিল তখন সবদিক থেকেই সমৃদ্ধ। রোমের দৃষ্টি প্রায় সর্বদাই নিবদ্ধ থাকত সেদিকে, খাদ্য বা অন্য প্রয়োজনে। রোমের গৃহযুদ্ধের নায়ক পম্পি। সিজারের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ। জনসাধারণকে তিনি বুঝিয়েছেন, সিজার ও তার পৃষ্ঠপোষকরা ভীষণ অবিচার করেছেন পম্পির পিতাকে অকারণে হত্যা করে।

পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে তার এই বিদ্রোহ। সিজার শুনতে পেলেন, তার বিরোধীরা দল বেঁধে পম্পির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে অথচ দেশের এ দুর্দিনে অ্যান্টনিও ভোগবিলাসে আত্দহারা ক্লিওপেট্রার সঙ্গে। পড়ে আছেন আলেকজান্দ্রিয়ার রাজপ্রাসাদে। সিজার কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত তার একান্ত বিশ্বস্ত লেপাডাইসের সঙ্গে পরামর্শ করে একজন দূতকে পাঠালেন মিসরে।

অনেক টানাপড়েন সত্ত্বেও সফল হলেন তিনি। ফিরে এলেন তিনি। খ্রিস্টের জন্মের ৪৯ বছর আগে যে গৃহযুদ্ধের সূচনা, তার সমাপ্তি ঘটল পম্পির পরাজয়ে। পম্পি পালিয়ে গেলেন ক্লিওপেট্রার দেশ আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশে। কিন্তু শত্রুকে বিনাশ না করতে পারলে মনে শান্তি নেই সিজারের।

অনুচরদের আদেশ দিলেন যে করেই হোক পম্পিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। অনুচরদের কাছে খবর এলো পম্পি পালিয়ে যাচ্ছে ক্লিওপেট্রার দেশে। ওঁত পেতে রইল তারা। সেখানে পম্পি যাওয়া মাত্র সিজারের অনুচররা ছুরিকাঘাতে হত্যা করল পম্পিকে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, সময়টা ছিল যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৪৮ বছর আগে, সেপ্টেম্বর মাস।

সিজারের পথ থেকে আরো একটি কাঁটার বিলুপ্তি ঘটল। এরপর সিজার তার দূতের মাধ্যমে ক্লিওপেট্রাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। মজার ব্যাপার এই যে, প্রস্তাব শুনে ক্লিওপেট্রা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। ক্লিওপেট্রার জীবনে শুরু হলো অন্য এক পর্ব। সিজারের সঙ্গে ক্লিওপেট্রাকে মিসরের রানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন এবং মিসর শাসন করতে লাগলেন।

[চলবে]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।